সকাল থেকেই আর তর সইছিল না সাত বছরের ছোট্ট মেয়ের। ঠাকুমা বলে রেখেছেন, দুর্দান্ত একটা অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবেন। খাওয়াদাওয়া হবে, বেড়ানো হবে। তাড়াতাড়ি স্নান করে সব চেয়ে পছন্দের ফুল-ফুল ফ্রকটা পরে নিয়েছিল সে।
মুম্বইয়ের ভিন্ডি বাজারের জীর্ণ একটা বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন ঠাকুমা। সেখানে ছিলেন এক অপরিচিতা ভদ্রমহিলা। ঠাকুমা সেখানে তাকে প্যান্ট খুলতে বললেন! ছোট্ট মেয়ে থতমত। ঠাকুমা এমন বলছেন কেন? কিন্তু কোনও কথা না-শুনে জোর করে প্যান্ট খুলে মাটিতে শুইয়ে দিলেন ঠাকুমা, তার পর দু’হাত ঠেসে ধরলেন মাটির সঙ্গে। অন্য মহিলা পা দুটো ফাঁক করে চেপে ধরলেন। ধারাল ব্লেড ক্ষতবিক্ষত করল ছোট্ট শরীর। তীব্র যন্ত্রণা!
ঠাকুমা নির্বিকার! রক্তে ভেসে যাওয়া ক্ষতে গজ-তুলো গুঁজে প্যান্ট পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘‘চিৎকার কোরো না। ভূতে ধরবে। তুমি আজ থেকে পবিত্র হলে। কিছু দিনের মধ্যে ব্যথা কমে যাবে।’’ পরবর্তী বিয়াল্লিশটা বছর অসহায় ক্ষোভ তাড়া করেছে মাসুমা রানালভিকে।
একই অভিজ্ঞতা তাঁর মতো অনেকের, যাঁরা একটি বিশেষ ধর্মমত অনুসারী গোষ্ঠীর মেয়ে। শুধু এটি নয়, দুনিয়ার কিছু কিছু দেশে কয়েকটি ধর্মগোষ্ঠীতে এই ‘ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন’ (এফজিএম) বা ‘খতনা’র রীতি প্রচলিত রয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেই সব গোষ্ঠীর মেয়েদের একাংশ যুগযুগান্ত ধরে বয়ে বেড়ানো এই প্রথার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে শুরু করেছেন প্রতিবাদ: এফজিএম-বিরোধী আন্দোলন। যার প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল, সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে প্রকাশ্যে এর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারা। রাষ্ট্রপুঞ্জও এই প্রথার ঘোর বিরোধী। গ্যাম্বিয়া সোমালিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের মেয়েরা আগেই ওয়েবসাইটে, ব্লগে, ফেসবুকে, টুইটারে, ইউটিউবে সরব হয়েছেন ‘খতনা’-র বিরুদ্ধে। এ বার ভারতের মেয়েরাও জানাচ্ছেন, কী ভাবে শরীর ও মনে এই প্রথার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।
ভারতে ‘খতনা’ নিষিদ্ধ করার দাবিতে দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে গত ৯ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ‘‘কারও শরীরের অচ্ছেদ্যতা কী ভাবে ধর্মীয় প্রথার অংশ হতে পারে? কারও যৌনাঙ্গে অন্য কারও নিয়ন্ত্রণ থাকবে কেন?’’ এই মামলাকে সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঠানোর আবেদনও খারিজ করেছে শীর্ষ আদালত। গত ৩১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট আরও বলেছে, নাবালিকাদের দেহে জেনিটাল মিউটিলেশনের জন্য আদালত ডাক্তারদের নির্দেশ দিতে পারে না, আর তা দেবেই বা কেন? কেন্দ্রীয় সরকারও সমর্থন করছে আন্দোলনকারীদের। গত বছর জানুয়ারিতে দিল্লির যে মহিলা আইনজীবী এই মামলা দায়ের করেছিলেন সেই সুনীতা তিওয়ারি বলছিলেন, ‘‘একেবারে ছোটবেলায় যখন বোধবুদ্ধি বা প্রতিবাদের ক্ষমতা তৈরি হয় না তখনই মেয়েদের ‘ক্লিটরিস’ বা যৌন সুখানুভূতির প্রত্যঙ্গটি কেটে দেওয়া হয়! একটা বিশেষ শব্দবন্ধ চালু রয়েছে এই অঙ্গের— ‘হারাম কি বোটি’, অপবিত্র মাংসপিণ্ড। অতএব, তাকে নাকি শরীর থেকে দূর করাই শ্রেয়।’’
আসলে এ হল পিতৃতান্ত্রিককতার চাপিয়ে দেওয়া লিঙ্গবৈষম্যের চরম নিদর্শন। মেয়েদের আবার যৌন আনন্দ কিসের? এমন ব্যবস্থা করা যাক যাতে মেয়েদের সুখানুভূতির প্রত্যঙ্গটাকেই লোপাট করে দেওয়া যায়। ভারতে ‘খতনা’-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কর্মী আরিফা জোহরি জানালেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষণায় মহিলাদের যৌনাঙ্গ বিকৃত করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ভারতও তাতে সই করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখনও দাইমা বা বাড়ির বয়স্ক মহিলারা নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে এটা করে যাচ্ছেন অ্যানাস্থেসিয়া ছাড়া। ব্যবহৃত হচ্ছে ব্লেড, ছুরি, কাঁচি, ভাঙা টিন, ভাঙা কাচ— সব কিছু।
ইউনিসেফের ২০১৬ সালের হিসাবে আফ্রিকার একাধিক দেশ, ইন্দোনেশিয়া ইয়েমেন ইরাক কুর্দিস্তান মিলিয়ে প্রায় ২৯টি দেশে এই মুহূর্তে ২০ কোটি মহিলা রয়েছেন যাঁদের পাঁচ থেকে দশ বছর বয়সের মধ্যে খতনা হয়ে গিয়েছে। বেশ কিছু দেশের আইনে খতনা নিষিদ্ধ, কিন্তু আইনের ফাঁক গলে দিব্যি তা চলে। খতনা হয়েছে এমন চোদ্দো বছরের কমবয়সি মেয়েদের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি গ্যাম্বিয়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এ পদ্ধতির কোনও স্বাস্থ্যকর দিক নেই, বরং এর ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, সিস্ট, ঋতুকালীন সমস্যা, যৌন মিলনে তীব্র যন্ত্রণা বা মিলনে অক্ষমতা, এইচআইভি, সন্তানধারণ ও প্রসবের সময়ে জটিলতার মতো অজস্র সমস্যা তৈরি হয়। শিশু-মৃত্যুও হয় যথেষ্ট। এর বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন আফ্রিকান মহিলারাও। গ্যাম্বিয়ার মারিয়ামা জুফের কথায়, ‘‘তখন বয়স বছর পাঁচেক। আমাদের কয়েক জনকে একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে জোরে ড্রাম বাজানো হচ্ছিল আর এক এক জন মেয়েকে টেনে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে রক্তাক্ত করা হচ্ছিল। ড্রামের শব্দে ঢাকা পড়ছিল চিৎকার। পরের তিন সপ্তাহ একটা পাত্রে জলের মধ্যে ছাগলের মল মিশিয়ে গরম করে তার মধ্যে আমাদের বসিয়ে রাখা হত।’’ সোমালিয়ার মালকো জামা-র অভিজ্ঞতাও ভয়াবহ। ধারাল ছুরি দিয়ে তাঁর ক্লিটরিস ও লেবিয়াও কেটে ফেলা হয়। দড়ি দিয়ে শক্ত করে পা দু’টি বেঁধে দেয় দাই-রা। চার দিন ওই ভাবে একই জায়গায় বসে থাকতে হয়।
এই অমানবিকতার বিরুদ্ধেই মেয়েরা এখন আন্দোলনে একজোট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy