সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবমকে কেরলের রাজ্যপাল নিযুক্ত করার প্রস্তাব লইয়া যে বিতর্ক শুরু হইয়াছে, তাহা অমূলক নয়। সদাশিবম মাত্র চার মাস পূর্বে দেশের প্রধান বিচারপতির সাংবিধানিক পদ হইতে অবসর লইয়াছেন। ইহারই মধ্যে তাঁহাকে একটি প্রদেশের প্রশাসনিক আধিকারিকের পদে নিয়োগ করা তাঁহার পক্ষে যেমন মর্যাদাপূর্ণ নহে, তেমনই নরেন্দ্র মোদী সরকারের পক্ষেও অশোভন। সদাশিবমের পক্ষে এই নিয়োগ সম্মানজনক নয়, কারণ তাঁহাকে অতঃপর তাঁহার চেয়ে পদমর্যাদায় ছোট একজন বিচারপতির কাছে রাজ্যপালের শপথ লইতে হইবে, যাঁহাকে হয়তো তিনি নিজেই পূর্বে নিয়োগপত্র দিয়াছিলেন। তা ছাড়া, এখন হইতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে তিনি জবাবদিহি করিতে বাধ্য থাকিবেন। আর মোদী সরকারের পক্ষে ইহা শোভন নয়, কারণ মোদী যে স্বচ্ছ প্রশাসন দেশবাসীকে উপহার দিবার প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, এই ধরনের নিয়োগ তাহার উপর সংশয়ের ছায়া ফেলিবে।
এমন নয় যে, এই ধরনের নিয়োগে সংবিধানের কোনও নির্দিষ্ট বাধা আছে। কিন্তু নৈতিকতা ও বৈধতার প্রশ্নটি উপেক্ষণীয় নয়। কেননা এই ধরনের নিয়োগ বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে জনসাধারণের ভরসা হ্রাস করিতে পারে। নিরপেক্ষতার সহিত দূরবর্তিতার একটি গভীর সম্পর্ক আছে। বিচারপতির পদে এক বার বসিবার পরে নিজেকে রাজনীতি বা প্রশাসন হইতে দূরে রাখিবার রীতি সেই দূরবর্তিতার নীতিকে সম্মান জানায়। সেই প্রেক্ষিতেই ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতিকে রাজ্যপাল করার এই প্রয়াস মোদী সরকার এড়াইয়া যাইতে পারিত। সত্য, এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটিতেছে, এমন নয়। ইতিপূর্বে অবসরপ্রাপ্ত সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি এম ফতিমা বিবি তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল নিযুক্ত হইয়াছিলেন। একই ভাবে অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এম এস গিলকেও মনমোহন সিংহের সরকার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিয়োগ করে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তগুলিও নীতির মাপকাঠিতে ভুল ছিল। পূর্ববর্তী সরকার ভুল করিয়াছে বলিয়াই বর্তমান সরকারেরও সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করার অধিকার আছে, ইহাও কোনও যুক্তি হইতে পারে না।
মোদী সরকার ইহার আগেও টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূতপূর্ব আধিকারিক নৃপেন্দ্র মিশ্রকে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি নিয়োগ করিতে ভারতীয় টেলিকম নিয়ামক কর্তৃপক্ষ আইনটিই সংশোধন করে এবং যত দিন তাহা না হইতেছে, তত দিন অর্ডিন্যান্স জারি করিয়া অভিপ্রায় সিদ্ধ করা হয়। সেই সময়েও তর্ক উঠিয়াছিল। সেই আপত্তিও একই কারণে সঙ্গত ছিল। এই সব ঘটনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদীর অনভিজ্ঞতার ফল কি না, জানা নাই। তবে এগুলি যে শাসন পরিচালনার সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি আয়ত্ত করিতে না-পারারই পরিণাম, এমন ধারণার যথেষ্ট কারণ আছে। অনভিজ্ঞতা কিন্তু অস্বচ্ছ প্রশাসনের কোনও কৈফিয়ত নয়, কেননা প্রধানমন্ত্রীকে এই সব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও অভিজ্ঞতাঋদ্ধ মতামত জানাইবার মতো লোকের অভাব ভারতীয় আমলাতন্ত্রে নাই। মোদী সরকারের একশো দিনের কৃতকর্মের আলোচনায় স্বভাবতই তাঁহার শাসন পরিচালনার পরিবর্তিত ভঙ্গি এবং সক্রিয় ও তৎপর প্রশাসন, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃঢ়তা ইত্যাদি বিষয়ে দেশব্যাপী আলোচনা চলিতেছে। সেই আলোচনাতেও শাসনপদ্ধতির এই ত্রুটিগুলি উঠিয়া আসিতেছে। আশা করা যায়, প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যতে এগুলি সংশোধন করিতে যথোচিত মনোযোগ দিবেন। প্রশাসন সম্পর্কে সমাজের ধারণা কী রূপ, তাহাও তুচ্ছ করিলে চলিবে না। কেবল সুশাসনই যথেষ্ট নয়, তাহার পদ্ধতিও যথাযথ হইতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy