ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে জলসীমা সংক্রান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি হইয়াছে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর বঙ্গোপসাগরে ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার উপর কাহার দখল থাকিবে, সে-সংক্রান্ত বিরোধ রাষ্ট্রপুঞ্জের ট্রাইবুনাল নিষ্পত্তি করিয়া দিয়াছে। ট্রাইবুনালের রায়ে এই এলাকার চার-পঞ্চমাংশ বাংলাদেশের দখলে গিয়াছে, যেখানে অতঃপর তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎস অনুসন্ধান হইতে শুরু করিয়া অন্যান্য সমুদ্রগর্ভস্থ খনিজ সম্পদ আহরণের অধিকারও বাংলাদেশেরই। বিরোধের নিষ্পত্তি হইতে সময় লাগিয়াছে দীর্ঘ কাল। কিন্তু এই নিষ্পত্তির সবচেয়ে বড় ব্যাপার হইল, বিরোধটি কখনওই দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্কের সীমানা অতিক্রম করে নাই, উভয় দেশের মধ্যে ইহা লইয়া কোনও কাজিয়া, মন-কষাকষিও হয় নাই, বিরূপতা বা বৈরিতা তো নয়ই।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সংশ্লিষ্ট ট্রাইবুনাল যে মসৃণভাবে বিষয়টির নিষ্পত্তি করিতে পারিয়াছে, সে জন্য বাংলাদেশের তরফে কৃতিত্ব দেওয়া হইয়াছে ভারতকে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি নয়াদিল্লির বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব এবং মীমাংসার সদিচ্ছাই যে বাংলাদেশকে তাহার প্রাপ্য বুঝিয়া পাইতে সাহায্য করিয়াছে, এ কথা ঢাকার তরফে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করা হইয়াছে। এই নিষ্পত্তিকে দুই দেশের মৈত্রী ও বন্ধুত্বের জয় রূপেও শনাক্ত করা হইয়াছে। একই অবস্থান নয়াদিল্লিরও। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক ট্রাইবুনালের রায়কে পুরোপুরি স্বাগত জানাইয়াছে। বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়নে এই রায় বিপুলভাবে সহায়ক হইবে। ভারতের পক্ষেও ইহা সদর্থক ঘটনা, নয়াদিল্লি তাই ট্রাইবুনালের মধ্যস্থতার কোনও পর্যায়েই অসহযোগিতা করে নাই। দক্ষিণ ও পূর্ব চিন সাগরে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের সহিত সমুদ্রসীমা ও জলের উপর অধিকার লইয়া প্রতিবেশী সকল রাষ্ট্রের যে তীব্র বিবাদ চলিতেছে, তাহার নিরিখে ভারত-বাংলাদেশের এই বোঝাপড়া নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। চিন যে ভাবে বৃহৎশক্তি-সুলভ স্পর্ধায় নিজের সমুদ্রসীমা একতরফা ভাবে বাড়াইয়া চলিয়াছে, বিভিন্ন দ্বীপের উপর নিজের দাবি প্রতিষ্ঠা করিতেছে, তাহাতে সাম্রাজ্যবাদের ধ্রুপদী বিস্তারের যুগে ঔপনিবেশিক ধনতন্ত্রগুলির আচরণ স্মরণ হয়। সেই তুলনায় ভারত প্রতিবেশীর সহিত বিরোধ উদারতা ও সদিচ্ছার সহিত মিটাইতে উদ্গ্রীব, ইহাই এ বার প্রতিভাত হইল।
দুই দেশের স্থলভাগেও ছিটমহলগুলির বিনিময় এবং তিস্তা-সহ নদীগুলির জলবণ্টনের ক্ষেত্রেও পারস্পরিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রগুলিতে কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি নয়াদিল্লি যুক্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি লইতে ব্যর্থ। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অনমনীয় জেদ ও অসহযোগিতাই হয়তো তাহার কারণ। কিন্তু রাজ্যকে বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি সহানুভূতিশীল করা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে দ্বিপাক্ষিকতার ভূমিকা সম্পর্কে রাজ্য-প্রশাসনকে সচেতন করার দায়ও কেন্দ্রেরই। ইতিপূর্বে গঙ্গার জলবণ্টন লইয়া যখন মসৃণ চুক্তি ও বোঝাপড়া হইতে পারিয়াছে, তখন তিস্তার জলের ভাগ লইয়া জেদাজেদি মূর্খামি। ছিটমহল বিনিময়েও কাহার ভাগে কতটা জমি চলিয়া যাইতেছে, তাহা লইয়া মেঠো রাজনীতি করা নিতান্ত বালখিল্যতা। বঙ্গোপসাগরে যে-পরিমাণ জলভাগ বাংলাদেশকে দিতে হইবে, তাহার আয়তন প্রায় কুড়ি হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের এই রায় ঠেকাইবার সাধ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও নাই। তবে আর তিস্তা বা ছিটমহল লইয়া এত কুনাট্য কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy