Advertisement
১৯ মে ২০২৪

কোতুলপুরের শ্রীধর জীউর মন্দির

পঞ্চরত্ন দণ্ডেশ্বরী মন্দিরটি ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে লাউগ্রামবাসীদের উদ্যোগে নির্মিত। রত্ন কথাটির অর্থ চূড়া। সুতরাং, মন্দিরটি পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট, অর্থাৎ, পঞ্চরত্ন। মন্দির গাত্রে খচিত পোড়ামাটির ফলকের উপস্থিতিও সমান ভাবে আকর্ষণীয়। এই মন্দির নিয়ে লিখছেন বিপ্লব বরাটপঞ্চরত্ন দণ্ডেশ্বরী মন্দিরটি ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে লাউগ্রামবাসীদের উদ্যোগে নির্মিত। রত্ন কথাটির অর্থ চূড়া। সুতরাং, মন্দিরটি পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট, অর্থাৎ, পঞ্চরত্ন। মন্দির গাত্রে খচিত পোড়ামাটির ফলকের উপস্থিতিও সমান ভাবে আকর্ষণীয়। এই মন্দির নিয়ে লিখছেন বিপ্লব বরাট

কোতুলপুরের মন্দির। ছবি: লেখক

কোতুলপুরের মন্দির। ছবি: লেখক

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৯ ১১:৫২
Share: Save:

বিষ্ণুপুর থেকে ৩০ কিলোমিটার গেলে কোতুলপুর থানার সদরের কোতুলপুর গ্রাম। জনশ্রুতি আছে পাঠান নেতা কতলু খানের নাম অনুসারে গ্রামের নাম হয় কোতুলপুর।

স্থানীয় গবেষক লক্ষ্মীকান্ত পালের মতে, লৌকিক দেবী দণ্ডেশ্বরীর সঙ্গে মল্ল রাজাদের সম্পর্ক জড়িত আছে। দ্বিতীয় মল্লরাজ জয়মল্ল লাউগ্রামের দণ্ডেশ্বরী দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দণ্ডেশ্বরী একাধারে জগদ্ধাত্রী আবার দশহরা ও সয়লা উৎসবে দেবী মনসা রূপে উপাসিতা। যাই হোক বর্তমানে দক্ষিণমুখী পঞ্চরত্ন দণ্ডেশ্বরী মন্দিরটি ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে লাউগ্রামবাসীদের উদ্যোগে নির্মিত হয়। এই প্রবন্ধে যে পঞ্চরত্ন মন্দিরটি নিয়ে আলোচনা হবে তা হল কোতুলপুর থানার শিরোমণিপুর গ্রামের ভদ্র পরিবারের শ্রীধর জীউ।

শ্রীধর জীউ পঞ্চরত্ন মন্দিরে পোড়ামাটির অভিনবত্ব এটির দেওয়ালের অলংকরণে। রত্ন কথাটির অর্থ চূড়া। সুতরাং, মন্দিরটি পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট, অর্থাৎ, পঞ্চরত্ন। পূর্বমুখী শ্রীধর জীউ (শালগ্রাম বিষ্ণু) মন্দিরটি ঢালু ছাদের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে উঠে গিয়েছে। মন্দিরগাত্রে খচিত পোড়ামাটির ফলকের উপস্থিতিও সমান ভাবে আকর্ষণীয়। মন্দিরটি দৈর্ঘ-প্রস্থে ১৫ ফুট ৯ ইঞ্চি ও উচ্চতায় প্রায় ৩০ ফুট। সামনে দেওয়ালে প্রতিষ্ঠা ফলক দেখে জানা যায়, দেবালয়টি ১২৪০ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। উৎকীর্ণ প্রতিষ্ঠা ফলকের ডান পাশে বেহালা বাদিকার দৃশ্য খোদিত রয়েছে। কোতুলপুরের নারীপুরুষ সে কালে সঙ্গীত চর্চায় বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছিল। এই ফলক তারই প্রমাণ।

মন্দিরের সম্মুখ ভাগের মাঝের ফলকে রথ যাত্রার সামনে নৃত্যরত নরনারী বৃন্দ সারিবদ্ধ ছবি। রথের উপরে হাঁটুমুড়ে বসে থাকা ‘বামনের’ চিত্র দেখা যায়। কথিত রয়েছে, রথের মধ্যে এই ‘বামন’কে দেখলে মানুষকে আর পুনর্জন্মের দুঃখ, যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় না। পুরাণ মতে, মানুষের শরীর একটি রথের মতো। এই শরীরের আত্মাকে রথী বলা হয়। বুদ্ধিকে রথের চালক অথবা সারথী। মনকে বলা হয় অশ্বের লাগাম। তাই মন ইন্দ্রিয়ের রশি টেনে ধরে রাখতে পারে। টেরাকোটা প্যানেলে রথযাত্রার এই তত্ত্বই যথার্থ ভাবে খোদাই করেছেন শিল্পীরা।

উপরের ফলকে রয়েছে রাম ও সীতা। পাশে লক্ষ্মণ ছাতা ধরে ও ভরত চামর হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হনুমান ও জাম্বুবান হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। বাঁ দিকের দেওয়ালে টেরাকোটা প্যানেলে রাম-রাবণের যুদ্ধের দৃশ্য।

পাত্রসায়ের থানার হদল নারায়ণপুরে মেজ তরফের পূর্বমুখী নবরত্ন রাধাদামোদর মন্দিরে রাম রাবণের যুদ্ধের চিত্রটি মোটামুটি একই রকম। ডান পাশের ফলকে বস্ত্রহরণ। এখানে কৃষ্ণ জীবের অষ্ট পাশ থেকে লজ্জা ত্যাগ করতে শিক্ষা দিচ্ছেন। পুরুলিয়া জেলার চেলিয়ামার রাধাবিনোদ মন্দিরে পোড়ামাটির একই রকম বস্ত্রহরণের দৃশ্য খোদিত হয়েছে।

মন্দিরের খিলান শীর্ষের কার্নিসের দুই কোণে রয়েছে দু’টি নৌকা যাত্রার দৃশ্য। মনসামঙ্গলে চাঁদ সওদাগরের মতো ভদ্র রাও নদীতে নৌকা ভাসিয়ে ব্যবসা করতে যেত দূর দেশে। সে কথা মনে করিয়ে দেয় এই ফলক। মন্দিরের বাঁদিকে ১২টি এবং ডানদিকে ১২টি ও মাঝে ১৯টি প্যানেলে খোদাই করা রয়েছে দশাবতার ও পৌরাণিক কাহিনি।

পোড়ামাটির ভাস্কর্যে সমাজ আলেখ্য দৃশ্যগুলি হল তামাক সেবন, হামানদিস্তায় মশলা গুঁড়ো করা, সামাজিক উপাখ্যানে সজ্জিত শিবের আরাধনা, ঢোল বাদক। মাঝের ফলকে দশভুজা দুর্গা। কিন্তু পুত্রকন্যা বর্জিত। এ ছাড়া নৃত্যরত ভঙ্গিমায় সংকীর্তন দৃশ্যটি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রেক্ষাপটে ধ্রুপদী সংস্কৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। স্তম্ভগাত্রের পোড়ামাটি ফলকে উৎকীর্ণ জ্যামিতিক ও ফুলকারি ভাস্কর্যের প্রাচুর্য। এই মন্দিরের ফলকগুলির সঙ্গে নন্দলাল বসু ও যামিনী রায়ের আঁকা দ্বিমাত্রিক মানব মূর্তির শিল্পসৃষ্টির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আবার শুশুনিয়ার ভরতপুরের পটুয়াদের পটচিত্রেরও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভদ্রদের শ্রীধর জীউ পঞ্চরত্ন মন্দিরটি মৌলিকত্ব বজায় রেখেছে। ভদ্র পরিবার কুলদেবতা শ্রীধর চন্দ্র ঠাকুর জীউর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে লোকায়ত ঐতিহ্যকে লালন করে আসছেন।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

শ্রীধর জীউ পঞ্চরত্ন মন্দিরের পাশে পশ্চিমমুখী গিরিগোবর্ধন মন্দিরটি নির্মাণরীতির নিরিখে অভিনব। কৃষ্ণের গিরিগোবর্ধন ধারণের অনুসরণে টেরাকোটা সজ্জায় আবৃত মন্দিরটি পাথরের তৈরি। ষড়ভুজ কৃষ্ণ, কালী, পৌরাণিক দৃশ্যের অলংকরণ আছে গিরিগোবর্ধন মন্দিরের দেওয়ালে। বাঁকুড়া জেলায় চারটি গিরিগোবর্ধন মন্দির আছে। কোতুলপুরে, জয়পুর থানার রাজগ্রামে, বিষ্ণুপুর থানার অযোধ্যায় ও সোনামুখীতে। গিরিগোবর্ধন মন্দিরের পাশেই একটি ছোট নবরত্ন দোলমঞ্চ অবস্থিত।

বর্ধমানের মরাল গ্রাম থেকে এসে সদানন্দ ভদ্র নামে জনৈক ব্যক্তি কোতুলপুরে বসবাস শুরু করেন। তখন সতেরো শতকের শেষ দিক। বর্ধমানের মহারাজ উদয়চাঁদ মহাতাবের কাছ থেকে কোতুলপুর লাগোয়া সতেরোটি তালুকের জমিদারি স্বত্ব কিনে নেন তিনি। তার পর ওই ক’টি গ্রাম নিয়ে জমিদারি তৈরি করেন। কিন্তু, সদানন্দ ভদ্র মূলত ব্যবসায়ী ছিলেন। লবণ, সুতো ও সরষের ব্যবসা করতেন। পরবর্তী কালে পরিবারটি দুই তরফে ভাগ হয়ে যায়। এই দুই পরিবার তৈরি করেন দুর্গামণ্ডপ, নহবতখানা, গিরিগোবর্ধন মন্দির, রাসমঞ্চ পঞ্চরত্ন শ্রীধর জীউ মন্দির। বর্তমানে কোতুলপুর গ্রামে জ্যৈষ্ঠে দশহরা ও ফাল্গুনে দোল উৎসব এ ছাড়া অনেক পার্বণই জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। সময় বিশেষে অষ্টপ্রহর কীর্তন ও পৌরাণিক যাত্রাভিনয়ও হয়।

ভদ্র পরিবারে পদধূলি পড়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণের। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থে তার উল্লেখ পাই আমরা। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ থেকে ১০ অক্টোবর দীর্ঘ আট মাস শ্রীরামকৃষ্ণ কামারপুকুরে ছিলেন। সে সময় শ্রীরামকৃষ্ণ সিহড়, কয়াপাট প্রভৃতি স্থান পরিভ্রমণ করেছিলেন।

সে বছরই দক্ষিণেশ্বরে ফেরার আগে দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন কোতুলপুরে যান। সেখানেই ভদ্র পরিবারের দুর্গাপুজোর আরতি দর্শন করে মোহিত হয়ে যান তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণের পদার্পণে কোতুলপুরের শিরোমণিপুর ধন্য হয়েছিল। ভদ্রদের পুজোমণ্ডপের দেওয়ালে সেই মুহূর্তের স্মরণে প্রোথিত শ্বেত প্রস্তরের ফলকটি আজও বিদ্যমান।

লেখক বাঁকুড়ার ক্ষেত্র সমীক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kotulpur Shridhar Jiu Bishnupur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE