Advertisement
১৬ মে ২০২৪

দু’টি মৃত্যু জন্ম দিল কিছু প্রশ্নের

যাঁরা নার্সিংয়ে সুযোগ পান, তাঁরা প্রাপ্ত নম্বরের নিরিখে অবশ্যই মেধাবী। কিন্তু এটাও ঠিক, উচ্চ মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর দেখে আজকাল প্রকৃত মেধার বিচার করা চলে না। নম্বর যে পড়ুয়ার মেধার মাপকাঠি নয়, অন্তত বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায়, তা বোঝার সময় এসেছে। লিখছেন সিদ্ধার্থ গুপ্তপ্রথমত, যাঁরা নার্সিংয়ে সুযোগ পান, তাঁরা উচ্চ মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বরের নিরিখে অবশ্যই মেধাবী। উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকার সুবাদে ইদানীং একটি বিষয় খেয়াল করেছি।

সমাপ্তি রুইদাসের বাবা। ফাইল চিত্র

সমাপ্তি রুইদাসের বাবা। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৯ ০১:৫৮
Share: Save:

সম্প্রতি দু’টি যন্ত্রণাদায়ক ঘটনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। দু’টি তাজা প্রাণ অকালে চলে গেল। প্রথম জন, সমাপ্তি রুইদাস। বাঁকুড়ার কোতুলপুরের বাসিন্দা মেয়েটি কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যালে নার্সিংয়ের ছাত্রী ছিলেন। সইবিহীন ‘সুইসাইড নোটে’ ছিল ইংরেজি নিয়ে অস্বাচ্ছন্দ্যের কথা। আত্মীয়-পরিজনদের তরফে যদিও র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। দ্বিতীয় জন, বিষ্ণুপুরের বনমালীপুরের রিয়া দে-ও বর্ধমানে একটি নার্সিং ট্রেনিং স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। তবে মর্মান্তিক ঘটনা দু’টি অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেল, যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত চেহারা আরও এক বার সামনে আনবে।

প্রথমত, যাঁরা নার্সিংয়ে সুযোগ পান, তাঁরা উচ্চ মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বরের নিরিখে অবশ্যই মেধাবী। উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকার সুবাদে ইদানীং একটি বিষয় খেয়াল করেছি। তা হল, উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল নম্বর পাওয়া ছাত্রীরা বিভিন্ন কলেজে বিএ, বিকম বা বিএসসি-তে ভর্তি হয়েও অভিভাবকদের চাপে বা সুনিশ্চিত কাজ পাওয়ার জন্য তা ছেড়ে বিএসসি নার্সিং, ‘জিএনএম’, ‘এএনএম’-এর মতো কোর্সে ভর্তি হচ্ছেন। অন্য পেশায় চাকরির অপ্রতুলতা যে এর একটা বড় কারণ, তা অস্বীকার করা যায় না। অনেক দরিদ্র পরিবারের মেয়েরাও প্রয়োজনে অনেক বেশি টাকা দিয়ে রাজ্যে ও রাজ্যের বাইরে নার্সিং কোর্সে ভর্তি হন। এর মধ্যে অনেকেই হয় তো শারীরিক বা মানসিক ভাবে নার্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার উপযুক্ত নন। কিন্তু তা আর বোঝে কে!

উচ্চ মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর দেখে আজকাল আর প্রকৃত মেধার বিচার করা চলে না। বেশি নম্বর মেলে এমন বিষয় নির্বাচন, অভ্যন্তরীণ ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার সুবাদে আর সর্বোপরি টিউশনের কিছু ‘নোট’ পরীক্ষার খাতায় উগরে দিতে পারলে অনেক ক্ষেত্রেই ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর এসে যাচ্ছে। তবে এই নম্বর যে পড়ুয়ার মেধার নির্ভুল মাপকাঠি নয়, অন্তত বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায়, তা বোঝার সময় এসেছে।

বিশেষত ইংরেজি ভাষায় দখল কম থাকায় পড়ুয়ারা কোনও ধরনের উচ্চ শিক্ষাতেই সাফল্য পাচ্ছেন না। আর এ কথা কে না জানে, ইংরেজি ছাড়া, উচ্চশিক্ষায় এক পা এগনোও কার্যত অচল। নার্সিং-এর ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। আর নার্সিংকে আর পাঁচটা পেশার সঙ্গে এক করা চলে না। সকলেই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল হবেন, তা নয়। তবে ন্যূনতম সাহস, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সেবাপরায়ণ মনোভাব না থাকলে এই পেশায় আসা মনে হয় উচিত নয়। তা ছাড়া, নার্সিংয়ের পঠনপাঠন কোনও অংশে সহজ নয়। শারীরবিদ্যা, অস্থিবিদ্যা, ঔষধবিজ্ঞান-সহ নানা বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দরকার, যা এখনও মাতৃভাষায় দেওয়া সম্ভব নয়। কাজেই ইংরেজি ভাষায় একটি স্তর পর্যন্ত দখল ও বিজ্ঞানের বুনিয়াদ না থাকলে কেবল কর্মসংস্থানের কথা ভেবে এই পথে যাওয়া সমীচীন নয় বলেই মনে হয়। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বড় ভূমিকা নিতে হবে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মরীচিকায় সন্তানকে ঠেলে দেবেন না। তার পছন্দ-অপছন্দের খেয়াল রাখাটাও সমান জরুরি।

এর পাশাপাশি, আরও কয়েকটি প্রসঙ্গ ভেবে দেখা দরকার। বর্তমান সময়ে একটি বা দু’টি সন্তানের পরিবারে বড় হয়ে ওঠা শিশুরা বাবা-মায়ের ছোট গণ্ডীর বাইরে বৃহত্তর জগতের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে না। অপর দিকে, ‘সোশ্যাল মিডিয়া’র সৌজন্যে এক অলীক জগতে জড়িয়ে পড়ছে। বাড়ছে চাহিদা। অন্যের জিনিসে প্রলুব্ধ হয়ে তা করায়ত্ত করার তীব্র বাসনা বাড়াচ্ছে অপরিসীম চাপ। তা জন্ম দিচ্ছে হতাশা, কখনও মানসিক অবসাদে।

সঙ্গে রয়েছে ‘র‌্যাগিং’-এর মতো ঘটনাও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হস্টেলে ‘র‌্যাগিং’ নিষিদ্ধ হলেও এখনও মাঝেমধ্যেই সংবাদপত্রের পাতায় ‘র‌্যাগিং’-এর অভিযোগ চোখে পড়ছে। এতে মানসিক ভাবে দুর্বল ছেলেমেয়েরা হীনমন্যতায় ভুগে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, এমন নজিরও রয়েছে। কী করবে ভেবে না পেয়ে বিভ্রান্তি আরও বাড়তে থাকে। সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব এমনকি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দ্বারাও লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে হয় বলে অভিযোগ। এ সব কারণ সম্মিলিত ভাবে কোনও খারাপ পরিণতির দিকে ছেলে বা মেয়েটিকে নিয়ে যেতেই পারে।

আত্মহত্যা সমবয়সি ও সমমনোভাবাপন্ন মানুষকে একই পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এড়াতে সন্তানকে প্রাথমিক স্তর থেকেই তৈরি করুন। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা তৈরি না হলে কেবল টিউশনের ‘নোটভিত্তিক’ শিক্ষা নিয়ে বেশি দূর এগনো যাবে না। এমনকি, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও একই কায়দায় গাদা গাদা নম্বর পেয়ে বাস্তব কর্মমুখী উৎকর্ষ তৈরি হচ্ছে না। ফলে, চাকরি পেলেও সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর অভাব দেখা দিচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয় ও অবমূল্যায়ন আরও বেশি করে চোখে পড়ছে।

আর লেখাপড়ার পাশাপাশি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও তার সদ্ব্যবহার ক্রমশ কমে যাচ্ছে। কারণ, অবশ্যই ‘সোশ্যাল মিডিয়া’র বাড়বাড়ন্ত আর স্কুলের চেয়ে পড়ুয়াদের অধিক টিউশন-নির্ভরতা। এ সবের ফলে, স্কুলের সঙ্গে পড়ুয়ার যোগাযোগ আলগা হচ্ছে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে এখনই তা বদলাতে উদ্যোগী না হলে, হয় তো আরও বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আমাদের।

লেখক অধ্যক্ষ, বাঁকুড়া জিলা সারদামণি মহিলা মহাবিদ্যাপীঠ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Nursing Student Suicide
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE