Advertisement
১১ মে ২০২৪

স্বামীজির ভারতস্বপ্নকে সফল করতেই এখন প্রয়োজন নিবেদিতাচর্চার

নিবেদিতা ভারতবর্ষে এসে দর্শন পেলেন শ্রীমা সারদাদেবীর। তাঁর সঙ্গে দেখা না হলে ভারতীয় নারীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সম্বন্ধে নিবেদিতার কোনও ধারণাই জন্মাত না। ভারতবর্ষ যে সীতা-সাবিত্রীর দেশ, নিবেদিতার কোনও সন্দেহই থাকে না সারদাদেবীর সান্নিধ্যে আসার পর। নিবেদিতার কথায়, “আমার সব সময়েই মনে হয়েছে, ভারতীয় আদর্শ রমণী হিসাবে মা সারদাই শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবনার শেষ কথা। কিন্তু তিনি কি প্রাচীন ঐতিহ্যের শেষ উদাহরণ, না কি নতুন যুগের সূচনা।”

স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

নিবেদিতা ভারতবর্ষে এসে দর্শন পেলেন শ্রীমা সারদাদেবীর। তাঁর সঙ্গে দেখা না হলে ভারতীয় নারীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সম্বন্ধে নিবেদিতার কোনও ধারণাই জন্মাত না। ভারতবর্ষ যে সীতা-সাবিত্রীর দেশ, নিবেদিতার কোনও সন্দেহই থাকে না সারদাদেবীর সান্নিধ্যে আসার পর।

নিবেদিতার কথায়, “আমার সব সময়েই মনে হয়েছে, ভারতীয় আদর্শ রমণী হিসাবে মা সারদাই শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবনার শেষ কথা। কিন্তু তিনি কি প্রাচীন ঐতিহ্যের শেষ উদাহরণ, না কি নতুন যুগের সূচনা।”

শ্রীমা সারদা তখন ১০/২ বাগবাজারের বোসপাড়া লেনের বাড়িতে থাকতেন। এই বাড়িরই কিছু দূরে বাগবাজার অঞ্চলের ১৬ নং বোসপাড়া লেনে, যেখানে আমরা পেয়েছিলাম স্বামীজির আদর্শে তথা আগুনে একাধারে তেজোময়ী তথা শিখাময়ী ভারতপ্রেমিকা নিবেদিতাকে, এখানেই আবার দেখেছি শুচিশুদ্ধা ভক্তিমতী পূজারিণী এক মহিলাকে, যিনি মনেপ্রাণে ভারতমাতার সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ-সঙ্ঘজননী সারদামাতাকে বরণ করে নিয়েছিলেন ভারতীয় নারীদের আদর্শের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনরূপে। স্বামীজির কথায় নিবেদিতা মেয়েদের নিয়ে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যার দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন মা সারদামণিই। সে দিন নিবেদিতার কী উৎসাহ-উদ্দীপনা স্বামীজি প্রদত্ত-ব্রত উদযাপনের সাফল্য দেখে! বাংলাদেশে সাধারণ গৃহস্থ মেয়েদের মধ্যে (যাদের মধ্যে বিবাহিত নারীও ছিলেন) স্ত্রীশিক্ষার সেই সূত্রপাত। সেই বিদ্যালয়ে ১৬নং বাড়িতে থাকাকালীনই নিবেদিতা পূজারিণী রূপে সরস্বতী পূজার দিন লালপেড়ে শাড়ি পরে বাড়ি বাড়ি পূজা দেখে বেড়াতেন। শুভ্রসমুজ্জল এক বিদেশিনি নারী বিবেকানন্দের টানে তথা মনীষার আগুনে শিখাময়ী হয়ে ভারতের শুধু স্ত্রীশিক্ষা ক্ষেত্রে নয়, তার প্রাচীন ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের জন্য শিল্পভাস্কর্য ও সংস্কৃতিতে চতুর্দিকেই আলোকিত করে বেড়িয়েছেন, সেই শিখাময়ীর আলোকের স্নিগ্ধ ঝর্নাধারায় এসে অভিস্নাত হয়েছেন সে যুগের প্রায় সব মনীষীই। রবীন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী ঋষি অরবিন্দ, গোখলে প্রমুখ। আর বিজ্ঞানজগতের স্বনামধন্য আচার্য জগদীশচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী লেডি অবলা বসু তো ছিলেন নিবেদিতার ঘরের মানুষ, সন্তানের মতো। তাঁদের কাছে নিবেদিতা ছিলেন হিমালয়কন্যা হৈমবতী-উমার মতো। বিজ্ঞানীর বিজ্ঞানমনস্কতাকে শাসক ইংরেজ সরকার বার বার বাধা দিয়েছে তাঁর নিত্য নূতন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে, সেখানে আর কেউ এগিয়ে না এলেও ভগিনী নিবেদিতা জ্বলে উঠেছেন ভারতমাতার এই কৃতী সন্তানকে রক্ষা করার জন্য তাঁকে উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে। সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র বহু বারই হিমালয়ে এসেছেন নিবেদিতার সঙ্গে, এবং হিমালয়ের ওপর তাঁর কয়েকটি লেখা এই হিমালয় ভ্রমণেরই ফল বলে মনে হয়।

নিবেদিতার চিঠিতে পাওয়া যায়— ‘বিবাহিতা মেয়েরা গৃহের বাহিরে আসিতেছেন। এই ঘটনা (এ দেশের) ইতিহাসে এই প্রথম, ‘ক্রিস্টিনের’ (নিবেদিতা বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষিকা) ছাত্রী-সংখ্যা কুড়ি থেকে ষাট... আমার কাছে যারা ট্রেনিং নিতে আসে, এই বিদ্যালয়েই তারা পাঠ দেওয়া অভ্যাস করে। অন্তঃপুরিকাগণ ইউরোপীয় মহিলার গৃহে শিক্ষালাভ করছে, এ একেবারে অশ্রুত ব্যাপার কিন্তু একদিনের জন্যও এ পর্যন্ত কোনও অসুবিধা হয়নি। (চিঠিটি ২৬/৭/১৯০৪, লিজেল রেমঁ সংকলিত)।

এ একেবারে প্রাচীন মতে গুরুকুল শিক্ষা। নিবেদিতা নিতেন সেলাই ও আঁকার ক্লাস। পরে ইতিহাস ও ইংরেজি পড়াতেন। নিবেদিতার জীবনীকার বলেন, ‘প্রতিদিন বিদ্যালয় প্রারম্ভের পূর্বে বালিকারা ঠাকুর দালানের টেবিলের উপর শ্রীরামকৃষ্ণের সুসজ্জিত প্রতিকৃতির সম্মুখে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান ও প্রণামপূর্বক সমবেত কণ্ঠে নানাবিধ স্তব পাঠ করিত। তখন বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট কোনও নাম ছিল বলিয়া জানা যায় না। স্থানীয় লোকেরা সিস্টার নিবেদিতার স্কুল বলিত। নিবেদিতা তাঁহার পরিকল্পনায় উহাকে ‘রামকৃষ্ণ গার্লস স্কুল’ নামে অভিহিত করেন। পাশ্চাত্যবাসী কেহ কেহ বিবেকানন্দ স্কুল বলিতেন। নিবেদিতার দেহত্যাগের পরে শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনের অন্তর্ভুক্ত হইলে উহার নাম হয় শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুল। (প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা)।

ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে কত দিন আগে, নিবেদিতার মনে হয়েছিল ভারতে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা। তেজস্বিনী এই সন্ন্যাসিনী অনুভব করেছিলেন, রক্ষণশীলতার আগড় ভেঙে মেয়েদের প্রকৃত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা না গড়ে তুলতে পারলে সমাজের স্থবিরত্বই ঘুচবে না। স্বামীজি তাঁর বিভিন্ন লেখায়, অজস্র চিঠিতে বার বার বলেছেন নারীশিক্ষার কথা। শিষ্যা নিবেদিতা স্বামীজির সেই স্বপ্নকে সফল করার অঙ্গীকার নিয়েই নীরব বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন বাগবাজারের এক এঁদো গলি থেকেই। সমাজের রক্তচক্ষুর পরোয়া না করে, শতজনের কটুবাক্য অগ্রাহ্য করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তিনি নিজে সংগ্রহ করেছেন এক জন এক জন করে ছাত্রী, এর মধ্যে কয়েক জন ছিলেন স্বামীহীনা নারীও। সে কালের রক্ষণশীল সমাজে এই কাজ করতে কী পরিমাণ সাহস ও মনের জোর প্রয়োজন আজকের দিনের নারীরা তা কল্পনাতেও আনতে পারবেন না। সে আমলে সিংহিনীর মতো বিক্রমে নারীশিক্ষার যে চারাগাছটি তিনি রোপণ করে গিয়েছেন, তাই বহু দিন পরে রূপ নিয়েছে ‘সিস্টার নিবেদিতা গার্লস স্কুল’-এ, যা আজ কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যানিকেতন হিসাবে স্বীকৃত।

নিবেদিতার অনুরাগীদের কাছে এটাও অবশ্যই এক সুসংবাদ যে, স্বামী বিবেকানন্দের জন্মের সার্ধশতবার্ষিকী পালনের বিবিধ কর্মসূচির মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভগিনী নিবেদিতার পূণ্যস্মৃতিবিজড়িত দু’টি বাড়ি অধিগ্রহণ করে তুলে দিয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে। এর একটি কলকাতার বাগবাজারে বোসপাড়া লেনে, অন্যটি দার্জিলিং শহরে ‘রায়ভিলা’। এই ‘রায়ভিলা’য় নিবেদিতা বেশ কয়েক বারই বাস করেছেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র ও তাঁর পত্নী অবলা বসুর সঙ্গে।

বিবেকানন্দ-আদর্শে উৎসর্গীকৃত ও এক বিদেশাগত নারীর ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ও শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নতির জন্য তিল তিল করে আত্মত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত এর আগে আছে কি? কিন্তু তাঁর মহাপ্রয়াণের একশো বছর পরেও অতি প্রিয় শিক্ষাকেন্দ্র তাঁর বাসস্থানটি নিবেদিতার স্মরণে-মননে-গবেষণার এক স্মৃতিসৌধ হয়ে না ওঠা বাংলা তথা সমগ্র ভারতের এক লজ্জার বিষয় ছিল। নিবেদিতার সেই বাড়ি অধিগ্রহণের পরে লজ্জামোচন হল। বিবেকানন্দের আহ্বানে ভারতবর্ষে এসে সারা জীবন নিবেদিতা ভারতবর্ষ ও ভারতবাসীর জন্য নিঃশেষে দিয়ে গিয়েছেন। বিনিময়ে প্রত্যাশা করেননি কিছুই। নিজের জীবনযৌবন সবই ছিল তাঁর ভারতবর্ষের জন্য এবং এই ভাবেই তাঁর নিবেদিতা নাম সার্থক হয়ে উঠেছিল। অন্য দিকে তিনি ভারতবর্ষের মানুষকে সেবা করে ‘লোকমাতা’ হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কাছে। একজন বিদেশিনি নারী সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে সেই দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতির জন্য এমন আত্মত্যাগের কতটুকু মূল্য দিয়েছি আমরা?

নিবেদিতার জীবন, চিন্তা ও কর্ম সম্বন্ধে অনেক কিছুই ভারতবাসীর অজানা। সারা জীবনে অজস্র চিঠি লিখেছেন স্বামীজির এই মানসকন্যা। শুধু সেই চিঠিগুলিই নিবেদিতাকে নিয়ে গবেষণায় নতুন আলোকপাত ঘটাতে পারে। স্বামীজি ও নিবেদিতাকে নিয়ে অক্লান্ত গবেষণায় জীবনপাত করে গিয়েছেন কিছু কাল আগে প্রয়াত শঙ্করীপ্রসাদ বসু। তিনি আর নেই, কিন্তু নিবেদিতা-চর্চায় গবেষণার প্রয়োজন ফুরোয়নি। উপযুক্ত গবেষকের হাতে পড়লে ওই চিঠিগুলি শুধু শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব আন্দোলনে নয়, ভারত-ইতিহাসেও নতুন অধ্যায় উন্মোচিত করতে পারে। এ এক অনন্ত গবেষণার উন্মুক্ত ক্ষেত্র।

নিবেদিতা গবেষণায় অমূল্য কিছু চিঠি বিশিষ্ট সাধু অনির্বাণ তুলে দিয়েছিলেন শঙ্করীপ্রসাদের হাতে। (অনির্বাণ তা পেয়েছিলেন ফরাসি লেখিকা লিজেল রেমঁর কাছ থেকে।) চিঠিগুলি হস্তান্তরের সময় সাধু অনির্বাণ বলেছিলেন, “বিবেকানন্দকে না জানলে যেমন বাংলার তপঃশক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না, তেমনই নিবেদিতাকে না জানলে স্বামীজির ভারতস্বপ্নকে জানা যায় না।”

ভগিনী নিবেদিতার ১৪৮তম জন্মদিনে তাঁকে শুধু স্মরণ নয়, প্রতিটি ভারতবাসীর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া উচিত সেই ভারতস্বপ্নকে সফল করার জন্য। আর এ জন্যই প্রয়োজন আরও অনেক বেশি করে নিবেদিতা-চর্চার।

(পুনঃপ্রকাশিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

swami debendrananda sister nivedita
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE