Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

কে বলল, ভারী শিল্প ছাড়া গতি নেই

সম্পদ ও সমস্যা, দুটোতেই পশ্চিমবঙ্গ অন্যদের থেকে আলাদা, তাই তার উন্নয়নের ভাবনাও আলাদা হতেই হবে| সহজাত সুবিধেগুলোকে কাজে লাগিয়ে অগ্রগতি সম্ভব। খুবই সম্ভব।ধরা যাক একটি ছাত্র অঙ্কে দুর্বল, কিন্তু সাহিত্য বা ইতিহাসে পারদর্শী। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার দুটি অভিমুখ সম্ভব: সে অঙ্কে কাঁচা হয়ে কী সর্বনাশ হয়ে গেল এই নিয়ে অনন্ত হাহুতাশ, অথবা যে বিষয়গুলিতে সে ভাল সেগুলিতে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা।

ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৫৫
Share: Save:

ধরা যাক একটি ছাত্র অঙ্কে দুর্বল, কিন্তু সাহিত্য বা ইতিহাসে পারদর্শী। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার দুটি অভিমুখ সম্ভব: সে অঙ্কে কাঁচা হয়ে কী সর্বনাশ হয়ে গেল এই নিয়ে অনন্ত হাহুতাশ, অথবা যে বিষয়গুলিতে সে ভাল সেগুলিতে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা।

পশ্চিমবঙ্গের শিল্পভাবনা এমনই এক জাঁতাকলে আটকে| এক দিকে শাসক দলের জমি নীতি ভারী শিল্পের কফিনে শেষ পেরেক, এটা বুঝেও শিল্পপতিদের কাছে কর্মচারী রূপে নতজানু হয়ে বিনিয়োগ ভিক্ষার সম্মেলন| অন্য দিকে সিঙ্গুর নামক শিল্পশ্মশানে বিরোধী রাজনীতির সলতে পাকানো| দুটোর মধ্যেই ভোটমুখী রাজনীতি যতটা, রাজ্যের উন্নতির সম্ভাবনা তার ছিটেফোঁটাও নেই| আসলে, এক দীর্ঘ বন্ধ্যা সময় পেরিয়ে এসে কোন পথটা বাছা দরকার, সেটা ভাবতে গেলে রাজ্যটাকে, তার ভাল-মন্দটাকে একটু বুঝতে হবে|

দেশের তিন শতাংশ জমিতে আট শতাংশ মানুষ এ রাজ্যে, দেশের গড় জনঘনত্বের তুলনায় তিন গুণ বেশি। দেশভাগের ফলে এত মানুষের চাপ আর কোনও রাজ্যকে তো নিতে হয়নি| তার ওপর এ রাজ্যের অধিবাসীদের গড় বয়স দেশের অনুপাতে কম, বিহারের পরেই দ্বিতীয়| প্রতি বছর প্রায় পনেরো লক্ষ ছেলেমেয়ে স্কুলের পর্ব চুকিয়ে কাজের বাজারে আসছে, কাজ তৈরি হচ্ছে ছিটেফোঁটা, ফলে কর্মহীন তারুণ্যের এক বারুদের স্তূপের ওপর বসে আমরা| উত্তরপ্রদেশে যখন ১১৪ জন ঝাড়ুদারের সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপনে ১৭০০০ এমবিএ বা ইঞ্জিনিয়ারের আবেদন পড়ে, সমস্যার স্বরূপটা বোঝা যায়|

একে জনঘনত্বের চাপ, তার ওপর এই বাংলা প্রকৃতিক কারণে সুজলা সুফলা| বাঁকুড়া বা পুরুলিয়ার কিছু এলাকা ছাড়া প্রায় সব জমিই চাষযোগ্য, বহুফসলি| শিল্পের জন্য জমি তাই একটা জটিল বিষয় সামাজিক সমস্যা, আবেগ সবকিছু তাতে জড়িয়ে| জমির জোগান ছাড়া ভারী শিল্প হবে না, আর যেখানে ৯৬% চাষজমি ক্ষুদ্র মালিকানাধীন, সেখানে সরকারের সাহায্য ছাড়া জমি কেনা অসম্ভব| তাই অন্য রাজ্যের তুলনায় জমির জোগানের ক্ষেত্রে এ রাজ্যের দুর্বলতা আছে— ব্যাপারটা ওই অঙ্কে দুর্বল ছাত্রছাত্রীর মতো| অঙ্ক বা (শিল্পের জন্য) জমি, দুটোই যে সর্বরোগহরা বটিকা নয়, এই বাস্তবকে মেনে নেওয়াই হল সামনে তাকানোর প্রথম ধাপ|

সিঙ্গুর নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, তা এখন ইতিহাস, ভাবমূর্তির যে ক্ষতিটা হয়েছে তার জের চলবে| কিন্তু, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই দু’চারটি এ-রকম শিল্প গড়ে উঠল, হারানো ভাবমূর্তি খানিক ফিরল, তার পর? ‘ভ্যাট’ আদায় হয়তো বাড়বে, কিন্তু কাজ সৃষ্টি? আজকের ভারী শিল্প এত বেশি প্রযুক্তিনির্ভর, তাতে কাজ তৈরি হয় খুব কম| জিন্দলদের শালবনীর সিমেন্ট কারখানায় প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ মিলিয়ে কর্মসংস্থান হবে সাকুল্যে হাজার| অর্থাৎ, এক বছরে যে পনেরো লক্ষ ছেলেমেয়ে কাজমুখী হচ্ছে, তার সংস্থান করতে গেলেই দেড় হাজার ওই রকম ফ্যাক্টরি লাগবে| এ রাজ্যে কি সেটা বাস্তব ? ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নিয়ে হইচই, কিন্ত তারও দৌড় সীমিত— ভারী শিল্পের বৃদ্ধি ছাড়া তার বাজার হয় না| তাই সব মিলিয়ে ধরে নেওয়া ভাল, ভারী শিল্পের সম্ভাবনা পুরোপুরি বাজারের ওপর ছাড়তে হবে, ভৌগোলিক অবস্থান যদি কোনও শিল্পের পক্ষে অনুকূল হয়, তবে তা এই রাজ্যে গড়ে উঠবে নিজের চাহিদায়, তাতে যেটুকু হবার হবে, স্থানীয় রাজনীতি তাতে বাগড়া না দিলেই হল|

কিন্তু তাতেই কি সব সম্ভাবনার শেষ? সম্প্রতি অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারী শিল্পের বিকাশ ছাড়া আর্থিক বৃদ্ধির উদাহরণ নেই| ইতিহাস দেখলে কথাটা হয়তো সত্যি, স্বাধীনতার পর নেহরুর অর্থনীতি এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলি এই চিন্তা থেকেই চালিত| কিন্তু বিশ্বের আর্থিক চলন, বাণিজ্য, কাজ সৃষ্টির ধরন যে দ্রুততার সঙ্গে বদলাচ্ছে, তা নতুন করে ভাবায়| পশ্চিমবঙ্গের সম্পদ মোটামুটি কী? উর্বর জমি, অনুকূল প্রাকৃতিক বৈচিত্র, তরুণ কর্মক্ষম ছেলেমেয়ে, আশপাশের দশটি রাজ্য ও তিনটি দেশ নিয়ে এক বিরাট বাজারের অনুকূল অবস্থান| আজকের ভারতের অর্থনীতিতে কৃষি আর পরিষেবা মিলিয়ে মোট জিডিপি-র ৮৪ শতাংশ| তাই শিল্প নিয়ে বিলাপ ছেড়ে, কৃষি আর পরিষেবার ওপর নজর দিয়ে আর্থিক বিকাশ আর কর্মসংস্থানের একটা মডেল গড়ে তোলা কি অসম্ভব?

প্রথমে ধরি কৃষির কথা| যে রাজ্যে ৫৫% পরিবার কৃষিনির্ভর, তার আর্থিক উন্নতি কৃষিকে বাদ দিয়ে? কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের কেন্দ্র হল পূর্ব ভারত, তার মুখ্য চরিত্র অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ | সম্প্রতি কলকাতায় এসে নীতি আয়োগের শীর্ষকর্তা বলেছেন, দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার বজায় রাখতে কৃষিকে ৪% হারে বাড়ানো কেন্দ্রের লক্ষ্য, কারণ ভারী শিল্পে ভরসা কম| সব মিলিয়ে কৃষিকে একটা নতুন ধাপে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত, পরিকল্পনা করে এগোলে এ রাজ্যে কৃষিতে বৃদ্ধির হার ৪% ছাপিয়ে যেতেই পারে| তার জন্য চাষিকে সব রকম ফলনের উপযুক্ত দাম পেতে হবে, শুধু ধান নয়, আর তার জন্য কৃষি বিপণন দফতরের নির্ণায়ক ভূমিকা চাই | আজকে মঞ্জুষা বা তন্তুজ যদি ফ্লিপ্কার্ট বা স্ন্যাপডিল-এর হাত ধরতে পারে, তা হলে কৃষিপণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও সরকার থেকে বা পিপিপি মডেলে এই রকম উদ্যোগ সম্ভব| বাজারের নির্দিষ্ট চাহিদা মেটাতে কৃষি বিপণন দফতরের তদারকিতে চুক্তি-চাষও সম্ভব| কৃষিপণ্যের আয়ু বাড়াতে পরিকাঠামোতে আরও সরকারি বিনিয়োগ চাই: হিমঘর, কোল্ড চেন, প্রক্রিয়াকরণ| চাষি ফসলের দাম পেলে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বাজার এমনিই বাড়বে, কৃষিঋণও তাল মেলাবে। দরকার হলে খানিক ভর্তুকি দিয়েও কৃষির ‘ভ্যালু চেন’ ঠিকঠাক বজায় রাখা দরকার, কারণ পাঁচ কোটি মানুষ জড়িয়ে তার সঙ্গে| সব মিলিয়ে আজকের দিনে চাষির কাছে ঠিক খবর পৌঁছে দিয়ে আর পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে চোখে পড়ার মতো উন্নতি সম্ভব, এবং তার সঙ্গে সম্ভব প্রচুর কাজের সুযোগ সৃষ্টিও| আজ রাজ্যে চিংড়ির চাষ বছরে আট হাজার কোটি টাকা, ফুলচাষও তাই, দুটো মিলিয়ে কাজ করেন চার লক্ষের বেশি মানুষ, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার থেকেও অনেক বেশি, কিন্তু চলছে অলক্ষ্যে| ভারী শিল্প এল কি গেল তা নিয়ে যা আলোচনা, চিংড়ি বা ফুলের কপালে তার খানিকটা থাকলে জৈব সম্পদে ব্যবসা অনেক বাড়ত|

এ বার আসি পরিষেবায়| বহুচর্চিত তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়াও কিন্তু স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর পর্যটন, এই তিনটি ক্ষেত্রে সরকার যদি ঝাঁপাতে পারে, তা হলে একটা বড় বাজার ধরা যায়, তার সঙ্গে অনেক কাজের সুযোগ| স্বাস্থ্য আর শিক্ষা, দুটি ক্ষেত্রেই আজ ভরসা তলানিতে, ফলে বাঙালি রোগী আর ছাত্রছাত্রীর হাত ধরে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজ্য থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা আটকানো, আর তার সঙ্গে পুরো ‘লুক ইস্ট’ বাজার ধরতে পারাও আকাশকুসুম নয়| একশো একরের মতো জমিতে যদি একটা আধুনিক ‘স্বাস্থ্যনগরী’ গড়ে ওঠে, অন্তত কুড়ি হাজার কাজ তৈরি হয়| আর পর্যটন? সদ্য গিয়েছিলাম বিষ্ণুপুর, এক দিকে উড়ছে ‘বিউটিফুল বেঙ্গল’ পতাকা, অন্য দিকে শিল্পকীর্তির কিছু অনন্য নিদর্শন বুকে নিয়ে পূতিগন্ধময় এক হতশ্রী শহর, পুরসভার কোনও অস্তিত্ব চোখে পড়ে না| এ ভাবে পর্যটন হয় না, শাহরুখ খান বললেও না। পর্যটন গড়ে তুলতে একটা সার্বিক পরিকল্পনা চাই, বিনিয়োগের পরিমাণের চেয়েও যেটা বেশি জরুরি| দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান কিন্তু পর্যটনে|

নীতি আয়োগের কর্ণধার বলেছেন আর একটি সমস্যার কথা: শ্রম আইন| শ্রমের সুরক্ষা চাই, কিন্তু তাতে উদ্যোগ আটকে গিয়ে যদি কাজটাই তৈরি না হয়? বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলছে, জন বিস্ফোরণের অভিঘাত সামলাতে ওখানে শ্রম আইন একটু শিথিল, কিন্তু হাজার হাজার মানুষ, বিশেষত মেয়েরা কাজ তো করছেন চা বাগানে, বস্ত্রশিল্পে| মজুরি একটু কম, কিন্তু তা সত্ত্বেও সামাজিক উন্নয়নের অনেকগুলি সূচকে বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেলে দিয়েছে| সাধারণ চায়ের ব্যবসায় বাংলাদেশ আর শ্রীলংকার সঙ্গে দামের প্রতিযোগিতায় ভারত পারছে না, উত্তরবঙ্গের বাগানগুলোতে লালবাতি জ্বলার দশা, শুধু ডানকানকে শাপশাপান্ত করলেই সমস্যা মিটবে?

সম্পদ আর সমস্যা, দুটোতেই এ রাজ্যটা অন্যদের থেকে আলাদা, তাই তার উন্নয়নের ভাবনাও আলাদা হতেই হবে| সহজাত সুবিধেগুলোকে কাজে লাগিয়ে আর্থিক বৃদ্ধি আর কর্মসংস্থান, দুই ক্ষেত্রেই অগ্রগতি সম্ভব— জমি আর শিল্প নিয়ে অনন্ত বিলাপ থামিয়ে| যেটুকু সম্পদ রাজ্যের আছে, তা বিনিয়োগ বা ভর্তুকি হয়ে আপাতত আসুক শুধু শ্রমনিবিড় প্রকল্পে, বাকিটা ছাড়া যাক বাজারের হাতে| প্রতি কোটি টাকায় কয়টি কাজ তৈরি হবে, সেটাই আপাতত হোক বিনিয়োগের মাপকাঠি। না হলে হাজার হাজার কোটির এই গল্প অর্থহীন, যেখানে কর্মহীন তারুণ্যের বিস্ফোরণের অপেক্ষায় দিন গুনছি আমরা|

ইন-থিঙ্ক গ্রুপের অধিকর্তা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE