‘আর একটি ঐতিহাসিক ভুল’? কলকাতায় কংগ্রেস ও বামপন্থীদের যৌথ মিছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
প শ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম বাম দলটির নবনির্বাচিত রাজ্য সম্পাদকের বিভিন্ন সাম্প্রতিক বিবৃতিতে কোনও দ্বিচারিতা নেই। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে দলমতনির্বিশেষে তিনি মানুষের জোট চাইছেন, এমনকী ২০১১ সালের নির্বাচনে যাঁরা তখনকার বিরোধী দলের সর্বময়ী কর্ত্রীর ভণ্ডামিতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন তাঁরাও তাঁর আহ্বানের পরিধির বাইরে নন। ওঁদের মধ্যে অনেকেই তথাকথিত একটি-দুটি নকশালপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা আছেন।
একটি নীতিবিবর্জিত দুর্বৃত্ত-অধ্যুষিত দল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাজ্য প্রশাসন দখল করে পশ্চিমবঙ্গকে যে বিভীষিকাময় অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন করেছে, তার বিরুদ্ধে সর্বগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ভুক্তদের একত্র হতে হবে। কিন্তু এই সংঘবদ্ধ ভাবে সর্বশ্রেণির জড়ো হওয়া নিছক নির্বাচনে সর্বময়ী দলনেত্রীকে পরাভূত করার জন্য নয়। মানুষের জোট গড়তে হবে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে, অসুরকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে ন্যায় ও সত্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে, অসত্য যেন আর কোনও দিন মাথা তুলতে না পারে।
মুশকিল হল, খবরের কাগজগুলির কাছ থেকে সতত উৎসাহ পান, এমন কিছু নাম-কা-ওয়াস্তে বামপন্থী নেতা আছেন, যাঁরা নিছক মানুষের জোটে সন্তুষ্ট নন। তাঁদের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ কোনও দিন ছিল না, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে তাঁদের সুখদুঃখের ভাগীদার হওয়ার কর্তব্য এড়িয়ে গিয়ে এ সব ব্যক্তি নেতা-মন্ত্রী হয়েছিলেন। হঠাৎ সেই সুখের নীড় ভেঙে চুরমার। যত তাড়তাড়ি সম্ভব পুরনো সুখের মন্ত্রীগিরিতে আবার কী করে দ্রুত অধিষ্ঠিত হতে পারেন, সেই ভাবনায় তাঁরা অস্থির। তাঁদের ধারণা, মানুষ-ফানুসের জোট নয়, একটি বিশেষ সর্বভারতীয় দলের সঙ্গে সরকারি ভাবে জোট বেঁধে নির্বাচনে নামলেই কেল্লা ফতেহ্! নিজেদের দলের মধ্যে এঁরা
এই প্রস্তাব নিয়ে সরব হয়েছেন, ওই সর্বভারতীয় দলের দু’একটি রাজ্য নেতাদের কাছ থেকে উৎসাহও পেয়েছেন। মানুষদের নিয়ে কোনও দিন আন্দোলন না-করা এই নেতারা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত তাঁদের আর্জি নিয়ে গেছেন।
বিব্রত কেন্দ্রীয় কমিটি বর্তমান লগ্নে দলকে সংঘবদ্ধ রাখতে উদ্গ্রীব, ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি গোছের একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে ব্যাপারটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। যে সর্বভারতীয় দলটির সঙ্গে মিলনাপেক্ষী এই মানুষকে-ভয়-পাওয়া নেতৃবৃন্দ, তার সর্বোচ্চ নেত্রীমহোদয়া কিন্তু সাড়াশব্দই করছেন না। তাঁর প্রয়াত স্বামী পশ্চিম বাংলার বর্তমান মুখ্য প্রশাসক নেত্রীটিকে খুবই পছন্দ করতেন। তিনি নিজেও নেত্রীটির প্রতি স্নেহশীলা। সুতরাং একটি-দুটি ফালতু নেতার কথায় তিনি সায় দেবেন, আদৌ তা মনে হয় না। দলীয় জোটের প্রস্তাব খারিজ হয়ে যাবে। ওই সর্বভারতীয় দলের নেত্রীটি পাটিগণিতে কাঁচা নন, এই রাজ্যের শাসক দলের মহারানি রাজ্যসভায় জনা পনেরো সভ্যের দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্রী, সেই হিসাবটিও সর্বভারতীয় দলের সর্বোচ্চ নেত্রীর অবশ্যই গোচরে আছে।
তবে বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ও সেই অভ্যাস থেকে বিশ্লিষ্ট নন। যে দলের সর্বময়ী নেত্রী মিতালিতে আদৌ আগ্রহী নন, বলা হচ্ছে, সেই দলটির সঙ্গে মিতালি না করলে তা নাকি আর একটি ‘ঐতিহাসিক ভুল’ হবে! ছেলেমানুষিরও সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তবে ‘আর একটি ভুল’ কথাটি এক দিক দিয়ে অর্থবহ। ইঙ্গিত করা হচ্ছে: ১৯৯৬ সালে অ-কংগ্রেসি অ-বিজেপি জোটের পক্ষ থেকে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, দল জ্যোতিবাবুকে সে প্রস্তাব গ্রহণ করার অনুমতি দেয়নি, সেই সিদ্ধান্তকে জ্যোতিবাবু তন্মুহূর্তে দলের পক্ষে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। অনেকেরই ধারণা, জনতা দল এই বিশেষ সময়ে নানা অন্তর্কলহে ক্রমশ টুকরো টুকরো হচ্ছিল, লোকসভায় মাত্র পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ জনের নেতা জ্যোতি বসু সরকার গঠন করলে, তা মাত্র কয়েকটি সপ্তাহের বেশি টিকত না। দল ও জ্যোতি বসুকে বেইজ্জত হতে হত।
তবে খোলাখুলি বলা যায়, আসলে বামপন্থীরা ঐতিহাসিক ভুল করেছিলেন ২০০৪ সালে। লোকসভা নির্বাচনে সারা দেশে বামেরা প্রায় ৬৫টি আসনে জয়ী। এত বড় সাফল্য অতীতে কখনও ঘটেনি। বামপন্থীদের সমর্থন ছাড়া কংগ্রেস দল সরকার গঠন করতে পারত না। বাম দলগুলি ওই পরিস্থিতিতে সমর্থনের সম্মতি জ্ঞাপনের জন্য কয়েকটি সুস্পষ্ট শর্ত চাপাতে পারতেন, যথা: ক) যোজনা কমিশন ও অর্থ কমিশন গঠনে বামেদের সঙ্গে প্রারম্ভিক আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছনো অতি আবশ্যিক। খ) মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রেও বামপন্থীদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে এবং রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া-র পরিচালন বোর্ডে রাজ্যদের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে হবে। গ) কৃষি ও সেচে সরকারি বিনিয়োগ পাঁচ বছরে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করতে হবে। ঘ) রাষ্ট্রীয় সরবরাহ ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিশেষ করে দরিদ্রজনদের জন্য ন্যূনতম হারে খাদ্য সরবরাহ সম্পর্কে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার অপরিহার্য। ঙ) পাঁচ বছরে দেশের পূর্বাঞ্চলে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করতে হবে। চ) রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিক্রয় বন্ধ করতে হবে, শুরুটা করতে হবে বিলগ্নিকরণ মন্ত্রক তুলে দিয়ে। ছ) বৈদেশিক চুক্তি আবদ্ধ হওয়ার পূর্বাহ্ণেও বামপন্থীদের প্রাক্সম্মতি সুনিশ্চিত করতে হবে।
কিন্তু ঘটনাটা হল এই যে, এ ধরনের কোনও পূর্বশর্ত আরোপ না করে ভাসা-ভাসা কয়েকটি আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে বামপন্থীরা সে-দিন কংগ্রেস দলকে অপশাসনের ঢালাও সুযোগ করে দেয়। ‘নয়া উদার অর্থনীতি’ অবাধে প্রয়োগ করে কৃষি-শিল্পের সর্বনাশ ২০০৪ সালের পরেও অব্যাহত, দুর্নীতি পরিব্যাপ্ততর, মূল্যবৃদ্ধির গতি অনবরুদ্ধ, দরিদ্র-মধ্যবিত্তদের হাঁসফাঁস অবস্থা, এবং এই গোছের আর্থিক নৈরাজ্যের প্রত্যক্ষ পরিণামই ভারতীয় জনতা পার্টির মাথা তুলে দাঁড়ানো। তার বড় কারণ বামপন্থীদের সেই ‘ঐতিহাসিক ভুল।’ অথচ সেই ভুলের ব্যাপারে দলে তেমন হেলদোল নেই।
কিন্তু আরও একটি ঐতিহাসিক ভুলের আশঙ্কা ব্যক্ত না করে উপায় নেই। যে মুখগুলির স্মৃতি রাজ্যের সাধারণ মানুষের মনে বামফ্রন্ট জমানার শেষ দশকের ঘোর অন্যায়-অনাচারের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে, সেই একই মুখগুলিকে যদি অনুষ্ঠিতব্য আসন্ন নির্বাচনে বামপন্থীদের মঞ্চে মঞ্চে ফের ডুগডুগি বাজাতে দেখা যায়, তা হলেই কেলেংকারি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy