Advertisement
E-Paper

নোট-এ মুড়োল?

‘এই এক নতুন’ বাগাতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে চরকি-নাচন নাচাচ্ছেন ইতিহাস গড়তে অতিব্যস্ত রাষ্ট্রকত্তারা।ওই এটিএম-টা খুলেছে? আপনাদের ওখানকারটায় টাকা আছে? একশোর নোট দিচ্ছে? এই এই যাঃ, শাটার টেনে দিল।

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০

ওই এটিএম-টা খুলেছে? আপনাদের ওখানকারটায় টাকা আছে? একশোর নোট দিচ্ছে? এই এই যাঃ, শাটার টেনে দিল। হ্যাঁ, এটা সরকারি হসপিটালের ওযুধের স্টোর, কিচ্ছু করার নেই দাদা, আগে আমরা পাঁচশোর নোট নিচ্ছিলাম, কিন্তু কুবেরের ভাণ্ডারও শেষ হয় জানেন তো? এ কী এনেছেন আবার? দু’হাজার টাকার নোট? ভাঙানি কে দেবে, আপনার বাবা? না না, এ মেডিসিন এখানে নেই, অন্য জায়গায় খোঁজ করুন। দাদা, আমার ছেলের এই টেস্টটা এখনই না হলে ডাক্তারবাবু চলে যাবেন, ওর অপারেশন পিছিয়ে যাবে। প্লিজ দাদা। কান্নাকাটি অন্য জায়গায় গিয়ে করুন কাকু, শুধু আপনার বাঁশ হয়নি, সবারই হয়েছে। আপনি দাদা স্মার্টকার্ডটায় পাঁচশোই ভরিয়ে নিন, দুশো-টুশো বললে করতে পারব না। আপনি ব্যাংকে টাকা চেঞ্জ করতে এসেছেন না ডিপোজিট করতে? ফর্ম প্রপারলি ফিল আপ করতে পারেননি? আরে প্রবলেমটা জানিস না? নতুন নোটের সাইজ আর মেশিনের টাকা বেরোবার স্লটগুলো মিলছে না। তা সাইজ মেলানোর কথা আগে ভাবা হয়নি কেন? ব্যাংকগুলো ব্যাপার সামাল দিতে পারবে কি না, খোঁজ না নিয়েই ডিসিশন নিয়ে নিল কেন? কী মুশকিল, অত ভাবতে গেলে ব্ল্যাকমানিওয়ালারা সাবধান হয়ে যেত। তা হলে যাদের ব্ল্যাকমানি নেই, তাদের বলি দেওয়া হবে, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্যে? আলবাত হবে। দেশে একটা বিপ্লব হবে, সেই ১৯৪৭ থেকে আজ অবধি যত ব্ল্যাক মানি, সব পাকড়ানো হবে, তা দেশের লোক আত্মত্যাগ করবে না? বলশেভিক বিপ্লবের সময় কোনও চায়ের দোকানদার কেয়ারলেস মিসটেকে গুলি খেয়ে যায়নি?

প্রেস কনফারেন্স বা ঢক্কা-বাতেলা, সর্বত্র শাসক দল বলছে, ফাটিয়ে দিয়েছি, স্লাইট অসুবিধে হতেই পারে, তবে এগুলো ক্ষণস্থায়ী। মানুষ অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী সুখের জন্য ক্ষণিক ইঞ্জেকশনের হ্যাভক হুল হজম করে নেয়, এখানেও প্রথম দিকে চকিত-চাবুকের ইশারায় বেশ উল্লাস উঠেছিল, কিন্তু দৈনিক এতখানি বিপর্যয় ভাবা যায়নি। এটিএম যে আসলে টাকা দেবে না, পেট্রল পাম্পরা যে ঝামেলা পাকাবে, স্ক্রিন-সেভারের ইতিবাচক বোলবোলা সে-আভাস ঢেকে রেখেছিল। আসলে, বিপ্লবাকাঙ্ক্ষা নিশ্চয় চমৎকার, কিন্তু ক্যাবলাকান্ত হলে বিপ্লবটা ঘটিয়ে তোলা শক্ত। আমি ঠিক করলাম ছ’বলে ছ’টা ছক্কা মারব, কিন্তু হাঁকড়াতে গিয়ে দেখলাম ফরওয়ার্ড শর্ট লেগ পার করার খ্যামতাও কবজিতে কুলোয় না, তখন ক্যাচ উঠবে আর আমায় নিয়ে হাসাহাসি হবে। একটা দুর্ধর্ষ নীতি গ্রহণ করলেই কেল্লা ফতে হয়ে যায় না। সেই নীতিটা বাস্তবায়িত করার বুদ্ধি, পরিকল্পনা, দূরদর্শিতা ও পরিচালনক্ষমতা থাকতে হয়। সম্ভাব্য সমস্যাগুলো আন্দাজ করে, তার মোকাবিলা-বন্দোবস্ত গড়তে হয়। নইলে, শুধু গিমিক দেওয়ার জন্যে দেশখেলনা না খেলাই ভাল। সব ব্ল্যাক মানি নষ্ট হবে, সবাই সাদাটে সৎ হয়ে যাবে, দেশে গাছে গাছে চকলেট ফলবে আর বিনিপয়সায় গড়াগড়ি সোনার পদ্মফুল, ইত্যাকার ফ্যান্টাসি-রচনা তুমি অলস দুপুরে গোড়ালি চুলকুতে চুলকুতে করতেই পারো, কিন্তু সে রকম একটা শৌখিন ও ব্লুপ্রিন্ট-বিহীন সাধের বশে একটা গোটা দেশের কোটি কোটি লোকের সর্বনাশ করে দেব, তার পর জিভটি অবধি না কেটে বলব ‘এট্টু অ্যাডজাস্ট করে লাও ভায়া’, এ কী প্রকারের ন্যাকামো? চাম্পি প্রতিজ্ঞা করতে সক্কলে পারে। ‘বাবা, বাবা, আমি ঠিক করেছি দশটা নোবেল প্রাইজ পাব।’ তার জন্যে কী করছ সোনা? ‘অ মা, এই যে বুক বাজিয়ে বললাম, এ-ই যথেষ্ট নয়? আবার ভেবেচিন্তে কাজও করতে হবে নাকি?’ অপদার্থদের ঝামেলা হল, তারা প্রায়ই নিজ ঔদ্ধত্য আর গলাবাজিকে সক্ষমতা বলে ভুল করে ফেলে। হ্যান করেংগা ত্যান করেংগা লম্ফ মারতে গিয়ে কত্তাবাবারা এটাই বিচার করতে ভুলে গেছেন, একটা বাড়িতে বাজার হবে কী করে? আয়াকে পয়সা দেবে কী করে? রাস্তায় খিদে পেলে খাবে কী করে? এটিএম খুঁজতেই দিন কাবার করে ফেললে অফিস যাবে কখন? এ সহজ স্বাভাবিক আটপৌরে ডিটেলগুলো ভাবার দরকার ছিল না? শুধু বৃহত্তর বিপ্লবের ভাবনায় ডুবে ছিলেন বলে হাই থিংকিং-এর লোকেরা সিম্পল লিভিং-এর সব সমীকরণ বেমালুম ভুলে স্টিমরোলার চালিয়ে দিলেন?

রজনীকান্ত, অমিতাভ বচ্চন প্রশস্তিতে ফেটে যাচ্ছেন, কারণ ওঁদের তো টাকা হাতে থলে বগলে কোনও দিন কাটাপোনা কিনতে যেতে হয়নি। ওঁদের ফ্ল্যাটারিতে ফুলে ইতিহাস-গড়ুয়ারা বলছেন, চেক দাও! অ্যাঁ? চেক? একটা ওযুধের দোকানে গিয়ে খসখস করে চেক লিখে দিলে তারা নেবে? দোকানিকে চেপে ধরে অরুণ জেটলির বক্তিমের রেকর্ডিং শোনালেও? ফুলুরি খেয়ে চেক দিলে সে তেলেভাজাওয়ালা পাঁচশো বা হাজারের বেশি অক্ষরের গালি ছুড়বে নির্ঘাত! মুদির দোকানে গিয়ে পাঁচশো চিনি আর পঞ্চাশ পোস্ত কিনে একটা লোক মুদির নামের বানান ভাল করে জেনে চেক লিখে দিল, এ দৃশ্য দেখালে তো পহলাজ নিহালনি-ই চিল্লানি জুড়বেন! দেশ নাকি পূর্ণ ডিজিটাল হয়ে যাবে, সমুদয় লেনদেন ফোনে-ফোনে হবে, এর অ্যাকাউন্ট থেকে ওর অ্যাকাউন্টে হুস করে টাকা উড়ে যাবে নিপুণ পারাবতের ন্যায়, এ সব তো শুনছি, কটাং কটাং মটরভাজার ন্যায় আড্ডায় চিবুচ্ছিও। কিন্তু ভিখিরিকে ফস করে চেক কেটে দেওয়ার চল যদ্দিন না হচ্ছে এ রামরাজ্যে, তদ্দিন ‘রুটি না পায় কেক খাক’-গুলো এট্টু চেপে খেললে হত না?

সবচেয়ে জরুরি: এ সবই বড় শহর আর তার আশপাশের গপ্পো। এ দেশের দুই-তৃতীয়াংশ লোক ব্যাংক-এটিএম ব্যবহারই করেন না। ডিজিটাল শুনলেই তাঁরা টাল খান। এঁরাই ভারতের অধিকাংশ নাগরিক। দেশটা কী, দেশটা কেন, এ বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান তো থাকতে হবে। শুধু তেরঙা বাগিয়ে বোম্বাস্টিক ভাষণ রিহার্স করলেই দেশ বোঝা যাবে? এ এক উদ্ভট ল্যান্ড— যাঁরা নীতি তৈরি করছেন, আর যে পিলপিলে জনসাধারণ আসলে দেশময় ঘোরাফেরা করছেন, তাঁদের মধ্যে কোনও তারসংযোগই নেই। ওপরের টেবিল আর নীচের ফুটপাথের মধ্যে এতটা দূরত্ব হয়ে গেছে, এ সদিচ্ছাময় এঁটো ছুড়লেও ও লুফতে পারবে না। এর বাক্যগুলো নীচে পড়তে পড়তে সিলেব্‌লগুলো ঝরে আ-কার ই-কার উলটেপালটে হিজিবিজি। এক গড় সাধারণ মানুষ কী ভাবে জীবন যাপন করেন, তা জানলে তবেই দেশ চালানো যায়। বা, দেশ চালাতে গেলে সেটা জেনে নেওয়া বেসিক হোমওয়ার্কের মধ্যে পড়ে। হ্যাঁ রে, চুপিচুপি বল তো, এ দেশের লোকেরা কি কেউ গরুর মাংস খায় না? সবাই কি সারা দিন ফেসবুকে নিজ ভুঁড়ির ক্লোজ-আপ পোস্ট করে? এ দেশের মেজরিটির কি আদৌ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে? এখানে কি কেউ ঘাসবিচুলি চিবিয়ে পেট ভরায়, কেউ ছর্‌রা খেয়ে চোখ খোয়ায়, কেউ দলিত বলে আত্মহত্যা করে, কেউ মুসলিম বলে নিখোঁজ হয়ে যায়, না সকলেই ‘অ্যায় মেরা মহান দেশ, কবে হব ক্যাশলেস’ কেত্তন জপে? সারা দিন একশো টাকার সন্ধানে ঠা-ঠা রোদে ঘুরতে ঘুরতে কেউ সহসা মুখ গুঁজড়ে পড়ে গেলে লোকে কী বলে চেঁচাবে, ব্ল্যাক মানি না অভিমানী? এগুলো একটু ভেবেচিন্তে তার পর নাম কিনতে গেলে ভাল হত। অবশ্য অনেকের ভাবনা-রশ্মি ছাপ্পান্ন ইঞ্চির বেশি যায় না!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy