রা জনৈতিক শক্তির বিচারে দল হিসাবে সিপিআইএম-এর এখন যতটুকু গুরুত্ব, তাহাতে কে সেই দলের সাধারণ সম্পাদক হইলেন, সেই সংবাদে বৃহত্তর সমাজের উৎসাহ ক্ষীণ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু, প্রকাশ কারাট হইতে সীতারাম ইয়েচুরি, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের হাতবদলের প্রক্রিয়াটির অন্তর্লীন সৌষ্ঠব তাহাকে বিশিষ্টতা দিল। কেহ বলিতেই পারেন, এই নম্র ভঙ্গির পিছনে একটি রাজনৈতিক কৌশল বর্তমান। কেরলের কারাটের পর যদি কেরলেরই রামচন্দ্রন পিল্লাই দলের সাধারণ সম্পাদক হইতেন, হয়তো অচিরেই দলের নাম বদলাইতে হইত। ‘ভারতের’ বদলে তাহার নাম হইত কেরলের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু, ইয়েচুরির মনোনয়নটি যে বিনা প্রতিরোধে হয় নাই, তাহা শেষ দিন অবধি চলা টানাপড়েনেই স্পষ্ট। কারাট স্বয়ং নাকি ঝুঁকিয়া ছিলেন পিল্লাইয়ের দিকে। কিন্তু, শেষ অবধি কোনও দ্বন্দ্বই শালীনতার সীমা অতিক্রম করে নাই। দলের মন বুঝিয়া পিল্লাই সরিয়া দাঁড়াইয়াছেন। কারাটও শেষ অবধি ইয়েচুরির পক্ষে মত দিয়াছেন। নির্বাচনের এই প্রক্রিয়াটি প্রকৃতার্থে গণতান্ত্রিক নহে। সিপিআইএম-এর মতো দলে তাহা প্রত্যাশিতও নহে। সম্ভ্রম ও শালীনতার যে বোধ থাকিলে শেষ অবধি এই ভাবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উত্তীর্ণ হওয়া যায়, তাহাই এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। প্রকাশ কারাটের কথা পৃথক ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। দলীয় রাজনীতিতে ইয়েচুরি যে তাঁহার ‘লাইন’-এর সমর্থক নহেন, গত কয়েক বৎসরে তাহা স্পষ্ট। তবুও কারাট সম্ভ্রমের সীমা লঙ্ঘন করেন নাই। যে কোনও প্রকারে ইয়েচুরির যাত্রাভঙ্গ করিতে সচেষ্ট হন নাই। দেশের বহু উদীয়মান দল বামপন্থীদের হইতে ভদ্রতার এই পাঠটি গ্রহণ করিতে পারে।
বঙ্গীয় বামপন্থীরা আগাগোড়া ইয়েচুরির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনে অকুণ্ঠ ছিলেন। অতএব, এই জয়ের গৌরবের ছটা তাঁহাদের ক্লান্ত মুখেও লাগিয়াছে। মুখগুলি উদ্ভাসিত। কিন্তু এই জয়ে পশ্চিমবঙ্গ কোথায়? আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মনসবদাররা বলিবেন, কেন, ইয়েচুরি তো এই রাজ্যেরই সাংসদ। কথাটি সত্য। মনমোহন সিংহ রাজ্যসভায় অসমের প্রতিনিধি, সত্য। প্রণব মুখোপাধ্যায় এক কালে গুজরাতের প্রতিনিধি ছিলেন, সত্য। কিছু সত্য মিথ্যার অধিক। ক্ষুদ্রতার নিরলস সাধনায় বঙ্গীয় বামপন্থীরা কোথায় দাঁড়াইয়াছেন, সর্বভারতীয় রাজনীতি হইতে তাঁহাদের নিশ্চিহ্ন হইয়া যাওয়া তাহারই অভিজ্ঞান। এই অন্তর্ধান বহু বৎসরের সাধনার ফল। ক্ষুদ্রতার সাধনা। প্রমোদ দাশগুপ্তরা ভোটের হিসাব মিলাইবার তাড়নায় সংগঠনে যতখানি জোর দিয়াছিলেন, বৌদ্ধিক অনুশীলনে তাহার অংশমাত্র নহে। পরবর্তী যুগে অনিল বিশ্বাস আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসিয়া সূর্য-চন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করিতেন বটে, কিন্তু তাহা ক্ষুদ্র স্বার্থের আকাশে। তাঁহারা মধ্যমেধার একাধিপত্য স্থাপনে ব্রতী হইয়াছিলেন। তাহাতে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি হইয়াছে, রাজ্যে দলেরও লাভ হয় নাই। দার্শনিক যুক্তির পরম্পরা নির্মাণে বঙ্গীয় কমরেডদের ব্যুৎপত্তি জন্মায় নাই। এমনকী সর্বভারতীয় মঞ্চে দাঁড়াইয়া যথেষ্ট দক্ষতার সহিত তাত্ত্বিক চর্বিতচর্বণের ভাষাগত সামর্থ্যেও আলিমুদ্দিনের নায়করা সচরাচর দড় নহেন। এই মৌলিক অসামর্থ্যই ক্রমে তাঁহাদের সর্বভারতীয় মানচিত্র হইতে মুছিয়া দিয়াছে। দলটি সিপিএসআই(এম) হইয়া উঠিয়াছে— কমিউনিস্ট পার্টি অব সাউথ ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট)। এক হরকিষণ সিংহ সুরজিৎ ছাড়া দলের সব সাধারণ সম্পাদকই দক্ষিণ ভারতীয়। আলিমুদ্দিনের একান্ত আপন ইয়েচুরিও। সর্বভারতীয় নেতৃত্বের স্বাদ পাইতে হইলে বঙ্গীয় কমরেডদের অবিলম্বে একটি নিজস্ব কমিউনিস্ট পার্টি প্রয়োজন। যত দিন অবধি সেই প্রয়োজন না মিটিতেছে, বঙ্গ-বামরা ফুটবল বিশ্বকাপের বাঙালি দর্শক হইয়া থাকিবেন। ব্রাজিলকে সমর্থন করিয়াছিলেন। ব্রাজিল জিতিয়াছে। সেই আনন্দটুকুই তাঁহাদের সার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy