আর্ট নিয়ে রবীন্দ্র-অবনীন্দ্রের সেতু বন্ধনের সেই শুভ সূচনা। এর পর সময় যত গড়িয়েছে রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ হয়ে উঠেছেন তাঁর প্রেরণা। এই সময়ের কথা বলতে গিয়ে ‘নালক’ এর জনক লিখছেন, “সেই সময় রবিকার চেহারা আমি অনেক এঁকেছি, ভালো করে শিখেছিলুম প্যাস্টেল ড্রইং। নিজের স্টুডিওতে যাকে পেতুম ধরে প্যাস্টেল আঁকতুম। অক্ষয়বাবু, মতিবাবু সবার ছবি করেছি। মহর্ষির পর্যন্ত। এই করে পোট্রেটে হাত পাকালুম। রবিকাকেও প্যাস্টেলে আঁকতুম, জগদীশবাবু সেটি নিয়ে নিলেন।” প্যাস্টেলে হাত মসকো করলেন। তারপর তেল, জল রঙে। বিদেশি সাহেবদের কাছে গেলেন সে সব কলা-কৌশল রপ্ত করতে। শীঘ্র সে সবও হল সারা। এ সময়ে কয়েকটি ভিন্ন ধারার ছবি এল তার হাতে। তখনকার দিনে কেরলের শিল্পী রবি বর্মাই ছিলেন ভারতীয় চিত্রশিল্পের আদর্শ পুরুষ। কি বিখ্যাত সব ছবি তাঁর হাতের স্পর্শে জীবন্ত হয়ে উঠেছে! তবে সে সবই ইউরোপীয় পদ্ধতির নকলনবীশ। রবীন্দ্রনাথের হাত ঘুরে তারই কয়েকটি এল অবনীন্দ্রনাথের কাছে। বিলেত থেকে মার্টিন ভেল তাঁকে পাঠালেন কয়েক খানা আইরিশ মেলডির ছবি। নিজের ভগ্নীপতি শেষেন্দ্র দিলেন একখানা পার্সিয়ান ছবির বই—দিল্লির ইন্দ্রসভার নক্সা। পুরাতন ইউরোপীয় আর্ট আর প্রাচীন ভারত চিত্রকলার স্বরূপ উপলব্ধি করলেন তিনি। উভয় শিল্প ধারার চিত্রের গোড়ার কথা যে একই, সে কথা বুঝতে আর বাকি রইল না। তখন নতুন জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত এই অবনীন্দ্রনাথের কাছে ধরা পড়ল ভারত-শিল্পের উদ্দেশ্য। সমস্ত শৈলিতে বুৎপত্তি নিয়ে এ বারে হাত দিলেন নিজস্ব শৈলী রচনায়। যার ফসল ‘শাহাজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’, ‘শাহাজাহানের তাজ নির্মাণ’, ‘সীতা’, ‘ভারতমাতা’ ।
অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ ছবির মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষ যেন শিল্প ক্ষেত্রে নতুন যুগে প্রবেশ করল। প্রবাসী-তে রামানন্দ যখন ‘সীতা’ছবিখানি ছাপলেন নিবেদিতা লিখলেন একখানি চিত্র-পরিচিতি। তাঁর ভাষায়, “সত্য বটে ভাব ও চিন্তা ব্যক্ত করিবার আধুনিক যুগের নানাবিধ উপায়ের সাহায্য লইয়া অবনীন্দ্রবাবু এই ছবি আঁকিয়াছেন, কিন্তু তাহা হইলে চিত্রপটে তৎকর্তৃক পরিব্যক্ত মানসিক আদর্শটি খাঁটি ভারতীয় ছিল। আকার প্রকারও ভারতীয়। পদ্মগুলির বক্ররেখা ও শিরোবেষ্টক প্রভাত মণ্ডলের শুভ্রদীপ্তি সংযোগে এশিয়োদ্ভুত কল্পনাজাত মূর্তিটি সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। চারিবাহু দৈবশক্তির বহুত্বের চিত্র স্বরূপ। ইহাই প্রথম উৎকৃষ্ট ভারতীয় চিত্র, যাহাতে এক ভারতীয় শিল্পী যেন মাতৃভূমির অধিষ্ঠাত্রীকে—ভক্তিদায়িনী-বাদ্যদাত্রী, বসন-দায়িনী, অন্নদা মায়ের আত্মাকে—দেশরূপী শরীর হইতে স্বতন্ত্র করিয়া তাহার সন্তানগণের মানস ক্ষেত্রে তিনি যেরূপ প্রতিভাত হন, সেই ভাবে অঙ্কিত করিয়াছেন। মায়ে শিল্পী কি দেখিয়াছেন, তাহা এই চিত্রে আমাদের সকলের কাছে বিশদ হইয়া গিয়াছে। কুহেলিকার মত অস্পষ্ট পদ্মরাজি ও শ্বেত আভা, তাঁহার চারিবাহুও অনন্ত প্রমেরই মত, তাঁহাকে অতিমানব করিয়া রাখিয়াছে। অথচ তাঁহার শাঁখা, তাঁহার সর্বদেহাচ্ছাদক পরিচ্ছদ, তাঁহার খালি পা, তাঁহার খোলা, অকপট মুখের ভাব, এই সকলে তিনি কি আমাদের পরম আত্মীয়, হৃদয়ের হৃদয়, একাধারে ভারতের মাতা ও দুহিতা বলিয়া প্রতিভাত হইতেছেন না? প্রাচীন কালের ঋষিদিগের নিকট বৈদিক উষা যেমন ছিলেন?” (প্রবাসী, ৬ষ্টভাগ, ৫ম সংখ্যা) নিবেদিতার এ স্তুতি নিঃসন্দেহে অবনীন্দ্রনাথকে অনুপ্রাণিত করে থাকবে।
শিল্প-তাত্বিক নিবেদিতা মনে করতেন, শিল্প-সৃষ্টির মহতি শৈলীগুলি আত্মবিনাশ না ঘটিয়ে নতুন জ্ঞানের উদ্ভাসে উদ্ভাসিত হয়ে থাকে যুগে যুগে। বোধকরি এ ধারণাই তাঁকে প্রণোদিত করেছিল ভারতবর্ষের স্বকীয় শিল্প-বৈশিষ্ট্যের জাগরণকে আহ্বান করতে। পরানুকরণ নয়, অন্য শিল্পের মহৎ বৈশিষ্ট্যের সাঙ্গিকরণের মাধ্যমে স্বতন্ত্র নিজস্ব শিল্পরীতি বিকাশের ওপর যে গুরুত্ব তিনি আরোপ করেছিলেন, অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর প্রতিমূর্তি। ১৯০৮-এর মডার্ন রিভিউ-এর মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত হল অবনীন্দ্রনাথের ‘সীতা’, সঙ্গে বেরলো নিবেদিতা রচিত চিত্র-পরিচিতি। তাঁর দৃষ্টিতে অবনীন্দ্রনাথের ‘সীতা’ ভারতীয় ধরনের শ্রেষ্ঠ সুমুখশ্রী নয়। ঢালু কপাল, স্থূল গ্রীবা সমন্বিত সে মূর্তির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় হিন্দু রমণীর বৈশিষ্ট্য । এ সীতা যতখানি মহিয়ষী নারী, ততখানি মহিয়ষী পত্নী নন। নিবেদিতার ভাষায় একটুখানি শোনা যাক যে ‘সীতা’র বর্ননাঃ “In this picture, with its noble proportions and splendid vigour, we see that Sita who could laugh at hardships, and burn with her disdain Ravana himself, we catch a glimpse even of the woman of the last great scene of wounded withdrawal, before the popular insult.” ‘রাজ্ঞীগর্বে সমুন্নত শক্তিময়ী মহিমান্বিত নারীত্বের’ যে প্রকাশ এখানে ঘটেছে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে নিবেদিতা এ সীতাকে ভারতীয় ম্যাডনার নবরূপ বলে চিহ্নিত করলেন। আর লিখলেন, “The outstanding impression made by this picture is one of extraordinary mental intensity...In the strong and noble womanhood, in the regal pride brought low, and the hoping yet despairful wifehood, of this Sita, by Mr. Tagore, we have achieved something too deeply satisfying for us again to be contented without an effort in its direction.”
মর্ডান রিভিউতে ১৯০৭-এর মে মাসে ‘শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’ চিত্রটি প্রকাশিত হলে, নিবেদিতা তাকে “superb original of the drawing” বলে তাঁর আহ্লাদ ব্যক্ত করলেন। প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক আনন্দ কুমারস্বামীকে উদ্ধৃত করে অবনীন্দ্রনাথ সম্পর্কে উচ্চকিত নিবেদিতা এ সময়ে লিখেছিলেন, “not only is he what could not have been expected in India at present, but also probably of first rank in Europe.” ‘শাহজাহানের তাজ-স্বপ্ন’ ছবিতে যমুনা তীরে রাত্রিকালে অশ্বারূঢ় মুঘল সম্রাট তাজ নির্মাণের কথা ভাবছেন। নিশিথের নিস্তব্ধতা আর কল্পিত তাজ বিবির শৌধের ওপর চুইয়ে পড়া অবগুণ্ঠিত চন্দ্রালোকের আলোআঁধারিতে শাহজাহানের অন্তরের আধ্যাত্মিকতা যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। চিত্রের বিষয়বস্তু ও ভাবাবেগের চালচিত্র মেলে ধরে এর চিত্র-সমালোচনায় নিবেদিতা লিখলেন, “The drawing is full of strength. But we do wish that we might again enjoy colour at the hands of Mr. Tagore! We long for some of those bright and tender interpretations which were once so characteristic of the art of this land of bright skies and limpid atmospheres, those interpretations in which Mr.Tagore himself is so well fitted to excel!” (‘Notes on Abanindranath Tagore’ in The Modern Review January, 1910 ) (চলবে)
শিক্ষক, মহাদেবানন্দ মহাবিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy