Advertisement
১৯ মে ২০২৪
ধর্ম বলতে ঠিক কী বোঝায়, সেটা বুঝতেই বিরাট ভুল হয়ে যাচ্ছে

আর, ধর্মীয় মানবতা?

মানবিকতা জিনিসটাও সে রকম। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সব ধর্মেই মানবিকতা আছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ সিনেমাটা অনেকে দেখেছেন।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

বেথুন কলেজের দেখাদেখি বাংলার বেশ কিছু কলেজ এ বার ভর্তির নিয়মে হাস্যকর ও অর্বাচীন এক কাণ্ড করল। ধর্মের ঘরে শুধু হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান লিখেই ক্ষান্ত না হয়ে মানবতা শব্দটিও উল্লেখ করা হয়েছে। এই মানবতা ধর্মটি ঠিক কী? কে এর উদ্ভাবন করেছেন? এই ধর্মের মূল সূত্রগুলি কী? ধর্মগ্রন্থটি কোথায়, কবে, কোন ভাষায় লেখা হল? কিছুই ঠিক পরিষ্কার হল না।

আসলে, মানবতা বা মানবিকতা আলাদা ‘বর্গ’— ধর্ম আলাদা। এই কলেজগুলিতে যাঁরা হিন্দু, মুসলমান বা খ্রিস্টান বলে নিজেদের ঘোষণা করবেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ কি তাঁদের ‘অমানবিক’ ধরে নেবেন? ধরুন, যে সব প্রাণী ঘাস খায়, ফর্মে তাদের নামের পাশে টিক দিতে বলা হল। প্রাণীগুলির নাম: ক) তৃণভোজী, খ) গরু, গ) মোষ, ঘ) ছাগল। এ বার কী করা? গরু, ছাগল সবাই তো তৃণভোজী!

মানবিকতা জিনিসটাও সে রকম। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সব ধর্মেই মানবিকতা আছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ সিনেমাটা অনেকে দেখেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি পার্টির সমর্থক, অস্কার শিন্ডলার নামে এক জার্মান ব্যবসায়ী কী ভাবে সহস্রাধিক ইহুদির জীবন বাঁচিয়েছিলেন, তা নিয়ে ছবি। খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ছিলেন শিন্ডলার। তার সঙ্গে মদ্যপ, লম্পট, ঘুষখোর অনেক কিছুই ছিলেন। তিনি হঠাৎ ইহুদিদের গ্যাস-চেম্বার থেকে বাঁচাতে গেলেন কেন? বহু পরে নিউ জার্সিতে মুরে পান্টিয়ের নামে এক ইহুদি বন্ধুকে শিন্ডলার বলেছিলেন, ‘‘আমার মনে হয়েছিল, জার্মানরা ভুল করছে। নিরীহ মানুষকে ও ভাবে বিনা কারণে কোতল করা যায় না। ওই নৃশংসতা থেকে লোককে বাঁচাতে আমার যেটুকু করা উচিত ছিল, সেটাই করেছি। এর বেশি কিছু নয়। দ্যাটস অল, নাথিং মোর টু ইট।’’ কলকাতার কলেজশিক্ষা ছিল না বলেই হয়তো মানবিকতা-টানবিকতা গোছের গালভরা শব্দ বলেননি শিন্ডলার!

সিনেমায় যেটা দেখানো হয়নি, সেটা বলি। অস্কার শিন্ডলারের জন্ম অধুনা চেক প্রজাতন্ত্রে, ধর্মভীরু খ্রিস্টান পরিবারে। পাশের বাড়িতে ছিলেন এক ইহুদি যাজক। তাঁর পুত্রকন্যারাই ছিল অস্কারের খেলার সঙ্গী। এই অস্কার শিন্ডলার কোনও ব্যতিক্রম নন। মহাযুদ্ধের সময় চিউনে সুগিহারা নামে এক জাপানি লিথুয়ানিয়ায় জাপানি কনসাল ছিলেন। নিয়ম না মেনে লিথুয়ানিয়ার প্রায় ২১০০ ইহুদি শরণার্থীকে জাপান হয়ে ট্রানজ়িট ভিসা দিয়েছিলেন। লোকগুলি প্রাণে বেঁচে যায়। মহাযুদ্ধের পর ইজ়রায়েল সুগিহারাকে সম্মানিত করে। সে সময় তিনিই ইজ়রায়েল থেকে সম্মানিত একমাত্র জাপানি নাগরিক। তৎকালীন মধ্যবিত্ত জাপানি পরিবারের সন্তান এই সুগিহারাও কোনও মানবধর্মে দীক্ষিত নন, তাঁর জন্ম জাপানের এক বৌদ্ধ মন্দিরে।

নেতাজি যুদ্ধক্ষেত্রে শিবিরে বসে গীতা পড়তেন। এ দিকে আবিদ হাসান ও বহু মুসলমান ও খ্রিস্টান সহযোগীদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। জাতপাত না মেনে আর্মি ক্যান্টিনে সকলে একসঙ্গে খেতেন। এর জন্য তাঁকে কোনও মানবধর্ম পড়তে হয়নি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, নেতাজি, এ সব পুরনো ঘটনা। ১৯৯২ সালে বাবরি-মসজিদ ধ্বংসের পর আশিস নন্দী ও অন্যান্যরা হিংসার মনস্তত্ত্ব নিয়ে সেখানে কাজ করতে যান। আশিস উল্লেখ করেন, এক হিন্দু ডাক্তার পুত্রের হাতে বন্দুক তুলে দেন, ‘‘যদি আমাদের মুসলিম প্রতিবেশীরা কেউ আক্রান্ত হয়, দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবহার কোরো। আমরা রামভক্ত, প্রতিবেশীদের বাঁচানো আমাদের ধর্ম।’’ রামচন্দ্রের নাম করে ধর্মের কথা বলেছিলেন তিনি। আলাদা কোনও মানবধর্মের কথা বলেননি।

ফাঁকটা এখানেই। সব ধর্মের মধ্যেই মানবিকতার জায়গা আছে, আবার যাঁরা ধর্ম মানেন না, তাঁরাও মানবতাবাদে বিশ্বাস করেন। যুদ্ধ বা দাঙ্গায় যারা ভিন ধর্মের ‘শত্রু’কে বাঁচায়, দেখা যায় তারা বেশির ভাগই ধর্মভীরু পরিবারের সন্তান। ভারতের সমস্যাটা আরও গভীরে। উনিশ শতকের আগেও ইংরেজি ‘রিলিজিয়ন’ শব্দটার প্রতিশব্দ কোনও ভারতীয় ভাষায় ছিল না। ছিল না অনড় কোনও ধর্মীয় পরিচিতি। হিন্দুসন্তান অশোক বৌদ্ধ হয়েছিলেন। আকবর ও তাঁর উত্তরসূরি মুঘল বাদশাহেরা নিজেকে মুসলমান বলতেন। তাঁদের হিন্দু স্ত্রী’দের জন্য প্রাসাদে মন্দির থাকত। অওধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ শিয়া মুসলমান, কিন্তু প্রাসাদে রাসলীলার আয়োজন করতেন, কৃষ্ণ সাজতেন।

বেথুন কলেজ তাই প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে দেখতে পারে। দেশের প্রথম মহিলা স্কুল, প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খ্রিস্টান জন ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন, হিন্দু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও রামগোপাল ঘোষ। প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই একটা সহিষ্ণুতার বার্তা আছে, সেখান থেকেই সে যুগে তাঁরা নারীশিক্ষা বিস্তারের কাজটা করেছিলেন, কাউকে ‘মানবতাবাদী’ বা ‘নারীবাদী’ গোছের ছাতার নীচে দাঁড়াতে হয়নি। ‘সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ’ এই বৈদিক মন্ত্রের মধ্যে কি মানবতা নেই? ‘‘যে তোমাকে বঞ্চিত করে, তাকে দান করো, যে তোমাকে অত্যাচার করে তাকে ক্ষমা করো’’, কোরানের এরাফ সুরায় হজরত মহম্মদকে বলছেন দেবদূত জিব্রিল। মানবতাবাদ কি এর চেয়ে আলাদা? বাঙালি কথায় কথায় ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ বলে যে পদটি আওড়ায়, সেই পদকর্তা চণ্ডীদাসও বাশুলি মায়ের ভক্ত ছিলেন।

বেথুন-সহ বাংলার কলেজগুলি তাই ভয়ঙ্কর ভুল করছে। ধর্মীয় মানবতাকে অস্বীকার করে উনিশ শতকের আলোকপ্রাপ্তি ও ইউরোপীয় চেতনাকে নকল করে ‘মানবিকতা’ নামে আর একটি বর্গের আমদানি করছে।

একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। তা হলে কি ‘অবিশ্বাসী, নাস্তিক মানবিকতা’ বলে কিছু হয় না? স্পষ্ট করে বলা দরকার, হ্যাঁ অবশ্যই হয়। কিন্তু তাঁদের অস্তিত্ব ধার্মিক মানবিকদের বাতিল করে দিতে পারে না। চার্বাকপন্থীরা যাগযজ্ঞ, পরলোক, ঈশ্বর মানতেন না, নাস্তিক ছিলেন। গৌতম বুদ্ধ ঈশ্বর আছে কি না, স্পষ্ট কথায় উত্তর দেননি। বলেছিলেন ‘অকথনীয়’। মানে, কথা বলে যা বোঝানো যায় না। কিন্তু তিনি বৈদিক যজ্ঞ ও পশুবলির বিরোধী ছিলেন, সুতরাং নাস্তিক বলাও যেতে পারে। সাহেবরা এসে ‘এথিস্ট’ নামে একটা শব্দ শিখিয়ে গেল, আর আমরা এই তো নাস্তিক্যবাদ পেলাম, আধুনিক হলাম বলে নাচানাচি শুরু করলাম, ব্যাপারটা আদতে সে রকম নয়। জিন্না যতই পাকিস্তান করুন, ব্যক্তিজীবনে তিনি নাস্তিক ছিলেন। সাভারকর যতই হিন্দুত্বের কথা বলুন, ব্যক্তিজীবনে নাস্তিক ছিলেন, বলে গিয়েছিলেন, হিন্দু আচার মেনে যেন তাঁর শেষকৃত্য না হয়! যে সব কলেজ ভর্তির ফর্মে ‘মানবিকতা’ না লিখে বরং ‘অবিশ্বাসী’ বা ‘আনবিলিভার’ লিখছে, তারা তাই ঠিক পথে আছে। কিন্তু হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টানের সঙ্গে মানবিকতাকে একটা ‘অপশন’ হিসেবে রাখাটা শুধু হাস্যকর নয়, মূর্খামিও বটে!

কেউ কেউ বলবেন, ধর্মের ‘অপশন’টি তুলে দিলে কেমন হয়! গণতন্ত্রের নিয়মেই হয়তো সেটি সম্ভব নয়। গণতন্ত্র মানে প্রশাসনিকতার নিস্পৃহ পরিসংখ্যানও বটে, সে খবর নিতে পারে, ক’জন হিন্দু মেয়ে কলেজে ভর্তি হন, মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের অনুপাতটাই বা কত! সেখান থেকেই আসতে পারে সংস্কারের পরিকল্পনা। ধর্মে তাও হিন্দু-মুসলমান-নাস্তিক সব কিছু একত্রে হওয়া যায়, কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতর্কটির মধ্যে থাকে সব কিছুকে এক ছাঁচে ঢেলে সাজানোর হিংসাত্মক মনোভাব। সেটিকে যথাযথ পথে আনতে মানবিকতা নয়, অবিশ্বাসীর ‘অপশন’টি জরুরি। এমনকি ধর্ম বিষয়ক তথ্য যদি কেউ না দিতে চান, সেই ‘অপশন’টাও রাখা উচিত।

ধর্ম নিয়ে এখন যে বাড়াবাড়ি চলছে, তার পাল্টা এই পদক্ষেপ, বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু একটা অন্যায় রুখতে কি আর একটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া যায়? ধর্মীয় পরিচিতির থেকে মানবধর্মকে আলাদা করে দেওয়া, আর যা-ই হোক, ধর্ম ও রাজনীতির ককটেলকে রুখবার ঠিক রাস্তা নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Religion History Minority
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE