উ দাসীন সমাজের স্বার্থপরতার পরিসরে যে ছেলেমেয়েদের হারিয়ে যাওয়া ছিল ভবিতব্য, তাদের পাশে থেকে অমূল্য জীবনের মানে ধরিয়ে দিয়েছিল একটি অসরকারি সংস্থা। বাঁচতে শিখিয়েছিল তাদের, মূল স্রোতের প্রতিস্পর্ধী হয়ে। এ বারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে ‘হোম’-এ থাকা এই ছেলেমেয়েরা আরও নানা নজির সৃষ্টির অপেক্ষায়।
ভোলানাথ রায়। সকলের কাছে ‘ভোলা’। বয়স বছর উনিশ। ফুটবলপাগল। সমস্ত ধরনের প্রতিকূলতার মোকাবিলায় অনাবিল হাসির ফোয়ারা তার মুখে। এ বারেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করল ‘ভোকেশনাল স্ট্রিম’-এ। কম্পিউটারে ‘ট্যালি’ শিখছে, হিসাবশাস্ত্রে হোঁচট খাচ্ছে বারংবার, তবু বলেছিল ‘উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করবই’। আর তা করেই দেখাল। তবে তার স্বপ্ন হল কলকাতার বড় ক্লাবে ফুটবল খেলা। বাবা কে, জানে না, মাকে মনেই নেই তেমন ভাবে। বছর সাতেক বয়স থেকে অসরকারি সংস্থাটির সদস্য সে।
স্ট্রাইকার ভোলা-র ফুটবলপ্রীতি নিখাদ। যেমন নিখাদ সল্টলেকের একটি অসরকারি সংস্থার বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে সিভিক পুলিশ হিসেবে পাশে দাঁড়াতে পারার আনন্দ। মান্না দে-র ‘খেলা ফুটবল খেলা’ গানটার রেশ ধরে তাই বোধহয় ভিতরের অনেক বেদনা চোখের জল হয়ে ঝরে পড়ে। কিন্তু বুঝতে দেওয়া যাবে না তো কাউকে। তার সদাহাস্যময় সরল মুখখানি আবেগে অনর্গল। ইতিমধ্যে খোঁচা দিল তার নিজের সংস্থাটির বোনেরা— ‘আতা গাছে তোতা পাখি’-টা একটি বার বল তো। খুব বিরক্ত দেখাল তাকে। যেন আতা গাছে খামখা একটা তোতা পাখি বসে বসে কী এমন কাজখানাই বা করছে! তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বোনেরা এ বার ধরল, ‘বীরপুরুষ’টাই বল। এ বারেও বেশ রাগত ভাব, যেন তাকেই কায়দা করে ‘বীরপুরুষ’ বলে খেপানো হচ্ছে। আর এ সবের মূলে যে বোনটি ছিল, সে নানান অনন্য সাধারণ কৃতিত্বের অধিকারিণী হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। যদিও ভোলাদার পিছনে লেগে তারা নির্মল আনন্দটুকুই উপভোগ করছিল মাত্র। উত্তর কলকাতার সংস্থাটির মেয়েদের বিভাগ আর ছেলেদের বিভাগের ছোট ছোট সদস্যদের এমন নির্মল খুনসুটি বেশ উপভোগ্য।
এই বোনটিও (লিমা গায়েন) এ বছরই পাশ করল উচ্চ মাধ্যমিক। বাবা, অসহায় মা-কে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ওই সংস্থার আশ্রয়ে পৌঁছেছিল এই খুদে মেয়েটি। আপন ভাগ্য জয় করবার কণ্টকাকীর্ণ পথটাকে মসৃণ করে তোলার অসামান্য জেদ আর নিষ্ঠা তার পরিশীলিত কথাবার্তায়। যখন সে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী, তখনই পড়া হয়ে গেছে ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’। শরৎ সমগ্র ১ম খণ্ড কবেই শেষ। ফেলুদা, কাকাবাবু, ঘনাদা-টেনিদারা ওর স্বপ্নের চরিত্র সব। অসরকারি সংস্থাটির বাৎসরিক উৎসব হল কিছু দিন আগে। একটি নৃত্যনাট্যে বিরহকাতর রাধার রূপ যে স্বাভাবিক দক্ষতায় এই মেয়েটি তুলে ধরেছিল, তা বহু কাল মনে রাখার মতো। সব দিক সামলে সে এ বারে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করল ৭৫.৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে। বাংলায় ৮৬, নৃ-বিজ্ঞানে ৮০, ইংরেজিতে ৭০, পুষ্টিবিজ্ঞানে ৭০ এবং জীববিজ্ঞানে ৭৩ নম্বর। সত্যজিৎ রায় তার প্রিয় লেখক। রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা সে আবৃত্তি করতে পারে। নাচ, গান, আবৃত্তি, লেখালিখি এবং নেতৃত্বদানের জন্মগত প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র পেয়ে প্রাণোচ্ছল জীবন কাটাচ্ছে সে। জীবনের প্রথম ভাগের গ্লানি আর তাকে স্পর্শ করতে পারে না। বাংলা তার প্রাণের বিষয়। বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে সাংবাদিক অথবা শিক্ষিকা হতে চায় সে।
ভোলা, লিমা-দের সঙ্গে কঠিনতর লড়াইয়ে নেমে জিতে এল চৈতালী দাস (নাম পরিবর্তিত)। ৫০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়ে সেও এ বারে পাশ করল উচ্চ মাধ্যমিক। আসলে ‘পাশ’ করল আরও নানা ধরনের পরীক্ষায়।
চৈতালীর বাবা কাশী দাস (নাম পরিবর্তিত) সোনার কাজ করতে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন। ১৯৯৬-এ সেখানেই জন্ম চৈতালীর। ২০০১ সাল নাগাদ চৈতালীর বাবা একই সঙ্গে টিবি এবং জন্ডিস-এ আক্রান্ত হন। রক্তপরীক্ষায় জানা গেল তিনি এইচআইভি পজিটিভ। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর তিনি ২০০৩ সালে মারা গেলেন, স্ত্রী পার্বতী, সাত বছর চৈতালী আর চার বছরের ছেলে বিমান (সব নাম পরিবর্তিত)-কে অথৈ জলে ভাসিয়ে দিয়ে। কিন্তু আরও দুর্বিপাক যেন লুকিয়ে ছিল তাদের জন্য। পরবর্তী কালে দেখা গেল, চৈতালী তার মা ও ভাই সকলেই এইচআইভি পজিটিভ। নিজেদের রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের পাশাপাশি চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং তার সঙ্গে এই রোগ সম্বন্ধে অজ্ঞতাজনিত অন্ধ সামাজিক বিরূপতা।
এই ত্রিমুখী নিদারুণ আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে বদ্ধপরিকর চৈতালীর মা নিজে জরির কাজ করতে লাগলেন। আর তার মেয়ে ও ছেলের পাশে এসে দাঁড়াল ভোলা-লিমাদের সঙ্গী সেই অসরকারি সংস্থাটি। তাদের তত্ত্বাবধানে আরও সত্তর-একাত্তরটি এইচআইভি পজিটিভ শিশুর সঙ্গে তারাও আনন্দের অংশীদার হল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এইচআইভি পজিটিভদের জন্য এই হোম-টির আবাসিকদের সামাজিক অজ্ঞতার কারণে বহু অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল প্রাথমিক ভাবে। বর্তমানে হোম কর্তৃপক্ষের তরফে নানান সামাজিক মেলামেশার এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বন্দোবস্ত হওয়ায় এই অজ্ঞতা কেটেছে অনেকাংশে। চৈতালী স্থানীয় স্কুলে অন্য আর সব স্বাভাবিক মেয়েদের সঙ্গে পড়াশোনা করে পাশ করল উচ্চ মাধ্যমিক। তার জীবনে এক উজ্জ্বল মাইলফলক হিসেবে থাকবে এই সাফল্য। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বোধহয়, চৈতালী এমনই একটি হোম-এর সুপারিনটেন্ডেন্ট হতে চায়। সংস্থাটির কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস, চৈতালীর নম্রতা, মানবিক গুণাবলি এবং আত্মবিশ্বাসের কারণে এক দিন সত্যিই হয়তো চৈতালী এই সব ছেলেমেয়েদের পথের দিশারী হয়ে উঠতে পারবে।
হোম কর্তৃপক্ষ জানালেন, মাত্র একাত্তরটি এইচ আই ভি পজিটিভ বাচ্চাদের সংস্থান করতে পেরেছেন। যদিও এ ব্যাপারে তাঁরাই পথিকৃৎ। ৬ থেকে ১২ বছর বয়সি আরও ২০০টি এইচআইভি পজিটিভ শিশুর অভিভাবক আবেদন করে রেখেছেন। বছর পাঁচ-ছয় আগের পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে এমন ৮৬৭টি শিশুর হদিশ। তারা কেমন আছে, কী অবস্থায় আছে, তার কোনও সঠিক তথ্য নেই কোথাও।
আবার সরকারি নিয়মের গেরোয় ১৮ বছর বয়সের পর আর এই সব ‘হোম’-এ থাকা যায় না। ১৮-র বেশি সর্বোচ্চ ২১ পর্যন্ত ‘আফটার কেয়ার হোম’-এ তাদের ঠাঁই হতে পারে। তবু আশা করা যায়, ২১ বছর বয়সের মধ্যেই এই মুখগুলোয় আশার আলো জ্বলে উঠবার সুযোগ ঘটবে।
ভূতপূর্ব সদস্য, চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy