রা জস্থানে কর্মরত আফরাজুল খানের মৃত্যুর বীভৎসতার স্মৃতি ম্লান হইবে। কিন্তু শ্রমিকের নিরাপত্তার কী হইবে? প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা কম নহে। তিন মাস পূর্বে নদিয়ার যুবক বাসিরুল শেখ গণপ্রহারে প্রাণ হারাইয়াছে বেঙ্গালুরুতে। তাহার সঙ্গীরাও প্রহৃত হইয়াছিল। সেই ঘটনায় কাহারও শাস্তি হয় নাই। ভিনরাজ্য হইতে আগত শ্রমিকদের উপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন, কার্যত অবরুদ্ধ রাখা, অমানবিক পরিবেশে, অর্ধাহারে তাহাদের বাস করিতে বাধ্য করা, মজুরি হইতে বঞ্চনা, এমন নানা ঘটনা অহরহ ঘটিয়া চলিয়াছে। কিন্তু সেই সব ঘটনা কি রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক সংগঠন, শ্রম আধিকারিকদের বিচলিত করিয়াছে? আফরাজুলের ঘটনায় জনমানসে ক্ষোভ দেখা দিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজস্থান সরকারকে বার্তা দিয়াছেন, সে রাজ্যে কর্মরত তিন হাজার বাঙালি শ্রমিককে নিরাপত্তা দিতে হইবে। সে রাজ্যের শীর্ষস্তরের পুলিশকর্তার সহিত এ বিষয়ে কথা বলিতেও নির্দেশ দিয়াছেন রাজ্য পুলিশের কর্তাদের। জরুরি পদক্ষেপ, সন্দেহ নাই। বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়া মুখ্যমন্ত্রী অন্তত তাঁহার দলের নেতা এবং রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাদের নিকট একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করিলেন। কারণ প্রবাসে কর্মরত বাঙালি শ্রমিকদের প্রতি এ রাজ্যের প্রশাসন সংবেদনশীল, তাহাদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিকার করিতে পুলিশের কর্তারা তৎপর, এমন ইঙ্গিত আজ অবধি মেলে নাই।
বরং উল্টা সাক্ষ্য মিলিয়াছে। প্রশাসন কর্তা, পুলিশ বা জনপ্রতিনিধিদের নিকট কোনও সহায়তা না পাইবার ফলে কর্ণাটকে কর্মরত বাঙালি শ্রমিকরা সংগঠন গড়িয়াছেন। আইনজীবী, সমাজসেবীরা তাঁহাদের সহিত হাত মিলাইয়াছেন। এই সংবাদ আশান্বিত করে, কিন্তু বিষণ্ণও করে। শ্রমিক আন্দোলনের জন্য যে রাজ্যটি গোটা দেশে ‘সুনাম’ কিনিয়াছে, সেখানে যে নেতৃত্বহীন শ্রমিকদের নিরাপত্তার সন্ধানে নূতন মঞ্চ গড়িতে হইতেছে, ইহার চাইতে বড় আক্ষেপ কী হইতে পারে? এতগুলি শ্রমিক সংগঠনের নেতারা কি ঘুমাইতেছেন? না কি শ্রমিকের নিরাপত্তা লইয়া আন্দোলনে রাজনৈতিক ফায়দা নাই বুঝিয়া মুখ ঘুরাইয়াছেন? ইহা লক্ষণীয় যে নিহত আফরাজুলের বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী দুই মন্ত্রী ও তিন সাংসদকে পাঠাইয়াছেন, কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে শ্রমমন্ত্রী নাই, শ্রমিক নেতাও কেহ নাই। আফরাজুলের ন্যায় কয়েক হাজার প্রবাসী নির্মাণশ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য পশ্চিমবঙ্গের শ্রম দফতর কেন উদ্যোগী হয় নাই, তাহার জবাবদিহি করা হইবে কি না, তাহাও জানা যায় নাই। অথচ আফরাজুল বা বাসিরুলদের হত্যা, লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের চরম দুর্ভোগ ও বঞ্চনা নেহাত দুর্ভাগ্য নহে। এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত যে প্রবাসী শ্রমিকের অসহায়তার সুযোগ লইয়াই তাহাদের শোষণ-নিপীড়ন করিতেছে, তাহা সুবিদিত।
প্রস্তাব উঠিয়াছে, প্রতি রাজ্যে শ্রমিকদের জন্য সংযোগ রক্ষাকারী এক জন অফিসার নিয়োগ করিতে হইবে। তাহাতে ক্ষতি নাই। কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকের স্বার্থরক্ষার যে সকল ব্যবস্থা আইন করিয়া বলবৎ করা হইয়াছে, সেগুলি মানা হইয়াছে কি? প্রায় চার দশক পুরাতন এই আইনে সুরক্ষাকবচ কম নাই। আইন অনুসারে, ভিনরাজ্যে কর্মরত শ্রমিককে মজুরি ব্যতীত বাড়তি অনুদান, চিকিৎসা, এমন নানা সুবিধা দিতে হইবে। শর্ত মানিতে ঠিকাদার সংস্থা এবং নিয়োগকারী সংস্থা, উভয়েই দায়বদ্ধ। শর্ত মানা হইতেছে কি না, দেখিবার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের শ্রম দফতরের কর্মীদের। দুঃখের বিষয়, ওই কর্মীদের সহিত অসৎ ঠিকাদারের অসাধু আঁতাতের জন্য শর্তগুলি অপূর্ণ থাকিয়া যায়। ভারতে অন্তত আট কোটি শ্রমিক ভিনরাজ্যে কর্মরত। এ রাজ্যেও অপর রাজ্যের শ্রমিক রহিয়াছেন। তাঁহারা কি সুরক্ষিত?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy