দেখিতে দেখিতে ছয় বছর অতিক্রান্ত। দুই দুই বার গণভোটে সংবিধান পরিষদ নির্বাচিত। নেপাল আজও তাহার প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান পাইল না। কারণ সংবিধান পরিষদের সদস্যরা কিছুতেই ঐকমত্যে পৌঁছাইতে পারিতেছেন না। রাজনৈতিক বিরোধ, ব্যক্তিগত অহমিকা, গোষ্ঠীস্বার্থের দ্বন্দ্ব নূতন সংবিধান লইয়া ঐকমত্যের পথে প্রধান অন্তরায়। সময়সীমা এ বারও অতিক্রান্ত। তথাপি জনপ্রতিনিধিরা জনস্বার্থে একজোট নন। শুধু তাহাই নহে, সম্ভাব্য সংবিধান-প্রণেতাদের মধ্যে বিরোধ এমন জায়গায় পৌঁছাইয়াছে যে, সভাকক্ষের ভিতরে চেয়ার টেবিল ছুড়িয়া এবং বাহিরে বন্ধ-ধর্মঘট ডাকিয়া সংবিধান অনুমোদনের প্রয়াস বানচাল করার চেষ্টা চলিয়াছে। এক দিকে নেপালি কংগ্রেস ও মার্ক্সবাদীরা, অন্য দিকে মাওবাদী ও মধেসি পার্টির দ্বৈরথে সমগ্র নেপাল উত্তপ্ত। আন্দোলন ও বিদ্রোহের হুমকি এবং কড়া হাতে তাহা দমন করার সঙ্কল্প দেশময় আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কাও মূর্ত করিয়াছে।
বিরোধের মূলে রহিয়াছে প্রস্তাবিত সংবিধানের চরিত্র লইয়া মতান্তর। প্রথমত, শাসক গোষ্ঠী চাহে, শাসনব্যবস্থার যুক্তরাষ্ট্রীয় বিভাজনে যেন কোনও জনজাতীয় চরিত্র না থাকে, কেননা তাহা ভবিষ্যতে জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের আন্দোলনকে আস্কারা দিতে পারে। কিন্তু মাওবাদী ও মধেসি পার্টিগুলির দাবি, রাজ্যগুলির নামকরণ ও সীমানা-নির্ণয়ে নির্দিষ্ট জনজাতির চরিত্র ও চিহ্ন থাকা চাই। দ্বিতীয় দ্বন্দ্বের বিষয় শাসনপ্রণালী প্রেসিডেন্ট-শাসিত হইবে, না প্রধানমন্ত্রী-শাসিত। তৃতীয় বিরোধের বিষয় নির্বাচন-পদ্ধতি: প্রত্যক্ষ নির্বাচন, না আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করা। আর সর্বশেষ কাজিয়ার বিষয় বিচারব্যবস্থার চরিত্র: তাহা কি একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শীর্ষ আদালতের অধীন হইবে, না কি রাজ্যে রাজ্যে পৃথক আদালত তৈয়ার হইবে। শাসক গোষ্ঠী অর্থাত্ নেপালি কংগ্রেস ও মার্ক্সবাদীদের সংবিধান পরিষদে দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা রহিয়াছে, যাহা প্রস্তাবিত সংবিধান অনুমোদন করাইবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু বিরোধীরা হুমকি দিতেছেন, গরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান অনুমোদন করাইলে তাঁহারা রাস্তার আন্দোলনে অচলাবস্থা সৃষ্টি করিবেন। ঐকমত্য ঘটিলে ভাল, কিন্তু ঐকমত্য গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত নয়, বহুমতই পূর্বশর্ত। সংবিধান পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেই বহুমতকে মর্যাদা দিতে নারাজ।
উভয় পক্ষের জনপ্রতিনিধিরাই কিন্তু রাজতন্ত্র বা রানাতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের বিরোধী। বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে নেপালের পরিচিতিও তাঁহারা রদ করিয়াছেন। প্রাসাদ ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম এক দিকে যেমন একটি নবীন প্রজাতন্ত্র অর্জনের লক্ষ্যে চালিত হইয়াছিল, অন্য দিকে সেই প্রজাতন্ত্রকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের অভিমুখে চালনার শপথও গৃহীত হইয়াছিল। সেই আন্দোলনমুখর উদ্দীপনা এখন অবসিত। রাজতন্ত্র পরাস্ত, অথচ নূতন তন্ত্রের প্রবক্তারা দেশের জন্য একটা সর্বসম্মত সংবিধান ছয় বছর ধরিয়া বানাইতে পারিতেছেন না। এই অচলাবস্থা সুশাসন কায়েমের পথে অন্তরায় হইতেছে, তাহার অর্থনীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রকল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করিতেছে। অন্য দিকে রানাতন্ত্রের অবশেষগুলিকে ঐক্যবদ্ধ হইতে উত্সাহিত করিতেছে। রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির রানাপন্থী রাজনীতিকরা বর্তমান শাসকদের ঝগড়াঝাঁটি ও অযোগ্যতা তুলিয়া ধরিয়া রাজতন্ত্রের স্থিতিতে ফিরিবার পক্ষে সওয়াল করিতেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy