করোনা কবলিত বিশ্বে নিরাময়ের উপায় এখনও অধরা। কতগুলো প্রতিরোধ-পন্থা পালনের জন্য আবেদন-নিবেদন, আবার কখনও বা পালনের জন্য আইনি ফাঁস। ঔপনিবেশিক ভারতের মহামারি সংক্রান্ত আইনের পুনঃপ্রয়োগ। ভারতীয় জনসমাজ, যা নানা ধর্ম-বর্ণ-বিত্তে বিভক্ত, তাঁদের কাছে ব্যাধির সামাজিকতা-রাজনৈতিকতা নানা ভাবে ধরা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ভারতীয় জনসমাজের মনটি যেন সেই উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক ভারতেই আটকে আছে। প্রশাসনের কাজেকর্মেও উনিশ শতকের ছায়া। কোথাও কোথাও স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজ-প্রশাসনিকতার চেহারা-চরিত্র থেকে স্বাধীন ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজনীতির অভিমুখ ভিন্ন।
মিস মার্গারেট নোবল তখন কিছু দিন হল এসেছেন কলকাতায়। এ তাঁর আচার্য বিবেকানন্দের দেশ। শ্বেতাঙ্গিনী বুদ্ধিমতী অনুভূতিপরায়ণ মার্গারেট, যিনি ভগিনী নিবেদিতা হয়ে উঠবেন, তিনি এ দেশের মানুষদের চিনতে-বুঝতে চাইছেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা— এই দুটি ক্ষেত্রে তাঁর কাজ করার কথা। তাঁর কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে একটি লেখা: ‘ক্যালকাটা নোটস বাই অ্যান ইংলিশ লেডি’। কোনও সংবাদপত্রের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন লেখাটি। রচনার তারিখ ৪ মে ১৮৯৮। এ লেখায় নিজেকে ইংলিশ লেডি বলে চিহ্নিত করেছেন মার্গারেট, স্বাভাবিক। তখনও এ দেশের, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা হয়ে ওঠেননি তিনি। রচনাটির মধ্যে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে এ দেশের সাধারণ মানুষের প্লেগ-সম্বন্ধীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ছবি এঁকেছেন। পরে নিবেদিতার ইংরেজি লেখায় এই নৈর্ব্যক্তিকতা চোখে পড়ে না, ভারতকে ভালবাসার আবেগে বিষয়ের সঙ্গে সংসক্ত হয়ে পড়েন। তখন আর বিষয় নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক কৌতুক আর বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটাতে চাইত না তাঁর মন।
মার্গারেট লিখেছেন, তখনও শহরে প্লেগ মহামারির আকার ধারণ করেনি, তবে আক্রান্তদের একঘরে করে রাখার আইন পূর্ণোদ্যমে প্রয়োগ করছে ইংরেজ সরকার। একঘরে হয়ে থাকার ভয়ে পিলপিলিয়ে শহর ছাড়ছেন সাধারণ হিন্দু-মুসলমান। রোগের ভয়ের থেকেও যেন একঘরে হয়ে থাকার ভয় অনেক বেশি। থেকে থেকে গুজব ছড়াচ্ছে শহরে। অভিজাত আর অনভিজাতদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক এক রকম নয়। গুজব ছড়াল, অভিজাতদের সঙ্গে সরকার বাহাদুরের গোপন মিটিং হয়েছে, অভিজাতরা একঘরে করে দেওয়ার আইন সমর্থন করেছেন, তার পর নিজেরা এ বার শহর ছেড়ে পালাবেন। পড়তে পড়তে মনে হয়, মহামারি-মোকাবিলা সংক্রান্ত নিয়ম সবার জন্য এক নয়: এমন ভাবনা জনসমাজে প্রবল। করোনার ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গীয় সরকার এখনও অবধি সুদৃঢ়, নইলে বিশিষ্ট বিত্তশালীদের মধ্যে কেউ কেউ ভেবেই নিচ্ছিলেন, ‘একটেরে’, ‘অন্তরিন’ করে রাখার সরকারি নিয়ম ও ব্যবস্থাপনায় অভিজাতদের পরিষেবা প্রাপ্তিতে খামতি থাকছে। টাকা দিয়ে বেসরকারি চিকিৎসালয়ে যে পরিষেবা কেনা যায়, এ ক্ষেত্রে তো তার সুযোগ নেই। টাকার ব্যক্তিগত পরিসর আর সরকারের সার্বিক পরিসর— দুইয়ের লড়াই উঁকি মারতে চায়।
এরই মধ্যে প্লেগ-প্রতিরোধক টিকাকরণ কর্মসূচি চালু হল। টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ভয় আর সন্দেহের শেষ নেই। তখনও পর্যন্ত, টিকা ও অন্যান্য বিষয়ে নির্দেশনামা ইংরেজিতে বিলি করছেন সরকার। দেখে মার্গারেট খুবই বিরক্ত, বেদনার্ত। তাঁর মনে হচ্ছে, শহরের শান্তি বজায় রাখার জন্য সাধারণ নিরক্ষর মানুষদের তো সব কিছু বুঝিয়ে বলা চাই। অথচ ‘‘নো এফর্ট ওয়াজ় মেড টু প্রোমালগেট হিন্দুস্তানি অর বেঙ্গলি ট্রানস্লেশনস অ্যামং দি আনরেড।’’ এই আক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুস্তানি ও বাংলা— এই দেশজ ভাষা দুটিতে সহজ করে বুঝিয়ে দিলে, এ ভাবে গুজবে-ভয়ে তখনকার সাধারণের দিন কাটত না।
ভাবতে ইচ্ছে করে, ঠিকমতো জনসংযোগ গড়ে তুলতে না পারার ব্যাধি তো কেবল ইংরেজ সরকারের মধ্যেই প্রবল ছিল না, এ জাতীয় শ্রেণিস্বার্থভিত্তিক জনসংযোগ তো সেই সময়কার জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেও চোখে পড়ে। কংগ্রেসের সেই সময়ের প্রথম সারির নেতারা সকলেই বাগ্মী। তাঁদের বাগ্মিতার ভাষা কিন্তু ইংরেজি। রবীন্দ্রনাথের মতো কেউ কেউ উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে বাংলা ভাষার গুরুত্বের কথা বলছেন। কংগ্রেসের প্রাদেশিক অধিবেশনে বাংলা ব্যবহারের কথা উঠতে শুরু করছে। গাঁধী কংগ্রেসের দায়িত্ব গ্রহণের পর এই রাজনৈতিক দলটির ভাষা-নীতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়রা অবশ্য মনে করতেন, তাঁদের ইংরেজি যেমন সাধারণ চাষাভুষোরা বোঝে না, তেমনই রবীন্দ্রনাথের বাংলাও তাদের বোঝার কথা নয়।
এ দিক থেকে এখন ভারতীয় প্রশাসন অবশ্য এগিয়ে। তাঁরা করোনায় কী করণীয়— তা দেশজ ভাষাতেই প্রচার করছেন। অবশ্য তা হলেও অনেক সময় বলা মুশকিল, সরকার আদতে কতটা জনমর্মী। করোনার অ্যাজেন্ডাটিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাঁদের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। ফলে সব কথা জনসাধারণ শুনতে নারাজ। না-শোনার পিছনে বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি বিরাগও কখনও কখনও স্পষ্ট। হিন্দু-মুসলমান বিভেদের যে রাজনীতি সম্প্রতিকালে এ দেশে রমরম করে বাড়ছে, তার জেরও সাম্প্রতিক করোনা-সম্বন্ধীয় জনপ্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী মোদীর কথায় থালা বাজাতে বাজাতে বাইরে এসে জমায়েত হতে চাওয়া ভারত, আর পার্ক সার্কাসের দরিদ্র মুসলমান মহল্লার ভারত, যেন ভেদ-রেখার দুই দিকে। বিশিষ্ট রাজমিস্ত্রি ইব্রাহিম কিছুতেই বুঝতে চাইছিলেন না করোনার নির্দেশনামা। তাঁর মনে হচ্ছিল, এ সবই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির চক্রান্ত। তাঁদের বেরোতে না দিয়ে আরও বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে। মোবাইলে অনেক বোঝানোর পর টালিগঞ্জে ছোটবেলার হিন্দু-দিদির বাড়িতে কাজে যাওয়া বন্ধ রেখেছেন। ‘তুমি যখন বলছ দিদি’, আমতা-আমতা করে শেষ অবধি মেনে নেন ইব্রাহিম। করোনা নিয়ন্ত্রণের সার্বিক নীতি, আর সেই নীতির তলায় অ্যাজেন্ডা কন্ট্রোলের চতুর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য— দুই-ই খেলা করে যাচ্ছে, এ অস্বীকার করার উপায় নেই। সত্যি, এ তোমার-আমার পাপ। এই হিন্দু-মুসলমান বিভেদকারী পাপের এক রকম শুরুও সেই উনিশ শতকেই।
মার্গারেট লিখেছেন, ইংরেজ সরকারকে হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানেরা অবিশ্বাস করেন বেশি। কারণ তারা কখনও ভুলতে পারে না যে ব্রিটিশরা ‘তাদের’ শাসনের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। দুর্বৃত্তরা প্লেগ-সঙ্কটাপন্ন কলকাতায় দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টাও করে। মার্গারেটের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, তারা মহল্লায়-মহল্লায় সুযোগের সন্ধানে ঘোরে। "দাঙ্গা লাগিয়ে লাভবান হয় কিছু গোষ্ঠী, এবং সেই সুযোগ খোঁজার জন্য বেশ কিছু দুর্বৃত্ত নেটিভ কোয়ার্টার-এ ঘুরে বেড়ায়।’’ সরকার দাঙ্গা থামানোর জন্য তৎপর। অনেকেই গোপনে বন্দুক কিনছিলেন। পুলিশ সেই ষড়যন্ত্র আটকানোয় সফল। প্লেগের আশঙ্কায় যখন শহর উত্তপ্ত, তখন ধর্মীয় উৎসব হবে কি না, তা নিয়েও কথা ওঠে। চিৎপুর রোড দিয়ে যাচ্ছিলেন মার্গারেট আর তাঁর শ্বেতাঙ্গ সঙ্গিনী। দেখলেন, অধিকাংশ বাড়িই বন্ধ, জনহীন। এরই মধ্যে কয়েক জন হিন্দু ভারতীয় তাঁদের পিছু নিলেন। মার্গারেট আগেই খেয়াল করেছিলেন তাঁদের। মেমসাহেবদের দেখে কৌতূহলী জনতা অঙ্গভঙ্গি করছিল। তার পর পিছু নেয়, দেশ-কাল-সমাজের খবরাখবরও দেয় মার্গারেটদের। সাবধানও করে। সামনেই নাকি ইংরেজদের সঙ্গে মুসলমানদের দাঙ্গা লেগেছে। মেমসাহেবরা সেখানে গেলেই দাঙ্গায় পড়বেন।
সাধারণের প্লেগের টিকার ব্যাপারে সংশয় যাচ্ছিল না বলে, ব্রাহ্মসমাজীরা এগিয়ে আসেন। ষাট জন ব্রাহ্মসমাজী প্লেগের টিকা নেন। প্লেগের হাত থেকে রেহাই লাভের জন্য যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দরকার, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষের অপার অজ্ঞতা। পরে যখন মার্গারেট হাতে-কলমে প্লেগ-প্রতিরোধের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তখন সে অসহায় অজ্ঞতার স্বরূপ তাঁর কাছে আরও স্পষ্ট হয়েছিল। প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা, ব্যাধিগ্রস্তের থেকে প্রয়োজনীয় দূরত্ব, কোনও কিছুই রক্ষা করতে নারাজ সাধারণ মানুষজন।
মার্গারেটের লেখা পড়তে গিয়ে মন যেন থম মেরে যায়।
আধিব্যাধির বিরুদ্ধে মানুষের অসহায়তার সামাজিক রূপ নানা রকম। করোনার করাল গ্রাস থেকে বিশ্ব মুক্ত হবে, আশা করতে ইচ্ছে করে। ভারতবর্ষের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রে, রাজনীতির স্বার্থ-শর্ত আর ব্যাধিমুক্তির সার্বিক বিধি: দুই যেন পেয়ালা-পিরিচ। একটির সঙ্গে আর একটির সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। তারই ঠুনঠুন শব্দ চারদিকে। ভয় হয়।
মুক্তি এক দিন মিলবে— এমন আশাবাদে নিরুপায় ভরসা রাখা ছাড়া উপায় নেই।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy