যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে যে রাজনৈতিক ঘূর্ণিটি আত্মপ্রকাশ করিয়াছে, কালে দিনে তাহা একটি বৃহৎ দুর্বিপাকে পরিণত হইবার ক্ষমতা রাখে। বিজেপির নিজের রাজনীতির ফাঁস তাহার নিজের গলায় চাপিয়া বসিতে পারে। সহারনপুরের প্রবল দলিত-ঠাকুর সংঘর্ষ ও তাহার পর দিল্লি পর্যন্ত দলিত আন্দোলনের বিস্তার সেই ইঙ্গিত রাখিয়া গেল। উত্তরপ্রদেশের এই অঞ্চলটি এমনিতেই অত্যন্ত উত্তেজনাপ্রবণ। এবং সংঘর্ষপ্রবণ। জনসংখ্যার বিন্যাস ও রাজনৈতিক বিভাজননীতির সাম্প্রতিক বিস্তারের কারণেই আক্ষরিক অর্থে ইহা একটি ফুটন্ত জলাধার। ৪০ শতাংশ মুসলিম, এবং ২২ শতাংশ দলিত অধ্যুষিত অঞ্চলটিতে নূতন ঠাকুর-রাজ বড় সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করিবে, ইহাই স্বাভাবিক। দীর্ঘ পনেরো বৎসর একাদিক্রমে মায়াবতীর নেতৃত্বে দলিত সামাজিক উত্থান ঠাকুর সম্প্রদায়ের অতীব গাত্রদাহ ঘটাইয়াছিল। অবশেষে পাশার দান উল্টাইবার ফলে সেই দাহের উপশমে তাহারা উঠিয়া-পড়িয়া লাগিবে, তাহাতে আশ্চর্য কী। বিএসপি আমলে দলিতদের গায়ে হাত তুলিবার আগে কয়েক বার ভাবিতে হইত। এখন সহজেই তাহাদের বাড়িঘর জ্বালাইয়া পুড়াইয়া দেওয়া য়ায়, পুলিশ-প্রশাসন অপার নিষ্ক্রিয়তায় দুষ্কৃতীদের সহায়ক হয়। যুগ যুগ ধরিয়া যে উচ্চবর্ণ-অত্যাচারে দলিত সম্প্রদায় নিমজ্জিত, সেই সামাজিক নির্যাতন আবার দ্বিগুণ প্রাবল্যে ফিরিয়া আসিতেছে। যোগী-রাজের অবধারিত ফল।
দ্বিতীয়ত, মুসলিম-দলিত-ঠাকুর জনগোষ্ঠীর সহাবস্থানের সুযোগ লইয়া বিজেপি এই অঞ্চলে যে রাজনীতি তুঙ্গে তুলিয়াছে, তাহারও অনিবার্য ফল এই সংঘর্ষ। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোট ঘিরিয়া এই অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে মেরুকরণের রাজনীতি চলিয়াছে। উত্তরপ্রদেশের সর্বাধিক সংখ্যক দাঙ্গা ঘটিয়াছে এই অঞ্চলে, ২০১৫ সালেই ১৬৯টি দাঙ্গার হিসাব মিলে। তবে দাঙ্গা হউক বা না হউক, এই অবকাশে উত্তেজনাময় আত্মপরিচয়ের রাজনীতি যে ভালমতো প্রোথিত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। গুজব ছড়াইয়া দ্রুত মারমুখী জনতার বলয় তৈরি করিয়া ফেলা এখানে নিত্য-নৈমিত্তিক বাস্তব। বিজেপির বিভাজনী রাজনীতি সেই অর্থেই ব্যুমেরাং হইয়া দাঁড়াইবার জোগাড়। দলিত জনতা একটি ক্ষেত্রে মুসলিমবিরোধী হইয়াও অন্য ক্ষেত্রে ঠাকুরবিরোধী হইতেই পারে, এমন দৃষ্টান্ত ভারতীয় রাজনীতিতে বহুদৃষ্ট। সুতরাং দলিত আইকন অম্বেডকরকে লইয়া যখন বিজেপির স্লোগান-পতাকাসহ ঠাকুর সম্প্রদায়ের জনতা মিছিল-মিটিং শুরু করিল, সশস্ত্র দলিত বাহিনীর ছুটিয়া আসিতে সময় লাগে নাই।
দলিত আন্দোলন বলিতে একটি সম্পূর্ণ সঙ্ঘবদ্ধ বিদ্রোহ ভাবিলে অবশ্য ভুল হইবে। গত মাসের অভিজ্ঞতা দেখাইয়া দিয়াছে, কী ভাবে দলিত আন্দোলনের মধ্যে দ্রুত সামাজিক অভিযোজন চলিতেছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী বা ভীম বাহিনীর চন্দ্রশেখরের মতো পোড়-খাওয়া নেতারা আর নিয়ন্ত্রণের পুরোভাগে নাই, তরুণ নেতারা তাঁহাদের স্থান লইতেছেন। ভীম বাহিনী ইতিমধ্যেই সরিয়া গিয়াছে, তাহারা এই সহিংস আন্দোলনের ভাগিদার হইতে অনিচ্ছুক। লক্ষণীয়, এই নূতন নেতারা দলিত রাজনীতিকে আত্মরক্ষামূলক আন্দোলনে সীমায়িত রাখিতে নারাজ, অত্যাচার-অনাচারের প্রতিবাদই তাঁহাদের কাছে যথেষ্ট নয়, বরং অনেক আগ্রাসী ভঙ্গিতে তাঁহারা নিজেদের ক্রমবর্ধমান দাবি-দাওয়া তুলিয়া ধরিতে চান, সামাজিক অগ্রগতির সোপানে নিজেদের পদচিহ্ন রাখিবার সুযোগ নিশ্চিত করিতে চান। এই নূতন দলিত রাজনীতি বিজেপির আইডেন্টিটি-ভিত্তিক পশ্চাৎমুখী রাজনীতির বিপ্রতীপে যাইবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তাহাতে আর কিছু হউক না হউক, বিজেপির স্বপ্নের মেরুকরণ প্রকল্পটি মার খাইতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy