গত অক্টোবরে অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে আবেদন জানান যাতে যে সমস্ত মহিলা যৌন হেনস্তা বা যৌন হিংসার শিকার হয়েছেন, তাঁরা নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া স্টেটাস-এ #মি টু লিখে শেয়ার করলে বিশ্ব জুড়ে যৌন হয়রানির সমস্যার বিশালতার একটা ধারণা হবে, তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি কত বড় একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে। তার পর থেকে হলিউড, বলিউড, তাবৎ বিনোদন জগৎ, আমেরিকা ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকার সাধারণ মেয়েদের মধ্যে, এমনকী বহু পুরুষের থেকেও বিপুল সাড়া পাওয়া গেল। জানা গেল দেশ-সভ্যতা-সংস্কৃতি নির্বিশেষে গোটা পৃথিবীতে কী সাংঘাতিক পরিমাণে যৌন হয়রানি আর নির্যাতন হয়ে চলে নিয়মিত। এটা শুধু পেশাদার জীবনের সমস্যা নয়, সমস্যা শুরু হয় অনেক ছোট বয়স থেকে। বাড়ি, স্কুল, কলেজে; কিংবা পরিবারের মধ্যে। আত্মীয়, শিক্ষক, অধ্যাপক, বন্ধু, গাড়ির ড্রাইভার, স্কুল বাস ড্রাইভার— যে কেউ অপরাধী হতে পারেন। সম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতার একটি স্কুলে চার বছরের শিশুটির যৌন অত্যাচারের কথা আমরা শুনলাম। সে ঘটনার এখনও নিষ্পত্তি না হলেও আমরা জানি, শৈশব থেকেই এই অসহায়তা আমাদের কী ভাবে তাড়া করে। সবই তত ভয়ংকর নয়, তবু যখন শিশুদের ভাল-মন্দ বোঝার বয়স হয়নি, তখন থেকেই কিছু না কিছু যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা, এবং সেটা গোপন করে রাখার অভিজ্ঞতা প্রায় সর্বজনীন, বলা যেতে পারে।
বাবা-মা হিসেবে কী তা হলে করণীয়? ২০১৪ সালে কলকাতায় একটা গবেষণা করা হয় প্রায় ২৫০ জন স্কুল-কলেজ ছাত্রী, চাকরিজীবী মহিলা, গৃহকর্মী ও অসংগঠিত শ্রমিক, এবং যৌনকর্মীদের সন্তানদের সঙ্গে— তাদের যৌন হয়রানির ধরন এবং তার থেকে তৈরি মানসিক চাপ ও সমস্যার ধরন নিয়ে জানার জন্য। স্কুলছাত্রীরা জানায় যে, তাদের বাবা-মায়েরা অনেক সময়ই তাদের সমস্যার কথা কিছুই জানেন না। তারা বলতে ভয় পায়, লজ্জা পায়, অনেক সময় বাবা-মায়েরা স্বীকার করতেই চান না যে এ রকম কিছু হতে পারে। মধ্য কলকাতার এক স্কুলের প্রিন্সিপাল আমাকে তাঁদের স্কুলে গবেষণা করার অনুমতি দিতে পারেননি, তাঁদের অভিভাবক বা বাবা-মায়ের আপত্তিতে। অনেক সময় বাচ্চারা কিছু বলে না কেননা জানাজানি হলে নির্যাতনকারী তাদের আরও ক্ষতি করতে পারেন, এই ভয় থাকে তাদের। অন্য দিকে, যৌনকর্মীরা কিন্তু তাঁদের সন্তানদের বিপদ সম্বন্ধে অনেক সচেতন, সতর্ক। এই ধরনের গবেষণাতে তাঁরা সানন্দে সম্মতি দেন, এবং ভবিষ্যতে তাঁদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের সাহায্য চেয়ে রাখেন। তার অর্থ— সমাজের বিভিন্ন কোণে সমাজের আচরণ বিষয়ে ধ্যানধারণার অনেকটা পার্থক্য থাকে।
কত দিক থেকে কন্যাসন্তান বিপন্ন হতে পারে? ১) বাবা-মায়ের পুরুষবন্ধুরাই অনেক সময় বন্ধু-সন্তানকে নির্যাতন করেন। তাঁরা বন্ধুত্বের সুযোগে নেন, কিন্তু বাচ্চারা বাবা-মারই বন্ধুর কথা তাঁদের খুলে জানাতে পারে না। অর্থাৎ সামাজিক ঘনিষ্ঠতার আড়ালটাই এখানে মূল সমস্যা। ২) প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনরাও সংশয়োর্ধ্ব নন, তাঁরাও একই আড়াল ব্যবহার করেন। কত সংখ্যক শিশু নিজেরা কাঁদতে কাঁদতে জানিয়েছে, তাদের মামা দাদা কাকু জেঠুরা তাদের শারীরিক ভাবে স্পর্শ করেছেন, জানলে অবাক হতে হয়। ৩) অপরিচয়ের আড়াল আবার আর এক রকমের সমস্যা। স্কুলবাস বা পুলকারের ড্রাইভাররা মনে করতে পারেন, তাঁদের টিকিটি অনেক দূরে, সেই অবধি অভিভাবকের নাগাল পৌঁছবে না। শিশুরা অনেক সময় গাড়িকাকুদের ভয়ও পায়, কেননা এদের উপর তাকে এমন সময় নির্ভর করতে হয়, যখন তার সঙ্গে বাড়ির লোক থাকে না। ফলে নিগৃহীত হলেও কন্যারা বাড়িতে জানাতে চায় না।
৪) পুরুষ প্রাইভেট টিউটর বা কলেজের শিক্ষকরা নির্যাতন করলে সমস্যাটা প্রবল আকার ধারণ করতে পারে। এখানে ক্ষমতার একটা স্পষ্ট ব্যবহার থাকে। বিশেষত তাঁরা খ্যাতনামা হলে তো কথাই নেই। তাঁদের ক্যারিশমার পাশে ছাত্রীদের অভিযোগ কে-ই বা শোনে? এমনকী, দেখা যায়, অপরাধ প্রমাণিত হলেও সামাজিক ভাবে ‘ব্লেম দ্য ভিকটিম’ অ্যাটিটিউড কাজ করতে থাকে। সুযোগ বা উন্নতির লোভে মেয়েটি নিশ্চয়ই নিজেই এগিয়ে গিয়েছে: এমন অভিযোগ থামানো যায় না। এই পরিস্থিতিতে মেয়েটির অসহায়তা সহজেই অনুমেয়।
এগুলি অবশ্যই সাধারণ ধরন। এর অর্থ এই নয় যে, সব রকম পুরুষ-সংসর্গ বাঁচিয়েই কন্যাকে বড় করতে হবে। কিন্তু কোথা থেকে বিপদ আসতে পারে, সেটা নিজেরা জানা, এবং সেই মতো কন্যার দিকে নজর রাখা, এটা অত্যন্ত জরুরি কাজ।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy