প্রচারক। অমিত শাহ, ছন্দৌসি, ১৩ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই
রাজনীতি পূর্বনির্ধারিত চিত্রনাট্য অনুসরণ করতে ভালবাসে না। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহর বিজেপির বজ্রনির্ঘোষ শুনেছি বিগত লোকসভায়। দাদরি থেকে মুজফ্ফরনগর— উত্তরপ্রদেশে ধর্মীয় মেরুকরণ কী চেহারা নিতে পারে, তা-ও দেখে নিয়েছি। এ বার দেখছি নির্বাচনী কৌশল কীভাবে এই নয়া মহাভারতের চিত্রনাট্যটাও বদলে দিতে পারে। আবার উত্তরপ্রদেশ তার সাক্ষী।
আমরা সাংবাদিকরা সব সময়ই জাতপাত ও ধর্মের সমীকরণে ভোট বিশ্লেষণ ভালবাসি। কিন্তু রাহুল-অখিলেশের সদ্য হওয়া জুটি শুধু যে রাজ্যের চতুর্মুখী লড়াইকে ত্রিমুখী করে দিয়েছে তা-ই নয়, আরও মজার ব্যাপার, দুই বংশানুক্রমিক শাসনের উত্তরাধিকারীর জুটি রসায়ন আগামী দিনের রাস্তা দেখাচ্ছে। ভোট রাজনীতিতে পারসেপশন অমূল্য। এ রাজ্যে ক্রমবর্ধমান ধারণা একটাই, অমিত শাহ-অমর সিংহর রাজনীতির মডেল বাতিল করার সময় এসেছে।
লখনউয়ের হজরতগঞ্জে দাঁড়িয়ে দেখলাম, মায়াবতীর মর্মর মূর্তির সামনে অখিলেশ-রাহুলের এক সুদীর্ঘ কাট-আউট। নীচে শুধু একটি বাক্য, ‘কাম বোলতা হ্যায়’। যারা কথার কথকতায় ব্যস্ত, তাদের প্রতি এ এক চূড়ান্ত অনাস্থা। আজ যিনি কলকাতার রাজভবনে থাকেন, সেই কেশরীনাথ ত্রিপাঠী তখন লখনউ বিধানসভার স্পিকার। বিধানসভায় মায়াবতী ঢুকতে না ঢুকতেই বিধায়কদের মধ্যে শুরু হল রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। টেবিল-সংলগ্ন স্টিলের মাইকগুলো খুলে একদম ‘ওপেন ওয়ার’! বহুজন সমাজ পার্টি আর সমাজবাদী পার্টির বিধায়কদের এক জন আর এক জনের মাথা ফাটাচ্ছেন, আর বহু নেতা টেবিলের নীচে লুকোচ্ছেন। ।
লখনউ–এর বন্ধু সাংবাদিকরা বলেন উল্টোপ্রদেশ! এ এক অদ্ভুত রাজ্য। কলকাতার বিধায়করা এমন মারামারি কল্পনা করতেও পারবেন না। লখনউ বিধানসভা থেকে হেঁটে হজরতগঞ্জের মোড়ে আসতে পাঁচ মিনিট লাগে। মোড়টায় দাঁড়িয়ে অনেক পুরানো কথা মনে পড়ছিল। সামনেই রাজভবন। রাজ্যপাল কখনও রমেশ ভাণ্ডারি, কখনও বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী। কখনও মুলায়ম সরকার গড়েছেন। কখনও মায়াবতী। প্রত্যেক বারই বিধায়কদের প্যারেড করিয়ে রাজ্যপালের কাছে নিয়ে যাওয়া হত। এক বার রাজভবনের ভিতরই ছোট লনে, নিজের দলের বিধায়ক ভেঙে যাওয়ার ভয়ে, মায়াবতী তড়িঘড়ি রাত্রিবেলায় শপথ নিয়েছিলেন।
১৯৮৯ থেকে দলগুলি খণ্ডবিখণ্ড হতে শুরু করল। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ ইলাহাবাদ উপনির্বাচনের সেমিফাইনালে জিতে ফাইনাল ম্যাচে রাজীব গাঁধীকে পরাস্ত করে প্রধানমন্ত্রী হলেন। তিনি করলেন মণ্ডল কমিশন, বিজেপি করল রামমন্দির আন্দোলন।
সেই হজরতগঞ্জে তারঘরের ভেতর ছিল প্রেস কর্নার। চোখে সুরমা লাগিয়ে এন ডি তিওয়ারি বোঝাতেন যে হিন্দু আর মুসলমান: কংগ্রেসের ভোট দুই পক্ষেই। তারঘর থেকে হেঁটে গেলে চিকন শাড়ির বাজার। তার পর হজরতগঞ্জের বিখ্যাত চাট ভাণ্ডার। একটু এগোতেই ব্রিটিশ আমলের মেফেয়ার বিল্ডিং। সেই প্রাচীন প্রাসাদের নীচে বিখ্যাত রাম আডবাণীর বইয়ের দোকান। রাম আডবাণী এক বার বলেছিলেন, উত্তরপ্রদেশ দ্রুত বদলাচ্ছে। মার্কিন গবেষণা, নতুন প্রজন্ম গণতন্ত্রের উপর আস্থা হারাচ্ছে গোটা দুনিয়ায়। উত্তরপ্রদেশই বা ব্যতিক্রম হবে কেন?
এ বারের ভোটে উত্তরপ্রদেশ দেখে আবারও মনে হচ্ছে, এমন নয় দলিত-যাদব, হিন্দু-মুসলমান, জাঠ-ওবিসি এই সব জাতপাত ভিত্তিক ভোটের পরম্পরা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ক্রমশ রাজ্যে অখিলেশ-রাহুলের ‘গঙ্গা-যমুনা জুটি’ সুশাসনের পিপাসা বাড়িয়েছে। অযোধ্যায় শিলান্যাস, তার পর শাহ বানো বিতর্কে বহুত্ববাদী কংগ্রেসের আম ও ছালা দু’টিই গিয়েছিল। তীব্র কংগ্রেসবিরোধিতার আবহে বিজেপি-র যেমন বৃদ্ধি হয়, ঠিক সে ভাবেই বেড়েছিল মায়াবতীর দলিত ও মুলায়মের যাদব-মুসলমান রাজনীতি। মায়াবতী শেষ বার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসে হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ নেওয়া, গলায় চাদর-ফেলা নিজের মূর্তিও স্থাপন করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে অখিলেশ বলেছিলেন, এই সব মূর্তি ভাঙব কী করে? তাতে তো মায়াবতীরই বেশি লাভ হবে। তার চেয়ে উন্নয়ন করি।
আজ এত বছর পর বৃত্তটি সম্পূর্ণ হতে চলেছে। বাজপেয়ীর ছ’বছরের পর বিজেপি-বিরোধী উল্টোরথের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখন তো ২৮২টি আসনের লৌহমানবের সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান জাতীয় অসন্তোষ। রাজ্যেও বিজেপির চিরাচরিত মেরুকরণের রাজনীতি কাজ করছে না। আবার উত্তরপ্রদেশের আর্থিক চিত্রটা মোদী বদলে দিয়েছেন, এমন দাবিও করা যাচ্ছে না। রাজ্য বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী-প্রার্থী নেই, পিতাপুত্র বিবাদ নেই, অখিলেশের নেতৃত্ব স্থাপন, নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে সাইকেল প্রতীক লাভ, সবচেয়ে বড় কথা কংগ্রেস সমাজবাদী পার্টির জোট, এ সব কিন্তু মশাই চাট্টিখানি কথা নয়। বিজেপি এখন দুই দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখে, কংগ্রেস এবং আঞ্চলিক দল। ২০১২ সালে সমাজবাদী পার্টির শতকরা ভোট ছিল ২৯, কংগ্রেসের ছিল ১১, দুটো মিলিয়ে শতকরা ৩০ ভাগ। আর মুসলমান ভোট সব মিলিয়ে শতকরা ১৮ ভাগ। কাজেই পেণ্ডুলাম অন্য দিকে ঘুরছেই তো।
এর আগের বার লোকসভা ভোটের সময় মুজফ্ফরনগর গিয়ে অমিত শাহ জাঠদের বৈঠকে এত বেশি সংখ্যালঘুবিরোধী বক্তৃতা দিয়েছিলেন যে নির্বাচন কমিশন সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে অমিত শাহকে বিবৃতি প্রত্যাহারের নোটিস পাঠিয়েছিল। সে বার জাঠেরা ছিল মোদী-মায়ায় অনুগত। এখন হরিয়ানায় জাঠ বিদ্রোহ। ভোটের সময়ে তাই সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি শুনেও এ বারে জাঠেরা বলছেন, বেলতলায় যাব না। বিজেপি জানে মুসলমান ভোট তারা পাবে না। কিন্তু মুসলমান ভোট ভাঙতে এখন তারা মরিয়া। কখনও দিল্লির জামা মসজিদে শাহি ইমামকে দিয়ে, কখনও আসাউদ্দিন ওয়াইসির মাধ্যমে, কখনও মায়াবতীর প্রচুর মুসলমান প্রার্থী দেওয়ার কৌশলে আস্থা রেখে। কিন্তু এটা স্পষ্ট, রামমন্দির, তিন তালাক অথবা লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে রোমিওবিরোধী ব্রিগেডের কথায় এখনও পর্যন্ত বিজেপির চিঁড়ে ভেজেনি। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে দাঙ্গাহাঙ্গামাও হয়নি।
আর মায়াবতী? তাঁর কি জনপ্রিয়তায় কমতি? মারাত্মক ভুল। দুপুর আড়াইটেতেও এই দলিত নেত্রীকে দেখতে গ্রামের মানুষ যে ভাবে অপেক্ষা করেন, দেখে কিন্তু আজও বিস্মিত হতে হয়। কালো মার্সিডিজ বেঞ্জ থেকে মায়াবতী নামলে গাড়িটা দেখেও দলিত ভোটাররা রীতিমতো গর্বিত হন। কাজেই জাতপাতের পরিচিত রাজনীতি শেষ হয়ে গিয়েছে এমন বলা যাবে না। কিন্তু এটাও ঠিক যে, রাহুল-অখিলেশের নেতৃত্বে একটা রূপান্তর পর্ব শুরু হয়েছে। সমাজতত্ত্বের ভাষায়, জাতপাত, ধর্মীয় সত্তা এখন আর একক নির্ধারক শর্ত (Single determining Social Variable) নয়। ৪০৩টি বিধানসভা, তাই ভোটারের আচরণও যথেষ্ট জটিল। অনেক সময় গজদন্ত মিনারে বসে আমরা যেটা দেখতে চাই সেটাই শেষ পর্যন্ত দেখি। এ হল ইচ্ছাপূরণের তত্ত্ব। সে দিন পার্লামেন্টের স্মোকিং রুমে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা মুখতার আব্বাস নকভি সিগারেটে সুখটান দিয়ে বলছিলেন, ‘‘মোদীজি এত উন্নয়নের কাজ করেছেন, উন্নয়নের ভোট তো তাঁরই পাওয়ার কথা।’’ আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রী মুখে বিকাশের কথা বললেও বিজেপি কিন্তু এখনও হিন্দুত্বের রাজনীতিই করে। এ বার সেই হিন্দুত্বর নিভু নিভু আঁচে রুটি সেঁকা যাচ্ছে না। আবার উন্নয়নও দেখা যাচ্ছে না।
ভোটের ফলের কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করাটাই অবৈজ্ঞানিক। ব্রেক্সিট-এর ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের ইচ্ছাপূরণের তত্ত্ব খারিজ হয়েছে। ভুল প্রমাণ হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের ভবিষ্যদ্বাণী। তাই, ভবিষ্যদ্বাণী ছেড়ে এটুকু বলতে পারি, উত্তরপ্রদেশে উত্তুরে হাওয়া বইছে, সেই হাওয়ার দাপটে বেশ কাতর বিজেপি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy