—ফাইল চিত্র
বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়াছিলেন, ‘এই বিশ্বসংসার একটি বৃহৎ বাজার।’ তাঁহার কমলাকান্তের দপ্তর-এর ‘বড় বাজার’ নিবন্ধে রূপের বাজার, বিদ্যার বাজার, সাহিত্যের বাজার ইত্যাদি রকমারি কারবারের অলোকসামান্য বিবরণ আছে। কিন্তু আজিকার রাজনীতির বড় বাজার তিনি দেখেন নাই, ভাবিতেও পারেন নাই। পশ্চিমবঙ্গে ভোটের হাওয়া বহিতে শুরু করিবার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাজার জমিয়া উঠিয়াছে। চুনোপুঁটি হইতে রাঘব বোয়াল— নানা মাপের রাজনীতিকরা এই দলের ঝাঁকা হইতে ওই দলের চুবড়িতে স্থানান্তরিত হইতেছেন। পরিযায়ী রাজনীতিকদের যে প্রদর্শনী চোখের সামনে চলিতেছে, তাহা দেখিতে পাইলে কমলাকান্ত আফিম ছাড়িয়া দিতেন। আপাতত এই পরিযায়ীদের অধিকাংশেরই গন্তব্য বিজেপি। গত সপ্তাহে দলের মহারথী অমিত শাহ রাজ্যে আসিয়া দলবদলের বড় প্রদর্শনীতে পৌরোহিত্য করিয়া জানাইয়া গেলেন, এমন পরিযাণ আরও ঘটিবে। বিজেপির অমলকমলখানি হাতে তুলিয়া শ্রীযুক্ত শুভেন্দু অধিকারী ঘোষণা করিলেন, শাহজি তাঁহার বড় দাদার মতো, তাঁহার হৃদয়ে অনেক দিনই বিজেপির অধিষ্ঠান। সরলমতি নাগরিক প্রশ্ন করিবেন, দলের নীতি, আপন আদর্শ, জনসাধারণের নিকট দায়বদ্ধতা— সবই তবে মায়া, পদ্মপাতায় জলকণামাত্র? সত্য শুধু সেই ঠিকানা, যেখানে প্রাপ্তিযোগের প্রত্যাশা অধিক— সেই প্রাপ্তি অর্থ, পদ, ক্ষমতা, যে গোত্রেরই হউক? আর, এই পরিযায়ীদের প্রতি যাঁহারা অকাতরে কোল বাড়াইয়া দিতেছেন, রাজনীতিতে নৈতিকতার জন্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি স্থানও বুঝি তাঁহারা আর রাখেন নাই? মুকুল রায় হইতে শুভেন্দু অধিকারী, তাঁহাদের হিসাবে সকলই শোভন?
যে কোনও ভাবে বিপক্ষ দলের নেতা ও কর্মীদের ভাঙাইয়া আনিবার এই রাজনীতি ভারতের নানা রাজ্যে অনেক দিন ধরিয়াই চলিতেছে। পশ্চিমবঙ্গে তাহার প্রকোপ তুলনায় কম ছিল। ষাটের দশকে কংগ্রেসের শক্তিক্ষয়ের যুগে এমন চিত্র বিশেষ দেখা যায় নাই। ক্ষমতার দৌড়ে হারিয়া গেলে শাসকরা পরাজয় স্বীকার করিয়া সরিয়া দাঁড়াইবেন, এই সুস্থ রীতিই সাধারণ ভাবে মানিয়া চলা হইত। প্রতিপক্ষের নেতা, বিশেষত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভাঙাইয়া আনিয়া আপন শক্তি বাড়াইবার উৎকট প্রবণতা এই রাজ্যে মাথাচাড়া দিয়াছে গত এক দশকে। তাহার দায় তৃণমূল কংগ্রেসের, সুতরাং তাহার সর্বাধিনায়িকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, যিনি রাজ্যের ২৯৪টি আসনেই দলের ‘প্রার্থী’। দায় তাঁহাদের সর্বগ্রাসী মানসিকতার। বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে জয়ী হইবার পরেও তাঁহারা রাজ্য জুড়িয়া বিরোধীদের যেখানে যেটুকু শক্তি আছে, তাহাকে ধ্বংস করিবার উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় পঞ্চায়েত এবং পুরসভা-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত সদস্যদের ভাঙাইয়া আনিয়া সেগুলি দখল করিয়াছেন। একটি দৃষ্টান্ত: ২০১৬ সালে সমস্ত জেলা পরিষদ তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে ছিল, একমাত্র মুর্শিদাবাদ ছাড়া। অতঃপর কংগ্রেস তথা বিরোধী সদস্যরা তৃণমূল কংগ্রেসে ‘যোগদান’-এর ফলে সেই প্রতিষ্ঠানও তৃণমূল কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণে আসে, এবং ন্যূনতম নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিবার পরে এই অভিযানে মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান সেনাপতি ঘোষণা করেন, গোটা মুর্শিদাবাদই অচিরে বিরোধীশূন্য হইবে! প্রসঙ্গত, সেই সেনাপতির নাম— শুভেন্দু অধিকারী। ইহাতে বিজেপির অপরাধ কিছুমাত্র কমে না, কিন্তু শাসক দলের সর্বাধিনায়িকাকে স্বীকার করিতেই হইবে, তাঁহারা যে বিষবৃক্ষ রোপণ করিয়াছেন, আজ তাহার ফল তাঁহাদেরই ভোগ করিতে হইতেছে। বিষবৃক্ষ উচ্ছেদ করিয়া রাজনীতিতে সুস্থ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিকতা ফিরাইয়া আনিবার কাজটি সুকঠিন। শুভেন্দু অধিকারীরা চলিয়া যাইবার পরে তাঁহাদের নিন্দা করিয়া কোনও লাভ নাই, যে রাজনীতি এই নিন্দনীয় আচরণের জনক, তাহাকে বর্জন করিবার সততা শাসক দলের আছে কি না, এখন তাহারই পরীক্ষা। অগ্নিপরীক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy