Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

আধুনিক মানুষের পাপপুণ্যের দেড়শো বছর

কী  আশ্চর্য! এই পৌষে আমাদের আধুনিক মানুষের পাপ ও পুণ্যের দেড়শো বছর পার হয়ে গেল। ১৮৬৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ফিয়োদর দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ নামের ধারাবাহিক উপন্যাসের শেষ কিস্তি প্রকাশিত হয়।

ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট

ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:১৩
Share: Save:

কী আশ্চর্য! এই পৌষে আমাদের আধুনিক মানুষের পাপ ও পুণ্যের দেড়শো বছর পার হয়ে গেল। ১৮৬৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ফিয়োদর দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ নামের ধারাবাহিক উপন্যাসের শেষ কিস্তি প্রকাশিত হয়। অনেক ভয়ের দিন, রক্তপাত, গৃহদাহ পার হয়ে দেখি, সর্বনাশের সমুদ্রে ইতিহাস সামান্য মানুষের জন্য পরিত্রাণের একটি ভেলা ভাসিয়ে দিয়েছে। এই গ্রহে মানুষ যত দিন বেঁচে থাকবে, স্বর্গে বা রসাতলে যাবে, এই গ্রন্থ তার সঙ্গী হবে ধর্মের কুকুরের মতো। ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ শুধু মহৎ সাহিত্য নয়, এমন এক সাংস্কৃতিক সন্দর্ভ, ফ্রয়েড হয়তো বলবেন— ‘সেটিং আপ অ্যান এজেন্সি উইদিন দ্য সেলফ টু ওয়চ ওভার ইট লাইক আ গ্যারিসন ইন আ কংকার্ড সিটি’। এই আখ্যানের নায়ক রাসকলনিকভ সেন্ট পিটার্সবুর্গের নিরানন্দ আস্তানা থেকে শুঁড়িখানায়, হত্যায় ও সাইবেরিয়ার কারাযাপনে পাপিষ্ঠ ও পুণ্যাত্মা, নিষ্ঠুর ও দয়ালু, বেপরোয়া, নিরীশ্বর, আলাদিনের প্রদীপ দখল করার জন্য উন্মাদ যে কোনও মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। নেপোলিয়ন হওয়ার উচ্চাশায় সে আদর্শের দোহাই দিয়ে তলিয়ে যায়, আর জীবন যখন শুকায়ে যায় হঠাৎ এক বিন্দু অলৌকিকতা হয়ে করুণাধারায় তার হাত ধরে দেহপসারিনি এক কিশোরী— সনিয়া। ক্রুসেড আর জেহাদ, আউসভিৎজ ও হিরোশিমা, ভিয়েতনাম, দাঙ্গা ও হাহাকার: পৃথিবীর যাবতীয় অপরাধ ও পতন সংহত হয়ে আছে জার-শাসিত রাশিয়ার প্রধান শহরের মলিন, বিবর্ণ এক ঘরের তেইশ বছর বয়সি বাসিন্দার মনোবিকারে। ভাগ্যিস দূতসভায় পরাভূত যুধিষ্ঠিরের মতো দস্তয়েভস্কি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন জুয়ার টেবিলে! শূন্যতাকে অন্তিম পর্যন্ত না জানলে লেখকের ভাষাও স্বর্গারোহণের ঝুঁকি নিতে পারত না।

তাঁর প্রতিভা ও মনীষার বিচ্ছুরণ ঈশ্বরতুল্য, সন্দেহ নেই, কিন্তু দস্তয়েভস্কির কোনও রচনাতে গদ্য এত মসৃণ ও অব্যর্থ নয়। যেন রূপসীর ত্বক! কী ছিলা-টানটান কাহিনি! আর কী অনায়াসে মেলোড্রামা ও রহস্যোপন্যাসের সামান্য দুনিয়া ছেড়ে সে পাখা মেলে দেয় মহাকাশে! অথচ কী অকিঞ্চিৎকর এই গল্প; ভুল ক্ষমতালিপ্সা— আপাতভাবে হত্যা ও সন্তাপের নুড়িপাথর এ লেখার পাতায় পাতায়। রচনা সংগঠন জ্যামিতিক, চিত্রনাট্যপ্রতিম, তবুও ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ ডিটেকটিভ গল্পের চতুরালি এড়িয়ে হয়ে উঠেছে নির্যাতিত আত্মার পাণ্ডুলিপি। আর এই জন্যেই ফ্রাঁসোয়া ক্রুফো-র সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় আলফ্রেড হিচকক মেনে নেন, মহত্তম পর্যায়ের এই আখ্যান নিয়ে ছবি করার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না। কেননা, তার সিনেমা প্রতিতুলনায় ফ্যাকাসে দেখাবেই।

আর নেহাতই খুনের তদন্ত করা দস্তয়েভস্কির উদ্দেশ্য নয় মোটেও। গোয়েন্দা গল্পের যুক্তি অনিয়মকে সুনিয়ন্ত্রিত দেখতে চায়। ঈশ্বরের অনুপস্থিতিতে অধঃপতনের সীমাহীন রেখাচিত্রে, শহরজীবনে, গোয়েন্দা যুক্তিপরায়ণতার অন্তিম প্রতিনিধি। পৃথিবীর যে কোনও ডিটেকটিভ যুক্তির দ্বারা শাসিত ও বিধাতার দূত, কারণ সে রহস্যের অন্ত দেখতে পায়। আর দস্তয়েভস্কি দার্শনিক বলেই নায়কের হৃদয়ে অমরাবতী ও নরককে যুগপৎ সংশয়দীর্ণ দেখেছেন। বস্তুত, তাঁর যুবকটির যন্ত্রণার ভিত্তি আইনের তর্জনী ততটা নয়, যতটা বিবেকের পাহারা। যে পদ্ধতিতে সে সুদখোর মহিলাটিকে খুন করে, তাতে প্রমাণের দাগ পর্যন্ত ছিল না, কিন্তু আত্মায় একটি কাঁকরদানা তাকে রেহাই দেয় না। যুগপৎ কুঠার ও ক্রশচিহ্নের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হতে হতে রাসকলনিকভ একই সঙ্গে ধারণ করে রাখে আততায়ীর হিংস্রতা ও দণ্ডিতের অসহায়তা। একটি কিশোরীর পদপ্রান্তে আছড়ে পড়ে সে আবিষ্কার করে মানুষের যন্ত্রণার সারাৎসার।

এই তেইশ বছরের তরুণীটিকে আমরা সত্তর দশকের কলকাতায় ছুটে যেতে দেখেছি শ্রেণিশত্রুর খোঁজে। সশস্ত্র যে যুবক পরলোকের নামে, রাজনীতির নামে ছোট হিংসার সন্ত্রাসকে প্রাণের আশ্বাসবায়ু ভাবছে, সে— তারা প্রত্যেকেই— বিমূঢ় রাসকলনিকভ হয়তো। কখনও নেপোলিয়ন, কখনও লাল বই, কখনও বা অন্য কোনও ফতোয়া তাকে আলেয়ার মতো পথ দেখায়। নরকের এই নবজাত মেঘকে দস্তয়েভস্কি শনাক্ত করেছিলেন। তাই দূরতম বন্দিশালায়, মহাপ্রস্থানের পথে একাকী যুধিষ্ঠিরের মতো, পাতালের চিরকুট হাতে তুলে নিতে হল তাঁর নায়ককে। সাধারণ লেখক স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়েই গল্পে ছেদ টানবেন। কিন্তু দস্তয়েভস্কি একটি উপসংহার পেশ করেছেন, যাকে আত্মার পানীয় বলা যেতে পারে। হয়তো এই অতিরিক্ততা সাহিত্যের বিচারে খানিকটা চাঁদের কলঙ্ক। মিখাইল বাখতিনের মতো তাত্ত্বিকেরা এই ত্রুটিটুকুর উল্লেখও করেছেন। কিন্তু অতিশয়োক্তির এই টুকরো আবার উপন্যাসটিকে তুলে নিয়ে গেছে দর্শনের দূরতম শিখরে। দস্তয়েভস্কি যে অপরাধের কথা বলেন, তা হত্যা থেকে শুরু হয় না, আদালতে তার পরিসমাপ্তিও ঘটে না। রাসকলনিকভ যদি অন্তরের কুয়াশা না দেখতে পেত, তবে তা এমন অপার্থিব হয়ে উঠত না। মনুষ্যপ্রজাতির সৌভাগ্য, কারামাজভ ভাইদের কথা বলতে গিয়ে দস্তয়েভস্কি ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর প্রখ্যাত সংলাপসমূহ লেখেন বা এক জন কারাবন্দির হাতে তুলে দেন নব টেস্টামেন্ট। সামান্য প্রগতি বা প্রতিক্রিয়ার চোখ দিয়ে শব্দের এই শরশয্যার ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়।

লেখক পথের মোড়ের প্রবক্তা বা চন্দ্রাহত কিন্নর নন, নির্বিকল্প দ্রষ্টা। দস্তয়েভস্কি জানতেন যে সভ্যতা জননীর মৃত্যুদিন ভুলে যায়, যে বধ্যভূমিতে মানবপুত্র কারণ না জানতে চেয়েই শাস্তির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন, আতঙ্ক আর আচ্ছন্নতায় যে জড়বস্তুর মতো সময়ের ভার বহন করে, সেখানে তাকে এমন উপাখ্যান শোনাতে হবে, যাতে মৃত্যু থেকে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত। তাই রাসকলনিকভের সৌজন্যে আমরা লাজারাসের গল্প শুনি আর প্রাচ্য দেশের আমরা নচিকেতা হয়ে ফিরে আসি যমলোক থেকে। ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থায় সেই তীর্থযাত্রার বিবরণ, যাতে মানুষ, পাপাতুর ও সন্দিগ্ধ উত্তরকাল, জানতে পারে, কেন এ জীবন। দেড়শো বছর আগে একটি খুনি জনৈকা পণ্যা তরুণীর পাণ্ডুর মুখে তাকিয়ে ‘মুক্ত’ হয়েছিল, আজও সনিয়ার ‘অকৃপণ কর’ রাষ্ট্র, দেবালয় ও সংস্থার পরপারে পুনরুত্থানের এক সুসমাচার। এই বই আছে বলেই গাঁধী থেকে গোপাল সেন পর্যন্ত যাবতীয় স্মরণস্তম্ভের দিকে তাকালেই মনে হয়, হৃদয় অবধি যায়নি ছুরি থমকে আছে কোথাও।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE