Advertisement
১৯ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

রমনা বটমূলে পঞ্চাশ বছর

বু দ্ধদেব বসুর স্মৃতিগদ্যে ঢাকার রমনা উদ্যানের অনুপম বর্ণনা পড়েছি অনেকেই। নিরঙ্কুশ সবুজে ছাওয়া এই উদ্যানের বটমূল এখন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

পিয়াস মজিদ
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বু দ্ধদেব বসুর স্মৃতিগদ্যে ঢাকার রমনা উদ্যানের অনুপম বর্ণনা পড়েছি অনেকেই। নিরঙ্কুশ সবুজে ছাওয়া এই উদ্যানের বটমূল এখন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৬৭ সালে ‘ছায়ানট’ নামে এক সাংস্কৃতিক সংগঠন রমনা বটমূলে বাংলা নতুন বছর আহ্বানের যে ধারা তৈরি করে তা নেহাত সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি; পঞ্চাশ বছরের ধারাবাহিকতায় হয়ে উঠেছে বাঙালির এক নম্বরের অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসব। আজ বিশ্বজোড়া বাঙালি জানে পহেলা বৈশাখ মানে আরও অনেক কিছুর পাশাপাশি রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবও। কোনও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত অগণিত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বাংলা নতুন বছরের প্রথম প্রভাত যেন সব গ্লানি-জরা দূর করার আকুলতা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ঋতুকেন্দ্রিক, আত্মশক্তি-উদ্বোধক, দেশাত্মবোধক, কর্মোদ্দীপক এবং গণচেতনাময় সংগীতের মাঙ্গলিক ধ্বনিতে রমনা বটমূল মুখর করে তোলে বাঙালি চেতনার মনোমঞ্চ।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে। ১৯৬৭ সালে ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় আদর্শবিরোধী কবি, তাই তাঁর গান নিষিদ্ধ হওয়া দরকার’ — পাকিস্তানের তথ্যপ্রচারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের এই ঘোষণার প্রতিবাদে বাংলার কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। যে বাঙালিত্বের বোধকে পাকিস্তান তার ‘অখণ্ডতা’ রক্ষার পথে বাধা বলে মনে করে দমন করতে চেয়েছিল, বাঙালি সেই বোধকে বুকে নিয়েই হেঁটেছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বৈশাখ-বর্ষাকে সঙ্গে নিয়ে হাজার বিরোধিতার মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতিক চেতনা বিকশিত হতে থাকল।

১৯৬৩-তে অর্থাৎ বাংলা ১৩৭০-এর পহেলা বৈশাখ ঢাকায় যে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের যাত্রা শুরু, প্রতিষ্ঠার বছর চারেকের মধ্যেই সে সংগঠন ১৯৬৭-তে রমনার বটমূলে সূচনা করল বর্ষবরণ উৎসব। ভোরসকালের শারদোৎসব, সন্ধ্যারাত্রির বসন্তোৎসব তো বাঙালির অভিজ্ঞতায় ছিল; বৈশাখবরণের এ উৎসব সৃষ্টি করল নতুন ঐতিহ্য। ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন লিখেছেন, ‘‘খোলা মাঠে গান হয় না বলে বিজ্ঞ সঙ্গীতজ্ঞেরা আমাদের নিরুৎসাহ ও নিরস্ত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমরা জানতাম এ দিনের গান কেবল গাইবার আনন্দে গাওয়া! কেউ শুনল কিনা তা আমাদের গ্রাহ্য করবার দায় নেই। নববর্ষ-সম্মিলন হচ্ছে সরবে। পাকুড় গাছের পাতা দুলিয়ে বইছে প্রভাতের ঝিরি ঝিরি বাতাস। সমবেত কণ্ঠে গাইছি ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে’, প্রচলিত ধর্মাচরণের কোনওই স্পর্শ নেই, তবুও সঙ্গীতের সংবেদন মনকে আশ্চর্য ভক্তিমাখা আনন্দরসে আপ্লুত করেছে এই প্রভাতে! সূর্য অন্ধকারকে বিদূরিত করে। মানুষ আলোর পিয়াসী। আমরা আলোকের ঝরনাধারায় অন্তরকে ধুয়ে নিতে চেয়েছি, অন্তরের যে ধূলার আস্তরণ তা মোচন করতে চেয়েছি, একে কোনও বিশেষ মতের ধর্মাচরণ বলে জানি না, মানি না। মানবসমাজের অভিসার তো আলোর অভিমুখেই। এর জন্য বিশেষ কারও বন্দনা করবার প্রয়োজন দেখি না। আপন আত্মাকেই আমরা বলতে চাই জাগো উদ্ভাসিত হও।’’ (সন্জীদা খাতুন: প্রবন্ধসংগ্রহ, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা ২০১০)

বর্ষবরণ উৎসবের পথে পথে পাথর ছড়ানো। পাকিস্তানি আমলে তো বটেই, স্বাধীন বাংলাদেশেও সামরিক স্বৈরশাসকদের সাংস্কৃতিক নীতিগত বৈরিতা তুচ্ছ করে বছর-বছর এই উৎসব করতে হয়েছে ছায়ানটকে। ২০০১ সালে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ মঞ্চে যখন চলছিল নজরুলের ‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী’ গানটি ঠিক তখনই মৌলবাদীদের ভয়ঙ্কর বোমা বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হল চারদিক। দশ জন মানুষের প্রাণ গেল। কিন্তু পরের বছরই সংস্কৃতিবিরোধী এই সন্ত্রাসকে ধিক্কার দিয়ে মানুষ আবার বিপুল উৎসাহে সমবেত হল রমনায়। সকল কাঁটা ধন্য করে ফুল ফোটার মতোই বটমূলে ঘোষণা করল চিরনূতনের বার্তা।

এই বর্ষবরণ উৎসব কেবল একটি স্থবির রীতি নয়। সময়ের সঙ্গে তার প্রভাব ছড়িয়েছে দিগ্বিদিকে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষাশহিদ স্মরণে ঢাকার শহিদ মিনারের আদলে যেমন গ্রামে গঞ্জে গড়ে উঠেছে অসংখ্য শহিদ মিনার, তেমনই রমনার প্রভাত উৎসবের আদলে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে চালু হয়েছে বর্ষবরণ উৎসব। বৃক্ষের সহিষ্ণুতা আর বিকাশের বার্তা যেন ছড়িয়েছে কেন্দ্র থেকে প্রান্তের দিকে। ২০১৭ সালের পহেলা বৈশাখের প্রভাতে রমনা বটমূলে আবার বসবে অর্ধশতাব্দীর ঐতিহ্যে লালিত এই উৎসব। সম্মেলক কণ্ঠে আবার ধ্বনিত হবে ‘তাপসনিঃশ্বাসবায়ে সব মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে।’ উপমহাদেশ জুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক অসহনশীলতা আর বিভাজনের বিরুদ্ধে সংগীতের সুরে উচ্চারিত হবে সামষ্টিক শাণিত প্রত্যয়। পঞ্চাশ বছরের প্রথা এই গান-উৎসব জ্বেলে দিয়ে যাবে আলোর দীপ।

ঢাকার বাংলা একাডেমির গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ramna Batamul Buddhadeb Bosu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE