একটা রটনা উড়ছিল: বাংলার শাসক দল এখন অনেক উদার। আসলে অম্বিকেশ, শিলাদিত্য, বেয়াড়া প্রশ্ন শুনে প্রশ্নকর্তাকে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে মঞ্চ ছেড়ে উঠে যাওয়ার আখ্যান অনেকটা পুরনো হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া অনেক লোক আশাবাদী হয়, তারা ভাবে, মানুষ তো আস্তে আস্তে নিজেকে বদলায়, কেউ হয়তো শিখে যাবে যে সমালোচনার অধিকার সভ্য সমাজে আছে। তার ওপর ‘পদ্মাবত’ কাণ্ড। দেশ জুড়ে হুলুস্থুলু পড়ে গেল, টিভি চ্যানেলে তৃণমূল নেতারা দাপিয়ে হাঁকতে লাগলেন, বিজেপি মহা-গোঁড়া (করণী সেনা বিজেপিরই দর্শনতুতো ভাই) আর আমরা বাক্স্বাধীনতার প্রকাণ্ড ধ্বজাধারী, এই বাংলায় কারও কথা বলার অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। বাঙালি ফিল্ম পরিচালকরাও টক-শো’তে নাক নেড়ে বলে এলেন, হ্যাঁ, এখানে ও-সব হয় না। বিধাতা তখন খ্যাঁকখ্যাঁক হাসছিলেন।
ভারতে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের মূল মেজাজটা অশিক্ষিত। প্রত্যেক দলেই কিছু লোক আছেন যাঁরা ভীষণ শিক্ষিত, সব অর্থেই। পড়াশোনাও জানেন, সংস্কৃত ও মুক্ত মনোভাবেরও সমর্থক। এঁদের দু’রকম পরিণতি হয়। কাউকে বছর দুয়েক-তিনেকের মধ্যে মার্জিনে চেপে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, দলে থাকবেন, কিন্তু আগে যেমন সভাসমিতি মিছিলমিটিঙে দেখা যেত, তা হবে না। তাঁরা কতকটা স্বেচ্ছায়, কতকটা বাধ্য হয়ে সরু হয়ে ধারে বসে থাকেন। নিজেকে জপিয়ে নেন, এই তো বেশ কবিতা লিখছি ছবি আঁকছি ক্ষতি কী? আর কিছু শিক্ষিত লোক শিক্ষাটাকে অ্যাক্কেরে মুচড়ে পকেটে ভরে নিয়ে, মেজরিটি অশিক্ষিতের দলে ভিড়ে মুষ্টি তুলে ডবল চিল্লাতে থাকেন, আর নিজেকে বলেন, আগে তো লাগাতার আন্দোলনের মাধ্যমে মাটিতে স্বর্গ নেমে আসুক, ছাপ্পা ভোটের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত হোক, অন্য প্রার্থীকে মেরে পাট করে মনোনয়ন জমা দিতে না-দেওয়ার মাধ্যমে একটা অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণ লীলা করুক, তার পর ও-সব সূক্ষ্ম জটিল ন্যায়নীতির কথা তোলা যাবে। ফলে দলের যে লাইন, মূল প্রবণতা, তা সব সময় অশিক্ষার দিকে হেলে থাকে, কারণ শিক্ষিত ধারণা ও ভাবনা বেশি ক্ষণ বেশির ভাগ লোককে টেনে রাখতে পারে না। বা, বলা ভাল, অশিক্ষিত চিন্তা ও কাজ অনেক দ্রুত বেশির ভাগ লোককে দলে টেনে নেয়।
তাই গোটা দেশ জুড়েই, সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে, বাক্স্বাধীনতার সিধে মানে হল, আমার যে-মত পছন্দ, শুধু তা প্রকাশ করার স্বাধীনতা। তাই বিজেপি যদি সিনেমা বন্ধ করতে চায়, তখন তৃণমূল ভাবতেই পারে না এমন বর্বর কাজ কেউ করতে পারে, তখন তৃণমূলের মুখে ‘গণতন্ত্র’, ‘মতপ্রকাশের অধিকার’, ‘মানুষকেই বুঝে নিতে দাও না, সিনেমাটা ভাল না খারাপ’ লব্জ ভুট্টাভাজার মতো ফুটতে থাকে। তার পর অনীক দত্তের ছবি এলেই, আর তাতে কিছু বেয়াড়া ইয়ার্কি মারা হলেই, বাক্স্বাধীনতার প্রকৃত সংজ্ঞাটায় কিঞ্চিৎ পানের পিক, থুতু, গয়ের এসে পড়ে এবং চির-আরাধ্য মানুষের বোধ ও বিচারের ওপর আর একটুও ভরসা না রেখে, রুলের গুঁতোর ওপর প্রবল বিশ্বাস স্থাপন করে, ছবিটা হল থেকে তুলে দেওয়া হয়। এ জিনিস আমাদের মজ্জাগত। যে ছাত্রেরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাহত হচ্ছে বলে রগরগে মিনি-বিপ্লব ফলায়, তারাই উল্টো-মতের সিনেমা ক্যাম্পাসে দেখাতে দেয় না। তাই এই থেঁতোবাজি আজ তৃণমূল করছে, গতকালও বামফ্রন্ট ‘নন্দন’ থেকে তার অপছন্দের ফিল্ম তুলে দিয়েছিল, আগামিকালও অন্য দল বলবে, ‘সেক্সি দুর্গা’ নামের ছবি তো চলতে দেবই না, কোনও গল্পে গরুর নাম মহেশ রাখতেও দেব না, সে গরু যদি আবার মুসলমানের হয়।
কিন্তু জুলুমবাজিরও তো একটা হিসেব থাকে! এই যুগে সিনেমা নিষিদ্ধ করা সব দিক থেকে অ-লাভজনক। সোশ্যাল মিডিয়ায় সুপার-শনশন নিন্দে শুরু হয়ে যাবে, যা হয়তো ছবিটা যে নিন্দে তৈরি করত তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি। ছবিটা হল-এর বদলে ইন্টারনেটের কোথাও না কোথাও ঠিক প্রকাশিত হবে ও লক্ষ গুণ বেশি দর্শক টানবে। তার চেয়ে বড় কথা, ক্ষমতা বেশি দিন ভোগ করতে গেলে পরিণতমনস্ক হতে হয়, দণ্ডডান্ডা হাঁকড়াতে গেলেও বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হয়। যখনই অনীকবাবু ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেই উক্তিটা করেছিলেন, তখনই লোকে বলেছিল, আপনাকে এখানে আর কাজ করতে দেবে না। একটা প্রকৃত সপ্রতিভ ক্ষমতাকেন্দ্র করত কী, অনীকবাবুকে কোনও বাধাই দিত না, একদম নিজের মতো কাজ করতে দিত। তাতে ছবিটা যদি নিজেই দু’তিন সপ্তাহে উঠে যেত, তা হলে তো মিটেই গেল। পানাপুকুরে একটি তরঙ্গও উঠত না। যদি হিটও হত, তখন এটুকু সবাই বলত: কিন্তু খেয়াল করো, ও রকম কথা বলল, তার পর এমন চিমটি-কাটা রসিকতা করল, কিন্তু তাকে এতটুকু বাধা দিল না! তার মানে কতটা উদার! ব্যঙ্গকৌতুকের বিষদাঁত আপনিই কিছুটা ভেঙে পড়ত। আরও দুরন্ত কাজ হত অবশ্য বছরশেষে অনীকবাবুকে একটা পুরস্কার দিয়ে দেওয়া। মমতাই অনীকের হাতে প্রাইজ় তুলে দিয়ে মাইকে বলতেন, ‘‘ইনি খুব ভাল স্যাটায়ার করেন। আপনারা হাততালি দিন।’’ খেল খতম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy