Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

সংঘর্ষের আঁচটা পাক সেনার পক্ষেই জরুরি

কিছু কাল পর পরই ভারতের সঙ্গে অশান্তির আঁচটা বাড়িয়ে নিজেকে একটু তাতিয়ে নেয় পাক সেনাবাহিনী। তাতে দেশের সর্বোচ্চ প্রহরী হিসেবে তার ইমেজ-টা পাকাপোক্ত হয়।কিছু কাল পর পরই ভারতের সঙ্গে অশান্তির আঁচটা বাড়িয়ে নিজেকে একটু তাতিয়ে নেয় পাক সেনাবাহিনী। তাতে দেশের সর্বোচ্চ প্রহরী হিসেবে তার ইমেজ-টা পাকাপোক্ত হয়।

চালক নন, খেলার ঘুঁটি। নওয়াজ শরিফ (বাঁ দিকে) ও নরেন্দ্র মোদী। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশন, সেপ্টেম্বর ২০১৪। ছবি: রয়টার্স ও পিটিআই

চালক নন, খেলার ঘুঁটি। নওয়াজ শরিফ (বাঁ দিকে) ও নরেন্দ্র মোদী। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশন, সেপ্টেম্বর ২০১৪। ছবি: রয়টার্স ও পিটিআই

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

দুনিয়ার সবচেয়ে অস্ত্র-মণ্ডিত সীমানা-অঞ্চলের দুই দিকে বন্দুকের নির্ঘোষ একটু কমতে শুরু করেছে। একটানা নয় দিন প্রবল গোলাগুলি-বর্ষণের পর ভারতের জম্মু ও পাকিস্তানের মধ্যস্থ ২৪০ কিলোমিটার লম্বা সীমারেখার এ দিকে ও দিকে আপাতত খানিক নৈঃশব্দ্য ফিরে এসেছে। আগুনের ভয়াল রং এখন কেবল কিছু ছোটখাটো অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ।

পাকিস্তানকে চুপ করানো গিয়েছে: মহারাষ্ট্রে এক নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে ঘোষণা করে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মহাপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলে এসেছেন, ভারতীয় সৈন্যরা নাকি পাকিস্তানকে একেবারে উচিত শিক্ষা দিয়েছে।

সত্যিই কি পাকিস্তান শিক্ষা পেয়েছে? পাক সেনা কি তবে পরাজয় স্বীকার করে নতমস্তকে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হল এ বার?

এই প্রশ্নের হয়তো একটা ঠিকঠাক উত্তর মিলতে পারে পাক প্রশাসনের দিকে ভাল করে তাকালে। পাকিস্তান সম্পর্কে আগ্রহী-মাত্রেই জানেন, সে দেশের প্রশাসন আসলে একটা দুই-মাথাবিশিষ্ট জন্তুর মতো, একটা মাথা দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর শাসনাধীন, অন্য মাথাটা পাকিস্তানের মহাপ্রতাপান্বিত সামরিক বাহিনীর নির্দেশাধীন।

এখন সমস্যা হল, পাকিস্তানে এই দুই মাথার মধ্যে অনেক সময়ই অনৈক্য ও অসামঞ্জস্য। দুটি মাথাই মনে করে দেশের জন্য কোনটা ভাল, কোনটা ভাল নয়, সেটা সে-ই সবচেয়ে ভাল জানে এবং বোঝে। বিপুল জনসমর্থনে জিতে আসা প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিশ্বাস যে তাঁর দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ভারতের সমস্যার থেকে অনেক বেশি গুরুতর। বিশ্বাসটাকে ভিত্তিহীন বলা যায় না। তাঁর সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ, ইসলামি জঙ্গিবাহিনীর মোকাবিলা করে। দেশ জুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে তারা, অর্থনীতিকে মোটের উপর ধ্বংস করে দিচ্ছে, বিদেশি লগ্নিকারীদের ওই দেশমুখো হতেই দিচ্ছে না। পরের সমস্যাটাও একই রকম কঠিন: বিদ্যুতের তীব্র অভাবে শক্তি-মূল্যের চড়চড় বৃদ্ধি, অর্থনীতির সার্বিক অচলাবস্থা, বেকারত্ব অভূতপূর্ব পরিমাণে বাড়া। একের পর এক গ্রীষ্ম কেটে যাচ্ছে, শহরগুলোতে বিদ্যুৎ নেই, লোকে প্রায় দাঙ্গা লাগিয়ে দিচ্ছে বিদ্যুতের অভাবজনিত কষ্টে। তার সঙ্গে অপরাধীচক্রের বাড়বাড়ন্ত আর স্থানীয় জনজাতির অশান্তি তো আছেই। বিশ্বের যে দেশগুলিতে জনসংখ্যা দ্রুততম হারে বাড়ছে, পাকিস্তান তার মধ্যে অন্যতম। সুতরাং এক কর্মহীন, উত্তেজনপ্রবণ ও ক্রমশ উগ্রবাদী হয়ে-ওঠা বিপুল যুবসমাজ গোটা পাকিস্তান জুড়ে চোখে পড়ে। এই অসম্ভব নিরাশাজনক পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন নওয়াজ শরিফ। তিনি জানেন, টিঁকতে হলে তাঁকে যে করে হোক অবস্থা খানিক পাল্টাতেই হবে।

অন্য দিকে, সেনাবাহিনীর দশা তুলনায় ভাল বলতে হবে। এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য আরব দেশগুলি থেকে টাকার নিয়মিত সরবরাহ আসছে। পুষ্ট হচ্ছে দেশের অর্থসমৃদ্ধ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ফৌজি ফাউন্ডেশন, আজকের পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম, যাদের হাতে আছে আর্থিক লেনদেনকারী, শক্তি-সরবরাহকারী এবং শিল্পভিত্তিক বিভিন্ন কোম্পানি। যদি সেনা তার কিছু ক্ষমতা ইতিমধ্যে অসামরিক নেতৃত্বের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েও থাকে, সে কেবল এই জন্যই যে কিছু দায় তার নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়া খুব দরকার ছিল। যেমন, দেশের দুর্বল অর্থনীতি চালিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক দায়। পাক সেনাবাহিনীর বিশ্বাস, তার ভবিষ্যৎ প্রতাপ ভর করে আছে দুটি শর্তের উপর। প্রথম ও সবচেয়ে গুরুতর শর্ত, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ প্রহরী হিসেবে সেনাবাহিনীর ইমেজ-টাকে রক্ষা করা। দ্বিতীয়ত, আমেরিকা ও চিন, বিশ্বের বৃহত্তম দুই শক্তির কাছ থেকে যথাসম্ভব স্ট্র্যাটেজিক সুবিধা আদায় করার যে সাফল্য, তাকে বজায় রাখা। সুতরাং, কিছু কাল পর পরই পাক বাহিনীর প্রয়োজন হয় ভারত নামক প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে অশান্তির আঁচটা একটু বাড়িয়ে নিজেকে একটু তাতিয়ে নেওয়া। শত্রুর গুলিতে দেশের অসামরিক নাগরিকের করুণ মৃত্যু: এই রকম একটা খবরের চেয়ে আর কী-ই বা দ্রুততর বেগে দেশপ্রেমের স্ফুলিঙ্গ তৈরি করতে পারে।

এই বার অবশ্য রাওয়ালপিন্ডির সেনা-হেডকোয়ার্টারে সীমান্ত-উত্তেজনা তৈরির সিদ্ধান্তের পিছনে আরও কিছু কারণ ছিল। প্রথম কারণটি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নিজেই। বরাবরই নওয়াজ শরিফ নামক ব্যক্তিটি নিজের মতো চলার একটা প্রবণতা দেখিয়ে এসেছেন, যেটা সেনাবাহিনীর একেবারেই পছন্দসই নয়। জাতীয় পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা নিয়ে আসার পর শরিফ হয়তো সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করার স্বপ্নও দেখছিলেন। প্রাক্তন স্বৈরশাসক জেনারেল পারভেজ মুশারফকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এবং সবচেয়ে বড় কথা ভারতের সঙ্গে শান্তি-সম্পর্কের কথা ভাবছিলেন! উল্টো দিকে, সেনাবাহিনীকে তাই প্রথম দিন থেকে শরিফকে স্পষ্ট করে নিজের জায়গাটা দেখিয়ে দিতে হচ্ছিল। প্রথম দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সময়ই যখন শরিফ ন্যাশনাল অ্যাসেম্ব্লি-র দিকে রওনা হবেন, হঠাৎ রাস্তা গেল বন্ধ হয়ে। থামতে বাধ্য হলেন শরিফ। টানা আধঘণ্টা তাঁকে অপেক্ষা করতে হল, কেননা সামনে দিয়ে তখনই যেতে হল আর্মি চিফ-এর গাড়ির সুদীর্ঘ কনভয়টিকে। বোধহয় এই অপমানটা ভুলতে পারেননি শরিফ। তাই ক্ষমতায় এসেই পরবর্তী সেনাপ্রধানের নাম নিজে স্থির করলেন। অনেক সিনিয়র এবং গুরুত্বপূর্ণ অফিসারকে টপকে তুলনায় ‘লো-প্রোফাইল’ জনৈক জেনারেল রাহিল শরিফকে নির্বাচন করলেন।

তবে, জেনারেল শরিফকে দিয়ে সেনাবাহিনীর উপর কর্তৃত্ব করার কথা যদি শরিফ স্বপ্নেও ভেবে থাকেন, বিরাট ভুল হয়েছিল তাঁর। কেননা, পাক সেনাপ্রধানের ব্যক্তিগত অবস্থান বা ভাবনাচিন্তা যেমনই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তাঁকে কিন্তু দেশের বৃহত্তর সেনা-প্রতিষ্ঠানের কাছেই দায়বদ্ধ থাকতে হয়। এই ‘প্রতিষ্ঠান’ বলতে বোঝানো হয় অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল, তাঁদের প্রতিনিধিবর্গ, নিযুক্ত সেনা-অফিসার এবং অসামরিক সমর্থকবাহিনী। কোনও সেনা-প্রধানের পক্ষে নিজস্ব অভিমুখে চলা কখনও প্রত্যাশিত নয়, সম্ভবও নয়।

তাই যখন সেনা-প্রতিষ্ঠান ঠিক করল যে প্রধানমন্ত্র নওয়াজ শরিফকে তাঁর সীমারেখাটা ঠিক করে দেখিয়ে দিতে হবে, জেনারেল শরিফ বাগ মানতে বাধ্য হলেন। শুরু হল অপারেশন ইমরান খান। প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং বর্তমান রাজনীতিক ইমরান খানের পিছনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল অসংখ্য সমর্থককে, যাঁদের অনেকেই ভাড়াটে সমর্থক। সঙ্গে জুড়ে গেলেন কানাডা-বাসী ইসলাম-পন্থী নেতা ডক্টর তহিরুল কাদরি। রাজধানী ইসলামাবাদ ঘিরে ফেলা হল প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের দাবিতে।

ইমরান খানের এই রাস্তার জনতার সঙ্গে যদি পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাজও একসঙ্গে হাত মেলাত, তবে সে দেশেও ইতিমধ্যে একটা ‘আরব বসন্ত’ ঘটে যেত। কিন্তু সেটা হল না। বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) যে কেবল নওয়াজ শরিফকেই চাপা সমর্থন জোগাল, তা-ই নয়। ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর প্রেিসেন্ট জাভেদ হাশমি নিজেই শরিফ-পন্থী হয়ে গেলেন। ইমরান খানের আন্দোলনের পিছনে যে সেনাবাহিনীর চিত্রনাট্য, সেটা তিনিই প্রথম প্রকাশ্যে জানালেন। পর্দার নেপথ্যে রইল নওয়াজ শরিফের সমর্থকদের বোঝাপড়া। সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত যে শান্তি-প্রস্তাব আনল, তার পিছনেও নাকি ছিল এঁদের মধ্যস্থতা।

বলা বাহুল্য, যতই ‘শান্তি’ আসুক, নওয়াজ শরিফকে পূর্ণ মাত্রায় ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই রইল না। ভারত-বিষয়ক নীতিতে তাঁকে পিছু হটতে হল। জেনারেল মুশারফকে যাতে বিচারের মধ্যে টেনে আনা না হয়, সেটা নিশ্চিত করা হল। তাঁকে শাস্তি দিলে তারও আগের আরও কয়েক জন শক্তিশালী জেনারেল-এর শাস্তিদানের পথও সুগম হয়ে যায়, যেটা পাক বাহিনীর কাছে স্বভাবতই একেবারে হজমযোগ্য নয়।

সুতরাং নওয়াজ শরিফ ফিরে এলেন ‘কাশ্মীর’-লাইনে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টায় জোরসে ব্রেক কষা হল। জেনারেলদের নির্দেশ দেওয়া হল, ভারতের বর্তমান কট্টরপন্থী প্রধানমন্ত্রীটির সঙ্গে ক্ষমতার খেলায় নামার জন্য। অস্ত্রের গর্জনে ভরে গেল কাশ্মীরের নয়নাভিরাম চিত্রপট। আখনুর, জম্মু, সাম্বা, কাঠুয়ায় যে নয় দিনব্যাপী সীমান্ত-ঝড় উঠল, সেটাকে তাই কোনও মতেই কোনও চরম সংগ্রাম বলা চলে না। সেটা কেবল সংগ্রামের মহড়া।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী যতই গলা উঁচিয়ে বলুন না কেন, পাক বাহিনীকে তিনি আচ্ছা করে শায়েস্তা করে দিয়েছেন, তাঁর বাক্যের প্রত্যুত্তর সীমানা পেরিয়ে আসছেই। কবে, কখন, কী ভাবে সেই উত্তর আসে, সেটাই কেবল দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE