‘মাতৃতান্ত্রিক’: ত্রিতীর্থের প্রযোজনার ফাইল চিত্র
নিজের দলের জন্য তখন একের পর নতুন এক নাটক লিখছি। তার জন্য দেশী, বিদেশি নানা সাহিত্য লাগাতার পড়ছি। এই সময় আমি সমারসেট মম-এর 'দ্য সিক্রেট ফ্লেম' নাটকটি পড়ি। পড়ে আমার ভীষণ ভাল লাগে, তখন ভাবি যদি এই ঘটনাটাকে এ দেশীয় প্রেক্ষিতে নিয়ে এসে নতুন একটা নাটক লেখা যায়, তা হলে কেমন হয়? বেশ কিছু দিন নিজের মতো করে বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে থাকি। একটা সময় বিষয়টা আমার মাথায় খেলতে থাকে এবং নতুন ভাবে নাটকটা লিখতে শুরু করি।
নাটকের কাহিনিটা বেশ স্পর্শকাতর এবং একই সাথে বহুস্তরযুক্ত, বিষয়টি একটু খোলসা করে বললে তা স্পষ্ট হবে। একটিমাত্র পরিবারের ঘটনাকে ঘিরেই কাহিনির বিস্তার এবং নানা টানাপড়েনের জটিল বিন্যাস। বাড়ির বড় ছেলে পাইলট। তাই মা দুশ্চিন্তামুক্ত, তার ছেলে আজ নিজেই প্রতিষ্ঠিত। ফলে বেশ ধুমধাম করে তার বিয়ে হয়। স্ত্রীর সঙ্গে ছেলেও খুশি, বৌমাকে পেয়ে মা-ও খুব খুশি। বিয়ের ছ'মাসের মধ্যেই একটি প্লেন দুর্ঘটনা ঘটে, সে যাত্রায় ভাগ্যের জোরে বড় ছেলে বেঁচে যায়। কিন্তু ভীষণ ভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকে। খানিকটা সেরে উঠলে ডাক্তার তার মা ও স্ত্রীকে আলাদা ভাবে ডেকে জানান, "আর কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই, তবে ওর কোমর থেকে শরীরের নীচের দিকের অংশ চিরদিনের জন্য অকেজো হয়ে থাকবে। তা ছাড়া চিন্তার কিছু নেই, মেডিসিন ও ট্রিটমেন্ট দুইই চালিয়ে যেতে হবে। তাতে অনেকটা ভাল হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য হুইল চেয়ারে দিব্যি চলা ফেরা করতে পারবেন।’’ ডাক্তারের এই কথায় সেদিন দু’জনেই বাস্তবটা না মেনে নিতে পেরে আত্ম-যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন।
হাসপাতাল থেকে ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ছেলে নিজেই বুঝতে পারে তার শরীরের নীচের অংশটি সম্পূর্ণ অকেজো, যা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অন্যদিকে মা ও তার স্ত্রী আরও উন্নত চিকিৎসা করানোর কথা চিন্তা করে। নানা অপারেশন ও চিকিৎসা করেও শেষ পর্যন্ত কোনও লাভ হয় না। অবশেষে এই নির্মম বাস্তবটাকে ছেলে, মা এবং স্ত্রী মেনে নিতে বাধ্য হয়। বাড়িতে তাকে সর্বক্ষণ সেবা করার জন্য একজন দক্ষ অল্পবয়সী নার্সকে নিযুক্ত করা হয়। এ ভাবেই দিন গড়িয়ে চলে।
অন্যদিকে এই ঘটনা শুনে দুবাইতে থাকা ছোট ছেলে চলে আসে এবং তার সঙ্গে বৌদির একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং প্রকৃতির নিয়মে তা শারীরিক সম্পর্কের দিকে গড়ায়। নিজের স্ত্রীর সম্পর্কে এ সব কথা কিছুই জানতে পারেনি বড় ছেলে, কিন্তু মা সবই বুঝতে পেরেছিলেন। যদিও তিনি বৌমাকে এ নিয়ে কিছু বলতে পারেননি, হয়তো নিজে নারী হয়ে নারীর এরকম যন্ত্রণা তিনি অনুভব করেছিলেন, অন্যদিকে ছোট ছেলেকেও শাসন করতে পারেননি।
সমস্ত কিছু জেনেও তিনি না জানার ভান করে গিয়েছেন, কেননা তিনি ন্যায় নীতির নিরিখে বাস্তবটাকেও অস্বীকার করতে চাননি। এমনকি বড় ছেলেকেও এসব জানিয়ে তার মানসিক যন্ত্রণাকে বাড়াতে চাননি। নিজের ভিতরেই সবটা আড়াল করে রেখেছিলেন। বড় ছেলের দেখাশোনা সারাক্ষণ নার্সই করে। স্ত্রীও এখন আর খুব একটা স্বামীর কাছে আসে না। অথচ দিনরাত নার্সিং করতে করতে এই মানুষটির প্রতি স্নেহ, মায়া, মমতা, এমনকি ছোট ছোট অনুভূতি তার মধ্যে গড়ে ওঠে। এখন যেন ভালবেসেই এই মানুষটিকে যত্ন করে নার্স, এবং মানুষটির প্রেমে পড়ে যায়। এইরকম এক পরিস্থিতিতে একদিন বড় ছেলে মারা যায়।
পারিবারিক ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক বলে উল্লেখ করেন। এই মৃত্যুতে বাড়ির সকলে কোথাও যেন একটা স্বস্তি পেয়েছিলেন এই বলে—‘‘যাক অমানুষিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল।’’ কিন্তু নার্স এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেননি। তার ভিতরে একটা খটকা থেকে যায় এবং এই মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয় সেটা তিনি বুঝতে পারেন। নার্সের কথায় বাড়ির অন্দরমহলে এ নিয়ে যথেষ্ট চাপানউতোর চলতে থাকে। ছোট ছেলে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ‘‘নার্স নার্সের মতো থাকবে, আপত্তি থাকলে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারে।’’ এ কথায় নার্স দমে না গিয়ে পাল্টা জবাব দেয়, ‘‘আমি আবারও বলছি— আমি সত্যিটা জানতে চাই। না হলে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।’’ বেগতিক অবস্থা দেখে মা নার্সকে নিজের কাছে আলাদা করে ডেকে নেন, ‘‘চলো, তোমাকে আজ সবটা খুলে বলা দরকার।’’
ইতিমধ্যে যে বৌমা অন্তঃসত্ত্বা সে খবরও নার্সের অজানা নয়। তাই পারিবারিক সম্মান বাঁচাতে তিনি স্বীকার করে ছেলের মৃত্যুর ঘটনাটি জানান, ‘‘দেখো, এতদিনে তুমি এ বাড়ির এক জন হয়ে গিয়েছো, তোমাকে আজ আর বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। একদিন বড় ছেলে আমাকে বলে—‘‘মা এই অসম্ভব শারীরিক যন্ত্রণা আর বেশি দিন সহ্য করতে পারব বলে মনে হয় না। তবে তুমি আমাকে কথা দাও যে, যতদিন আমি সহ্য করতে পারব ততদিন আমি বাঁচব, যে দিন আর সহ্য করতে পারবো না সেদিন তুমি নিজেই আমাকে ঘুমের ওষুধের সঙ্গে কড়া ডোজের ওষুধ শেষ বারের মতো খাইয়ে দিও।’’ আমি মা হয়ে নিজের কষ্ট বুকে চেপে সেদিন ছেলের সেই অসম্ভব কষ্ট সহ্য না করতে পেরে নিজের হাতেই ছেলেকে মুক্তি দিই।’’
মায়ের সব কথা শুনে নার্স আর কোনও আপত্তি করেনি সেদিন। এই রকম একটা কাহিনিকে কেন্দ্র করে আমি ‘মাতৃতান্ত্রিক’ নাটকটি লিখেছিলাম।
নাটকটি লেখার প্রায় বছর ছ’য়েক পর ২০০০ সালের ৪ মার্চ ত্রিতীর্থের প্রযোজনায় ও আমার নির্দেশনায় প্রথম মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি প্রযোজনার সময় কোনও বিরতি ছিল না। মায়ের ভূমিকায় রেবা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নার্সের চরিত্রে কাকলি আচার্য অসামান্য অভিনয় করেন। অন্য দিকে, মায়ের বন্ধু ভবতোষের চরিত্রে আমার অভিনয় দর্শকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছিল। সব মিলিয়ে নাট্য-প্রযোজনাটি দর্শকদের মনে দীর্ঘ দিন দাগ কেটেছিল। এমনকি প্রথম মঞ্চায়নের দু’মাসের মধ্যে ৬ মে আমরা দিল্লিতে সপ্তর্ষি আয়োজিত নাট্যোৎসবে বিপিনচন্দ্র পাল মঞ্চে অভিনয় করে গুণিজনের প্রশংসা অর্জন করতে পেরেছিলাম।
(মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy