Advertisement
১০ জুন ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

অপমানের ছুটি

এ বার ছুটি বিতরণের পাত্র ‘বেচারা’ পার্শ্বশিক্ষকগণ। তাঁহাদের নামের সহিত শিক্ষক শব্দটি রহিয়াছে বটে, তথাপি শিক্ষকের উপযুক্ত মর্যাদা তাঁহারা কোনও দিক হইতেই পান না।

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

নাকের বদলে নরুন, দুধের বদলে পিটুলিগোলা— একের বদলে আর একের রকমারি উদাহরণ লোকশ্রুতিতে রহিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এই তালিকায় অপর একটি নিদর্শন যোগ করিয়াছেন। বেতনের বদলে ছুটি। রাজ্য সরকারি কর্মীদের বকেয়া মহার্ঘ ভাতা মিটাইবার দাবি উঠিলে মুখ্যমন্ত্রী পূজার সময় অতিরিক্ত ‘ছুটি’ প্রদান করিয়াছিলেন। পুনরায় তিনি ছুটি-প্রদানে দরাজহস্ত হইয়াছেন। এ বার ছুটি বিতরণের পাত্র ‘বেচারা’ পার্শ্বশিক্ষকগণ। তাঁহাদের নামের সহিত শিক্ষক শব্দটি রহিয়াছে বটে, তথাপি শিক্ষকের উপযুক্ত মর্যাদা তাঁহারা কোনও দিক হইতেই পান না। তাঁহাদের বেতনও নিতান্ত সামান্য। তাঁহারা বেতনবৃদ্ধির দাবি তুলিয়াছিলেন। সেই দাবিতে কর্ণপাত না করিয়া রাজ্য সরকার তাঁহাদের ‘ক্যাজুয়াল লিভ’ আরও দুই দিবস বর্ধিত করিয়াছেন। ইহাতে পার্শ্বশিক্ষকরা সংগত কারণেই ক্ষুব্ধ। শাসকদলাশ্রয়ী পার্শ্বশিক্ষকদের সংগঠনও অর্থের পরিবর্তে ছুটিদানের এই সিদ্ধান্তকে অপমান বলিয়াই মনে করিতেছেন।

হীরক রাজার আদেশে যখন শিক্ষামন্ত্রী দলবল লইয়া আসিয়া পাঠশালা বন্ধ করিয়া ছুটি ঘোষণা করিলেন, শিক্ষকের অপমান হইয়াছিল। কেহ বলিতেই পারেন হীরক রাজ্যের সহিত এই ছুটিদানের তুলনা চলে না। মুখ্যমন্ত্রী তো আর বিদ্যালয় বন্ধ করিয়া দিতেছেন না। সত্য কথা। অবশ্য নিন্দুকের প্রত্যুত্তর হইতে পারে, ৩৬৫ দিন ছুটি দিলেই হইল, তখন আর বেতন দিবার প্রয়োজনও হইবে না। বেতন ও ছুটি যদি তুলনীয় হয়, তবে অর্থনৈতিক ভাবে অভাবকাতর রাজ্য-সরকার যে কালে-দিনে এই নীতিই গ্রহণ করিবেন না, কে বলিতে পারে! নিন্দুকের রসিকতা থাকুক। ছুটি প্রদানের বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে কর্মনাশা মানসিকতার ফল। পশ্চিমবঙ্গবাসী কোনও কালেই কর্মতৎপর নহেন। মুখ্যমন্ত্রী তাহা বিলক্ষণ জানেন বলিয়াই কি ছুটির তাসখানি খেলিতেছেন? আফিমখোরকে আফিম দিয়া ভুলাইয়া রাখিবার ন্যায় ছুটিখোরকে অধিকতর ছুটি দিয়া ভুলাইয়া রাখিবার নব্য রাজনৈতিক কৌশল? কিন্তু ইহাতে তো শিক্ষার গোড়ায় আঘাত লাগিতেছে! মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে তাহা কি উচিত কাজ হইতে পারে? তিনি কি এই বিষয়ে ভাবিয়া দেখিয়াছেন? কেহ যদি মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী নিতান্ত সরলচিত্তে দুই দিবসের ছুটি বৃদ্ধি করিয়াছেন, তাহা হইলে বলিতে হয়, ‘সরলচিত্ত’-এর ন্যায় মর্মান্তিক আর কিছুই নাই। সরলতা কোনও কোনও ক্ষেত্রে অন্যায় এবং বিপজ্জনক।

পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজে ক্ষয় ধরিয়াছে। আত্মসম্মানবোধের বিসর্জন সেই নানারূপী ক্ষয়ের অন্যতম। ক্ষয়রোগ সর্বগ্রাসী। তাহার থাবা নাগরিকের বাচনভঙ্গি, পারস্পরিক ব্যবহার এমনকী কল্পনাতেও স্পষ্ট। ইহা আশঙ্কার। বিশ্বদরবারে ‘ব্র্যান্ড’ বাংলাকে ভূলুণ্ঠিত করিতে এই একটি রোগই যথেষ্ট। এমতাবস্থায় নেতানেত্রীদের কর্তব্য, দ্রুত পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করিয়া মেরামতিতে মন দেওয়া, নাগরিকের হৃত আত্মসম্মানবোধ সসম্মানে ফিরাইয়া আনা। বিশেষত, শিক্ষক সমাজের। কারণ, ভবিষ্যৎ গড়িবার গুরু দায়িত্বটি তাঁহাদেরই হাতে। এবং সেই সম্মান ফিরাইতে চাহিলে হঠকারী পদক্ষেপ করা চলে না। তাহার পূর্বে একটু থামিতে হয়, চিন্তা করিতে হয়, উচিত-অনুচিতের সীমারেখাটি জানিতে হয়। মুখ্যমন্ত্রী শুনিতেছেন কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Leave Money
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE