নূতন সংসদ ভবনের ভিতপূজা উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গণতন্ত্রের মাহাত্ম্যবর্ণন করিয়াছেন। নীতি আয়োগের প্রধান অমিতাভ কান্তের মুখেও ইতিমধ্যে শোনা গিয়াছে যে এই দেশে ‘বড় বেশি গণতন্ত্র’। অবশ্য পরে ঢোঁক গিলিয়া এই মন্তব্য তিনি অস্বীকারও করিয়াছেন। তৎসত্ত্বেও এইটুকু ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে, কেন্দ্রীয় সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা দেশে গণতন্ত্রের প্রাবল্যই দেখিতেছেন, হয় গৌরবান্বিত ভাবে, নয়তো উদ্বেগের সহিত। অথচ সত্য বলিতে, বিড়ালের হাসিটুকু চলিয়া গেলে যে ছায়াটুকু রহিয়া যায়, এ দেশের গণতন্ত্রের দশা এখন তেমনই। নির্বাচন যদি গণতন্ত্রের একমাত্র চিহ্ন হিসাবে অন্য সব মানদণ্ডকে অপ্রাসঙ্গিক করিয়া দেয়, তবে আলাদা কথা। কিন্তু সেই মানদণ্ডগুলি যদি একটুও অর্থপূর্ণ হয়, তাহা হইলে ভারতের পরিস্থিতি ক্রমশই সঙ্গিন হইতে বিপন্ন, এবং তাহা হইতে ভয়াবহের দিকে যাত্রা করিতেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অমিতাভ কান্তের উদ্বেগটি তবু বোঝা যায়— যেটুকু যাহা অবশিষ্ট আছে, তাহাও তাঁহাদের অভিপ্রায়ের তুলনায় ‘বড় বেশি’, ইহাই আর কী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদীর গৌরববাচন সত্যই স্তম্ভিত করে। হয় আত্মস্তুতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার অসুখ, নতুবা দেশব্যাপী জনসাধারণকে অসত্যভাষণে ও অসদাচরণে বিভ্রান্ত করিবার প্রয়াস: এই দুইটির বাহিরে আর কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল।
বাস্তবিক, গণতন্ত্র বস্তুটি কেবল নির্বাচন দিয়া সরকারকে ক্ষমতায় আনা নহে— গণতন্ত্র একটি অভ্যাস, রাষ্ট্রীয় যাপনের অভ্যাস। গণতন্ত্র একটি পরিসর, যেখানে শাসকের বিরুদ্ধতা করা চলে, কট্টরতর বিরোধী মত প্রকাশ করা চলে। গণতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় দর্শনের বিকল্প ভাবনা আলোচনা করা চলে। এই মুহূর্তে ভারতে গণতন্ত্রের অবস্থা কী রূপ, বুঝিতে হইলে বেশি গবেষণার দরকার নাই— প্রতি দিনের সংবাদে একের পর এক জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। এই ভারতে অশীতিপর পাদ্রি, অতি অসুস্থ কবি, অন্ধপ্রায় সমাজকর্মী, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিক, ছাত্র সকলকে জেলখানায় পোরা হয়, কেননা তাঁহাদের অপরাধ, তাঁহারা শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলিয়াছিলেন। গণতন্ত্রে নাগরিকের অধিকার অলঙ্ঘনীয়, অথচ নরেন্দ্র মোদী-শাসিত ভারতে মানুষের খাদ্যাভ্যাস হইতে বিবাহের সিদ্ধান্ত, সবেতেই গা-জোয়ারি চলে—শুধু ব্যক্তি বা দলের গা-জোয়ারি নহে, সরকারি ও রাষ্ট্রীয় জুলুমও বটে। এই সেই ‘গণতন্ত্র’, যেখানে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণের প্রচেষ্টা চলে, রাত্রের অন্ধকারে ধর্ষিতা দলিত কিশোরীর দেহ জ্বালাইয়া দেয় পুলিশ বাহিনী। একের পর এক আইন পাশ হয় বিরোধী বক্তব্য না শুনিয়াই, বিরোধী মত চাপা দিবার সব বন্দোবস্ত সক্রিয় থাকে। ইহা যদি জরুরি অবস্থা না হয়, তবে উনিশশো সত্তরের দশকের ভারতীয় ইতিহাসও নূতন করিয়া লিখিতে হইবে।
এই সেই নূতন ভারত যেখানে বিক্ষুব্ধ কৃষকদের ঠেকাইতে রাস্তা কাটিয়া দেওয়া হয়, আত্মঘোষিত হত্যাকারী সরকারি প্রশংসায় ভূষিত হন, আর প্রতিবাদীদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলিয়া দাগানো হয়। প্রতিবাদী মানেই হয় পাকিস্তানি, নয় নকশাল, নয়তো খালিস্তানি। বহু ক্ষেত্রে যে নাগরিকরা রাষ্ট্র ও সমাজের মঙ্গলকামনাতেই শাসকের বিরোধিতা করেন, বর্তমান জমানা সফল ভাবে এই কথাটি ভুলাইয়া দিয়াছে। শাসকের পথই একমাত্র পথ: গণতন্ত্র ছাড়িয়া এই ভারত ফ্যাসিতন্ত্রের দিকে অনেক দূর হাঁটিয়া আসিয়াছে। শাসক দলের সমর্থকরা বলিবেন, তবে কি চিনের কথা মনে করাইয়া দিব? বিরোধীদের উপর সাঁজোয়া গাড়ি চালাইবার কথা? এই প্রসঙ্গে সুবক্তা অরুন্ধতী রায়ের মন্তব্যটি মনে করিতে হয়: ঠিক কথা, ভারত এখনও চিন হইতে পারে নাই। তবে কিনা, ভারত গণতন্ত্রের পরীক্ষায় বসিয়াছিল, ট্র্যাজেডির প্রতিযোগিতায় নাম লিখায় নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy