সুপ্রিম কোর্ট সমস্যা সমাধানের জন্য এই মর্মে রায় দিয়েছিল, সংবিধান সংশোধন করে যত দ্রুত সম্ভব বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২ এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত ভারতীয় ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য। সেই মতো ১৯৬০ সালে সংবিধানের নবম সংশোধন ঘটে। এর পরও চুক্তির শর্তানুযায়ী বিনিময় সংঘটিত হয়নি।
সেই সময়ে দুই দেশের মধ্যে যাতায়াতের জন্য পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়েও চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু দুই দেশই সম্ভবত ছিটমহলবাসীর কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। তার পরেও অনেক জল এ দিক-ও দিক গড়িয়েছে। কাজ বিন্দুমাত্র এগোয়নি।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গাঁধী ও বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিবর রহমান দুই দেশের মধ্যে সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখে ওই ছিটমহল সমস্যার স্থায়ী এবং অপরিহার্য সমাধান খুঁজতে পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বিষয় নিয়ে ব্যাপক ভাবে আলোচনা করার পর ১৯৭৪ সালে ১৬ মে একটি স্থলভাগ বণ্টন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি ছিটমহলবাসীরা যে দেশে আছেন সেই দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করার আলোকেই স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে একই সঙ্গে দুই দেশের জরিপ কর্তাদের ওই অঞ্চলের জমির নিখুঁত বর্ণনা ছাড়াও এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা সীমানাহীন অঞ্চলগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে দ্রুত একটি সীমারেখা অঙ্কন করার কথা হয়, যেখানে দুই দেশের সৌহার্দ্যের সম্পর্কে যেন চিড় না ধরে।
সেই মতো স্ট্রিপ ম্যাপ তৈরি হলে পুরনো খুঁটি সরিয়ে নতুন সীমানা অনুযায়ী খুঁটি পোঁতার কাজ শুরু হওয়ার আগেই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে ৩৫.৫ কিমি অঞ্চল নিয়ে সমস্যা তৈরি হওয়ায় সমাধানে প্রক্রিয়া গোঁত্তা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। গোঁত্তা খায় ছিটমহলবাসীর জীবন-জীবিকাও।
বহু দিন-মাস-বছর গড়িয়ে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সর্দার মনমোহন সিংহ ও শ্রীমতি শেখ হাসিনার মধ্যে প্রোটোকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে শেষ অবধি কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ছিটমহলবাসীর সমস্যা রয়ে গিয়েছে সমস্যার তিমিরেই।
সব চেয়ে করুণ সমস্যা— সীমানা না থাকায় অঞ্চলগুলিতে অপরাধমূলক কাজকর্মের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন রকমের চোরাচালান, বিশেষ করে গোরুপাচার, নারীপাচার, শিশুপাচারের মতো অপরাধ হামেশাই ঘটে থাকে।
বিএসএফ আর বিডিআর-এর হাতে গুলি খেয়ে প্রতি বছর শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। অথচ, যে সকল জনপ্রতিনিধির জঘন্যতম উদাসীনতার জন্য এই অকাল-অমানবিক মৃত্যু ঘটছে তাঁদের কিন্তু গায়ের এক ফোঁটা ঘামও ঝরে না। তাঁদের হাসি-খুশি মুখের ছবি কিন্তু আজীবন খবরের পাতায় ছাপা হয়ে যাচ্ছে। শুধু পাতায় নয়, শিরোনামের পাতায়।
জানলে আঁতকে উঠতে হয়, সমীক্ষা বলছে, ছিটমহলবাসীর গড় আয় ছিল ১৭ টাকা প্রতিদিন। বৈধ কোনও নাগরিককে বাবা-মা বানিয়ে স্কুলে ঢুকতে হত ছিটমহলের শিশুদের। একটি দেশের মধ্যেই দেশহীন আরেক দেশ। সে দেশের সন্তানসম্ভবা বধূ নিকটতম হাসপাতালে গেলে ভর্তি নিত না। সেই দেশহীন দেশের ছেলেমেয়েরা যতই মেধাবি হোক না কেন, তারা আসল বাবা-মার পরিচয়ে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করতে পারত না। কারণ, উক্ত বিদ্যালয় বা পরীক্ষা-বোর্ডের দেশে পরীক্ষার্থী ও তাদের বাবা-মা ভিনদেশি। যাদের দেশের প্রতিমা পতাকার প্রতীকে ধরা দিত না। তাই পতাকা-প্রতীকহীন কত শত আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, বিকৃত, অমানবিক আচরণ, সর্বোপরি, মানবিক অসহায়তা— সবই ইতিহাসের চাবুকে মরতে মরতে ছিটমহলের জীবনপ্রবাহ বহন করে চলেছে।
কলমের আঁচড়ে মানচিত্রে দাগ মেরে দেশ ভাগ করা কিংবা দেশ বদলে দেওয়ার যন্ত্রণা ছিটমহলবাসীর বুকে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তা অদূর ভবিষ্যতে পূরণ হওয়ার নয়।
তা হলে অন্তঃসত্ত্বা বধূরা কি হাসপাতালে যেত না? অবশ্য যেত। কিন্তু যাওয়ার সে পথের পরতে পরতে ছিল অমানবিকতার কাঁটা বিছানো। হাসপাতালে ভর্তি হতে দেশহীন দেশের গৃহবধূকে প্রায় অপরিচিত কোনও পর পুরুষের বউয়ের পরিচয়ে ভর্তি হতে হত। যে পুরুষ মানুষটি হাসপাতালের দেশের স্বীকৃত নাগরিক। শিশুর জন্মের পর হাসপাতাল থেকে যে কার্ড দেওয়া হত, তাতে সদ্যোজাত শিশুটির বাবা হিসাবে সেই পুরুষটিরই নাম থাকত।
এই ভাবে সন্তানপ্রসবার স্বামীর পরিচয়, কোনও পরীক্ষার্থীর অভিভাবকের পরিচয় বিক্রি হত মোটা অর্থের বিনিময়ে। সবই ঘটত প্রশাসনের চোখের ডগায়।
বাংলাদেশের ভিতরকার ভারত বা ভারতের ভিতরকার বাংলাদেশের নাগরিক যাঁরা, সেই ছিটমহলের কোনও মেয়েকে যদি কেউ তুলে নিয়ে যেত, এবং সেই মেয়ে যদি ধর্ষিতাও হত, নিকটতম পুলিশফাঁড়ি সে অভিযোগ নিত না। কারণটা এই, দেশবিহীন ছিটের মেয়েকে ফাঁড়ির দেশ দেশবাসী বলে মানত না। আর সে কারণেই ছিটের মেধাবি ছাত্রীকে পরীক্ষায় বসতে জোগাড় করতে হত মিথ্যে পিতৃপরিচয়। যুবতীর সন্তান প্রসব করাতে সাজতে হত আজনবি পুরুষের বউ। তারা সকলেই রাষ্ট্রের কাণ্ডজ্ঞানহীনতার ভার বহন করত বিনা দোষে। তাদের সরু সুতোর জীবনের উপর, অপমানিত যৌবনের উপর যে কোনও মুহূর্তে ধেয়ে আসতে পারত চরম বিপর্যয়।
রাজা, মহারাজার খামখেয়ালিতে ভাগ হত দেশ, আজন্মের স্বদেশ হত ভিন্দেশ। বিদেশকে দেশ মানতে গিয়ে ছিটমহলে বাঁধা পড়েছে আমজনতার স্বাধীন জীবনপ্রবাহ।
এ ভাবেই চলত তাদের দিন। মানচিত্রের বিন্দুগুলি নিয়ে দুই দেশের টানাপড়েনও চলত। সে বিন্দুগুলো যেন চরম অমানবিকতার বিন্দু। একটা দেশের লজ্জাবিন্দু। এ যেন সব জেনে-বুঝে অমানবিকতার খেলা। মানবতার কোনও কাজ করে দেখানোর চেয়ে জনপ্রতিনিধিদের গদির মূল্য যে অনেক অনেক গুণ বেশি। তবু বলব, দেরিতে হলেও সমাধান যেটুকু হয়েছে তাতেই স্বস্তি। আর এ স্বস্তির কারণ অবশ্যই সঙ্গত।
আজ অনেকেই বলছেন, সে সব দিন আর নেই। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা জরুরি কিছু প্রশ্ন— ফিরিয়ে দিতে পারবেন মানুষগুলোর জীবনের সামান্য নুন-পান্তার সুখ? যা যুগ যুগ ধরে সেই বিভীষিকাময় কালো রাত ছিনিয়ে নিয়েছে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতায়? যারা আজীবন আলুকাবলি, মটন বিরিয়ানি আর এসির মোড়কে আলালের ঘরের দুলালের মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত। আসলে কোনও গুরুতর সমস্যাকে দীর্ঘদিন গুরত্ব না দেওয়ার কারণে তার শেকড়-বাকড় সমাজের গভীরে গেঁড়ে বসলে তা নির্মূল করা সাধ্যাতীত হয়ে পড়ে। যেন আগামীতে এমন ঘটনার সাক্ষী কাউকে না হতে হয় এই বলে আমার কথার ইতি টানছি।
দলিমৌলা ঝিটকিপোতা আদিবাসী প্রাথমিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy