ধন্য আশা। জয়ললিতার সমাধির সামনে শশিকলা। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। পিটিঅাই
লোকে ভাবে, নিয়তির গতি বিচিত্র। বোঝে না যে— অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়তি বস্তুটা কোনও আকাশ থেকে পড়া ঘটনা নয়, মানুষের নিজেরই বেছে-নেওয়া পথের ফলাফল! ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ জুড়ে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী পদের দিকে এগোচ্ছিলেন শশিকলা নটরাজন, তামিলদের সাম্প্রতিকতম মাতৃ-রূপিণী নেত্রী-পদে প্রায় অধিষ্ঠিত হয়েই গিয়েছিলেন, জয়ললিতার টয়োটা প্রাডো এসইউভি গাড়িটিতে চড়ে একটা ধার-করা অমরত্বের সন্ধানে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধল তাঁর অতীত। অতীতে এমন একটা পথ তিনি নিজেই নিয়েছিলেন যাকে শেষ পর্যন্ত নিয়তির টানে মিশতেই হল বেঙ্গালুরুর অন্ধকার জেল-ঘরে এসে। সুতরাং সিংহাসনের বদলে চিন্নাম্মার ঠাঁই হল জেলের মাদুরে। মোমবাতি তৈরির কাজ করে দৈনিক পঞ্চাশ টাকা উপার্জন বরাদ্দও হল।
না, তামিল রাজনীতিতে ‘মানারগুডি মাফিয়া রানি’ হিসেবে পরিচিত এই চিন্নাম্মার প্রতি নিয়তি যে বিশেষ ভাবে বিরূপ, এমনটা বলা যাবে না। তাঞ্জাভুর জেলার মানারগুডি গ্রামের মধ্যবিত্তেরও একটু নিচু স্তরের পারিবারিক পটভূমি থেকে উঠে আসা, ইস্কুল ‘ড্রপ-আউট’ শশিকলার চার ভাই পথের পাশে বসেই দিন কাটাতেন, যদি এ দিক ও দিক থেকে কপালগুণে পয়সার বন্দোবস্ত হয়, সেই আশায়। তারই মধ্যে অত্যুচ্চাশী মেয়েটির বিয়ে হল সরকারের বিজ্ঞাপন দফতরের কর্মী ভি কে নটরাজনের সঙ্গে। বিয়েটা খারাপ হল না, নিঃসন্তান দম্পতি মোটের উপর সম্পন্নই ছিলেন। কিন্তু মনের গভীরে সামাজিক উচ্চাশার খিদে সামলাবে কে? ভিডিয়ো ক্যাসেট লাইব্রেরি চালাতে গিয়ে মেয়েটি তক্কে তক্কে রইল যদি বড় দরের আমলা বা নেতার নজরে পড়া যায়। উপরে উপরে অসহায় বোকা মেয়েটির ভেতরে ছিল চতুরতা, অনর্গল প্রিয়ভাষিতা এবং শয়তানসম ক্রূরতা। গুণগুলি কাজে এল শেষে। কুড্ডালোরের কালেক্টর চন্দ্রলেখা তাঁকে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
শুরু হল এক অবিস্মরণীয় যাত্রা। জয়া কিছু দিন আগেই মাতৃহীন হয়ে তাঁর আধুনিক বিলাসপূর্ণ বাংলোয় একা থাকছেন তখন। শশীর সেখানে প্রবেশ ঘটল জয়ার কেয়ার-টেকার ও ছায়াসঙ্গী হিসেবে। তেমনই চলতে লাগল, যত দিন পর্যন্ত না (২০১১) গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জয়াকে জানালেন যে জয়ার গুজরাতি নার্সের সূত্রে রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থার কাছে খবর পৌঁছেছে যে শশী তাঁকে নিয়মিত বিষ খাওয়াচ্ছেন, যাকে বলে স্লো-পয়জনিং। শুধু তাই নয়, শশী সরকারি ফাইলপত্র ব্যবহার করে আর্থিক ধান্দাবাজিও করছেন। জয়া সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ও তাঁর প্রায় ডজনখানেক আত্মীয়কে নিজের বাড়ি ও দল থেকে বার করে দিলেন, শশীর ভাইপো সুধাকরণকে দত্তক নেওয়ার পরিকল্পনাও বাতিল করলেন। ও হ্যাঁ, ইতিমধ্যে শশীর হতদরিদ্র ভাইরা সকলেই কয়েক হাজার কোটি সম্পত্তির মালিক হয়ে গিয়েছেন, পুলিশ-প্রশাসনে তাঁদের তখন অপরিসীম দাপট।
জয়ার বাংলোয় যে তিরিশ বছর কাটিয়েছেন শশিকলা নটরাজন, সেই সময় শিখেছেন অনেক কিছু। সরকারি ফাইল কী ভাবে সরাতে হয়, প্রশাসনকে কী ভাবে ঠকাতে হয়, সমাজবিরোধীদের কী ভাবে চালাতে হয়, এবং সর্বোপরি, পার্টির লোকদের কেমন ভাবে হাতে রাখতে হয়, সব কয়টি আর্টই রপ্ত করেছেন। কবে এই সব প্রশিক্ষণ নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারবেন, অধীর অপেক্ষায় কাটছে তাঁর দিন। তাঁর একটা বিরাট গুণ, অসাধারণ নৈঃশব্দ্যের অভ্যাস, শত্রুদের কানে যে নীরবতা তালা ধরিয়ে দিতে পারে। আরও আছে। তাঁর শান্ত, সুস্থিত মুখমণ্ডল এবং পরিশীলিত নম্র আচার-আচরণ।
অবশ্য যে দিন জয়া তাঁকে বাইরের দরজা দেখিয়ে দিলেন, আম্মাকে স্লো-পয়জনিং-এর গল্পটা প্রবল বেগে চার দিকে ছড়িয়ে পড়ল, সাময়িক ভাবে এই সব গুণের কোনওটাই তাঁর কাজে এল না। জনমানসে প্রায় ডাইনির মতো একটা ‘ইমেজ’ তৈরি হল। শশী হাল ছাড়লেন না। অসুস্থ জয়াকে তবু ঘিরে রইল তাঁর জাদুকলা, বিশ্বস্ত অনুগত পনীরসেলভমকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করালেন, নিজেই এআইএডিএমকে-র শীর্ষনেত্রী পদটি কব্জা করলেন, এমএলএ-দের বন্দি করে রাখলেন, জয়ার বাড়ির দখল ছাড়লেন না। সুপ্রিম কোর্টের রায় কী হতে চলেছে, একটা আন্দাজ ছিল তাঁর, কিন্তু আমল দিলেন না সেটাকে। এই অধৈর্যই শেষে কাল হল। অপেক্ষার দানটা না খেলে গোটা খেলাটাই হেরে বসলেন তিনি। আর একটা কথাও তিনি বোঝেননি। সুপ্রিম কোর্টের সামনে কিন্তু জয়ললিতাও দেবী কিংবা আম্মা হতে পারেননি। আদালতের শাস্তি জয়ার উপরও খাঁড়ার মতো নেমে এসেছিল। বেঁচে থাকলে তাঁর ভাগ্য শশীর মতোই হত। এক দিক দিয়ে মৃত্যু তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। জয়াই যখন রেহাই পাননি, শশিকলা কী করে আশা করেছিলেন যে তিনি ফাঁকতালে বেরিয়ে যাবেন। তিনি যা করছিলেন, সেটা তাঁর পক্ষে, তাঁর রাজ্যের পক্ষে প্রবল লজ্জার কথা ঠিকই, তবে তার সঙ্গে গণতন্ত্রেরও মাথা হেঁট হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। রাজ্যপাল সংবিধানকে বাঁচালেন। আর বাঁচালেন দেশের গণতন্ত্রকে।
শশিকলা-বৃত্তের মতে, ও পনীরসেলভমকে সাময়িক ভাবে মুখ্যমন্ত্রী করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানই বেশি ছিল। তা যদি হয়ও, বলতে হবে শশীর বিবেচনাটা ভাল হয়নি। তাঁরা দুই জনেই থেবর জাতের সদস্য, রাজ্যের জনমানচিত্রে যে জাতকে আপাতত খুঁজে পাওয়াই দায়। মধ্য ও দক্ষিণ তামিলনাড়ুর পুরনো পয়সাওয়ালা জমিদাররা এই জাতের অন্তর্গত। ঐতিহাসিক ভাবেই এঁদের পরিচয় দলিতবিরোধী হিসেবে। ওপিএস সে জন্যই ক্ষমতার লড়াইয়ে বেশি দূর কুস্তি করতে রাজি ছিলেন না। রাস্তার ধারের দোকানদার হিসেবে তাঁর জীবন শুরু, ফলে একটা বাস্তববোধ তাঁর আগাগোড়াই আছে। রাজনীতির লড়াইয়ের দক্ষতাও আছে। আর আছে একটা চতুর বুদ্ধি, যেটার সাহায্যে জয়ললিতার রহস্যজনক মৃত্যুর প্রশ্নটিকে তিনি বেশ কিছু কাল বাঁচিয়ে রাখবেন, বোঝা যায়। শশী তাঁকে তীক্ষ্ণ ভাবে আঘাত করে বুদ্ধির কাজ করেননি। হয়তো পনীরসেলভমের বদলে রাজ্যের বৃহত্তম গোষ্ঠী (জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ) বানিয়ারদের থেকে কাউকে বাছলে তাঁর কাজ সহজ হত। বানিয়াররা প্রধানত কৃষক গোষ্ঠী, তুলনায় অনেক বেশি বাধ্যতা তাঁদের রক্তে। হয়তো তাঁদের কেউ নেতা হলে শশীর দুর্দৈব কমত। ই কে পালানীস্বামীর নির্বাচনটি করা হল গুন্ডার গোষ্ঠী থেকে। রাজ্যের উত্তরে কোয়েম্বাটুর অঞ্চলের অধিবাসী গুন্ডাররা শিক্ষিত, প্রগতিশীল, সুশীলিত, অর্থনৈতিক ভাবে সম্পন্ন গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত।
আপাতত সাড়ে তিন বছর শশিকলা জেলে কাটাবেন। দশ বছর নির্বাচনে লড়তে পারবেন না। এখনই তিনি অসুস্থ, ডায়াবিটিস-এ রুগ্ণ, ৬১ বছর বয়স। আম্মার রক্ষাকারী হিসেবেই তাঁর সমস্ত প্রতিপত্তি। ৬৪ বছর বয়সে জেল থেকে তিনি যখন বেরোবেন, তার আগে জয়ার মৃত্যুতে তাঁর ভূমিকা বিষয়ে যদি আর কোনও বিতর্কযোগ্য তথ্য না পাওয়া যায়, তখনও কি সম্ভাবনা থাকবে তাঁর আবার পাদপ্রদীপের আলোয় আসার? মনে হয় না। রাজনীতির স্মৃতি ক্ষণস্থায়ী। তত দিনে মানুষ যদি তাঁকে না ভোলেন, সুযোগসন্ধানী আত্মীয়রা যদি তাঁকে না ছেড়ে যান, বলতে হবে, তাঁর ভাগ্য আশ্চর্য রকমের প্রসন্ন।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর যা দাঁড়াল— জয়ললিতা অনৈতিক ও বেআইনি অর্থসঞ্চয়ের অপরাধে অপরাধী, ওপিএস এবং শশিকলা দুই বিশ্বাসভাজন গোষ্ঠী আম্মা-রাজনীতির ফসল তুলতে ভিন্ন ভিন্ন কারণে অপারগ। ডিএমকে নেতা এম করুণানিধি কি বসন্তের পদধ্বনি শুনছেন? সন্দেহ নেই, ধূর্ত বৃদ্ধ এখন প্রাণপণ চাইছেন, যে ভাবে হোক অন্তর্বর্তী বিধানসভা নির্বাচনের পথ প্রস্তুত করতে। যাতে হুইলচেয়ার থেকে সিংহাসনে ওঠার একটা সুযোগ মেলে!
pratapthorat1@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy