Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪

রাবণবধের দেশেই রাবণ উৎসব

রাবণবধ হয় প্রতি বছর। দলবীর সিংহকেও মারা পড়তে হয় প্রতি বছর। কারণ দলবীর সিংহ রাবণ। অন্তত প্রতি বছর অমৃতসরের রামলীলায় তাই সাজেন তিনি, তাই রাবণ বা লঙ্কেশ বলেই লোকে ডাকে তাঁকে, সারা বছর।

ঈশা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৮ ০১:২৭
Share: Save:

রাবণবধ হয় প্রতি বছর। দলবীর সিংহকেও মারা পড়তে হয় প্রতি বছর। কারণ দলবীর সিংহ রাবণ। অন্তত প্রতি বছর অমৃতসরের রামলীলায় তাই সাজেন তিনি, তাই রাবণ বা লঙ্কেশ বলেই লোকে ডাকে তাঁকে, সারা বছর।

এ বছর দশেরায়ও মারা পড়তে হল ‘রাবণ’ দলবীরকে। দলবীর মারা গেলেন, তবে দশেরার মিথ্যে আগুনে নয়। অমৃতসরের দশেরার দিনের মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনায় আরও অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মারা যান দলবীরও। তফাত এইটুকু যে, দলবীর হয়তো বাঁচতে পারতেন। কারণ ট্রেন দেখতে পেয়েছিলেন একটু আগে। আট জনকে ট্রেনের পথ থেকে সরিয়ে দিতে পারেন, এবং শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচাতে পারেন না। আট মাসের সন্তান, দু’বছর আগে বিবাহিত স্ত্রী আর মা’র আগে, নিজের জীবনেরও আগে অন্যদের বাঁচাবার চেষ্টা করেন ‘রাবণ’ দলবীর সিংহ।

গত ১৯ অক্টোবর অমৃতসরে রাবণবধের উদ্‌যাপনে, অশুভ শক্তি বিনাশের ধর্মীয় উল্লাসে ট্রেনের নিয়মিত সময়টুকু মনে থাকে না, অত বড় এক যান্ত্রিক বাহনের শব্দ আলো চোখে পড়ে না। উৎসব, ধর্মীয় উপলক্ষে গণ উন্মাদনা বা মাস হিস্টিরিয়ায় মৃত্যুর ইতিহাস আমাদের কম নয়। কখনও পদপিষ্ট হয়ে, কখনও আকস্মিক অগ্নিসংযোগে, কখনও পথ দুর্ঘটনায়। কিন্তু এ ভাবে এক মুহূর্তে নিরুপায় বধ, দশেরা প্রথম দেখাল।

এই রাবণবধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে আদিবাসী দলিত বহুজন সংগঠন ‘ভীম দল’। দক্ষিণ ভারতের কর্নাটকে, তামিলনাড়ুতে, অন্ধ্রপ্রদেশে, মহারাষ্ট্রে। অবশ্য আন্দোলন শুরু হয় অমৃতসরের দুর্ঘটনার অনেক আগে, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। দশেরার অনুষ্ঠান নয়, রাবণবধ বন্ধ হোক, এটাই মূল বক্তব্য। সুপ্রিম কোর্টে আর্জিও জমা পড়ে এই প্রথা বন্ধ করার জন্য। তাতে কারণ হিসেবে বলা হয় আদিবাসী বহুজন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আবেগে আঘাত করার কথা। অসংখ্য আদিবাসী জনজাতির (মূলত দক্ষিণ ভারত আর মহারাষ্ট্রে) আরাধ্য দেবতা রাবণ। কর্নাটকের বহু মন্দিরে শিবলিঙ্গের পাশাপাশি উপাসনা করা হয় দশানন রাবণমূর্তিকেও। তাই এসসি/এসটি অ্যাক্টের অধীনে দায়ের হয় আর্জি। আর্জি খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের ২৬ ধারার আড়ালে জানিয়ে দেয় তারা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কারণ ২৬ ধারা অনুসারে, কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ সংবিধান বহির্ভূত। শবরীমালা রায়ের মতো ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রে ঘটে না, রাবণবধের মামলার ক্ষেত্রেও ঘটেনি।

রাবণবধকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনাও শুরু হয় বহু দিন আগে। ১৯৯১ সাল নাগাদ, রাম জন্মভূমি বিবাদের কাছাকাছি সময় রাবণবধের বিরোধিতা এবং রাবণ আরাধনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। স্থান: পারাসওয়ারি, গড়চিরৌলি, অমরাবতী। রাজ্য: মহারাষ্ট্র। শুধু মহারাষ্ট্রে নয়, কর্নাটক, তামিলনাড়ুর বিভিন্ন অঞ্চলেই গোন্ড উপজাতির বসবাস, যাদের আরাধ্য দেবতা রাবণ। শুধু আরাধ্য দেবতাই নয়, তাদের নামের উপাধিতেও ‘রাবণ’ যুক্ত থাকে। তারা তাদের এই প্রথা নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে বিযুক্ত ছিল, কিছু সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া।

১৯৯১ সাল, রাম-রাজনীতির উন্মেষ ও গোন্ড উপজাতির সঙ্গে সংঘাত। ‘গোন্ডোয়ানা গোন্ড সংস্কৃতি বাঁচাও সমিতি’ (জিজিবিএস) কেন্দ্রের ধর্মীয় সম্মেলন ‘রাবণ বিজয়’-এ (নাগপুরে), সরাসরি আক্রমণ করে আরএসএস। প্রতিবাদে গড়চিরৌলি অঞ্চলের অধিবাসীরা আন্দোলন করে। এমনকি নিজেদের নামে কোথাও ‘রাম’ শব্দাংশের উল্লেখ থাকলে তার পরিবর্তন করে ফেলেন তৎক্ষণাৎ। যেমন মোতি ‘রাম’ কানগালের নাম হয়ে যায় মোতি‘রাবণ’ কানগালে। কানগালে, মণিরাবণ দুগার মতো বহু মানুষ আজও চেষ্টা করছেন গোন্ড সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার।

পরবর্তী কালে এই অঞ্চলে ধর্মীয় জয় পাওয়ার জন্য আরএসএস শুরু করে অসংখ্য ‘একল বিদ্যালয়’। রাবণ উপাসনার প্রথাকে ত্যাগ করে, রামকে দেবতা রূপে গ্রহণ করতে হবে, এমন বাধ্যতামূলক শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা, যেখানে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার নামে নিয়ে আসা হয় গোন্ড উপজাতির কিশোরদের। এখন গড়চিরৌলিতে প্রায় ১৫০টা একল বিদ্যালয় আছে, এবং গোন্ড ‘গোতুল’ বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা প্রায় শূন্য। এর বিরুদ্ধে ক্রমাগত আন্দোলন করে চলেছেন অনেকে, যাঁদের মধ্যে অন্যতম বিরা সাথিদার, যাঁকে সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে ২০১৬-র ‘কোর্ট’ চলচ্চিত্রে। প্রায় চব্বিশ বছর ধরে ‘রাবণ উৎসব’ আয়োজন করছেন তিনি। তাঁর ছেলের নামও রাবণ।

এই আন্দোলনের খবর আমাদের কাছে তত এসে পৌঁছয় না কেন? এখনও খবরের কাগজের প্রথম পাতায় দেখি না কেন বিরা সাথিদারের নাম? কারণ এই আন্দোলন মূলত অহিংস, নানা অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কোনও ধ্বংসের পথে যায় না। তাই যত জন মারা গেলে আমরা নড়ে চড়ে বসি, এই আন্দোলনে তা হয় না।

আর একটা কারণ, সম্ভবত সেই উত্তর ও মধ্য ভারতের ধর্ম রাজনীতি ও সংস্কৃতির আগ্রাসন। আমরা হিন্দু ধর্ম, হিন্দু ধর্মীয় উৎসব বলতে বুঝি উত্তর ভারতীয় প্রথার উদ্‌যাপন। তা নবরাত্রি ডান্ডিয়া নাইটই হোক বা করভা চৌথ। রাজনীতির প্রশ্নে আমাদের আলোচনায় থাকে নরেন্দ্র মোদী বা রাহুল গাঁধী। চলচ্চিত্র, সাহিত্য, সব ক্ষেত্রেই উত্তর ভারত না হোক, হিন্দি বলয়ের দাপট বজায় থাকে।

তাই প্রশ্নটা রাবণবধের জান্তব উল্লাস সমর্থন করব না কি করব না, সেটা নয়। রাজনীতির সামনে আদৌ কোনও বিকল্প অবস্থান রাখতে পারব, না কি পারব না? রাবণ বধ এ ক্ষেত্রেও প্রতীক। অশুভ শক্তির বিনাশের নয়— প্রতিবাদের, এক বিকল্প শক্তির প্রতীক। যেমন ‘ভীম দল’-এর চন্দ্রশেখর, যেমন মোতিরাবণ কানগালে, যেমনটা বিরা সাথিদার। আরও দলিত উপজাতির মুখ, যাঁরা আর্য আগ্রাসনের সামনে মাথা তুলতে চাইছেন।

প্রতি বছর রাবণবধের কথা ভেবে শিউরে উঠবে অমৃতসর। রামলীলায় দলবীরের জায়গায় অভিনয় করবেন অন্য কেউ, কেঁপে উঠবে বেঁচে যাওয়া আটটি প্রাণ, দলবীরের স্ত্রী-সন্তান। রাবণবধ হল দশেরায়, রাবণবধ হল ট্রেনে। রাবণবধ হল দলবীরের। এমন দশেরা, এমন প্রথা থামতে পারে না?

অন্য বিষয়গুলি:

Dussehra Festivity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE