নিউ ইয়র্কে ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে পুলিশ।
সময়টা বড় অদ্ভুত। ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজন, সঙ্কীর্ণতার চর্চায় ডুবেই বার বার মানবতার উপর বীভৎস আঘাত হানে সন্ত্রাস, চ্যালেঞ্জ ছোড়ে রাষ্ট্রকে। আর সেই সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে গিয়ে রাষ্ট্রও ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজন আর সঙ্কীর্ণতার পথটাই বেছে নেয় আজ। সন্ত্রাসেও রং খুঁজতে চান আজকের রাষ্ট্রনায়ক।
ফের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে নিউ ইয়র্কে। মর্মান্তিক মৃত্যুমিছিলের সাক্ষী হতে হয়েছে ম্যানহাটানকে। মানবতার বিরুদ্ধে হওয়া যে কোনও হামলা যতটা নিন্দনীয়, এই হামলাও ততটাই। সঙ্কীর্ণতার সাধকদের হাতে ন্যক্কারজনক এই হত্যালীলার নিন্দার জন্য কোনও ভাষাই যথেষ্ট নয়। কিন্তু এই ধরনের জঘন্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যখন বিশ্বজোড়া সংহতির প্রয়োজন, তখন নিজের আমেরিকাকেও সংহত রাখতে পারলেন না প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্টের আচরণগত অসামঞ্জস্য নিয়ে প্রশ্ন তুলল মার্কিন জনসংখ্যারই একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।
আরও পড়ুন: হামলাকারীর পরিচয় জেনেই কি এতটা বদলে গেল ট্রাম্পের সুর?
মানবতার বিরুদ্ধে হওয়া যে কোনও হামলাই অসহনীয়— প্রেসিডেন্টের বার্তাটা এই রকমই হওয়া উচিত। নিউ ইয়র্কে অক্টোবরের শেষ তারিখে যে হামলা হল, তার প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই রকম কঠোর এক বার্তাই দিয়েছেন। কিন্তু সাধারণের স্মৃতি এতটাও দুর্বল নয় যে, অক্টোবর শুরুতেই লাস ভেগাসে ঘটে যাওয়া আরও বড় হামলার প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া ঠিক কী রকম ছিল, তা এর মধ্যেই ভুলে যাবেন সকলে। লাস ভেগাসে বন্দুকবাজের হামলায় হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। নিউ ইয়র্ক হামলার তীব্রতা তার চেয়ে অনেক কম। কিন্তু লাস ভেগাসের জন্য প্রেসিডেন্টের ঝুলি থেকে শুধুমাত্র ‘সমবেদনা’ আর ‘সহানুভূতি’ বেরিয়েছিল। নিউ ইয়র্কের জন্য বেরিয়ে এল প্রবল উদ্বেগ, বেরিয়ে এল সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে প্রবল হুঁশিয়ারি, বেরিয়ে এল নিরাপত্তা ও নজরদারি আরও নিশ্ছিদ্র করার নির্দেশ, বেরিয়ে এল বিন্দুমাত্র সমঝোতা না করার বার্তা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই পাশাপাশি রেখেছেন ট্রাম্পের দুই প্রতিক্রিয়াকে। দুই ঘটনায় দু’রকমের প্রতিক্রিয়ার কারণ কী— কাটাছেঁড়া করার চেষ্টা হয়েছে। তাতেই একটা অপ্রিয় সত্য উঁকি দিয়েছে। প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া দু’রকম, কারণ— লাস ভেগাসের হামলাকারী ছিল শ্বেতাঙ্গ মার্কিন নাগরিক, ছিল ধর্মবিশ্বাসে খ্রিস্টান, নিউ ইয়র্কের হামলাকারী ধর্মবিশ্বাসে মুসলিম, শিকড়ও আমেরিকার সুগভীরে নয়। অনেকের বিশ্লেষণই আজ এই রকম।
এ কথা ঠিক যে, লাস ভেগাসের হামলা ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর আভিধানিক দৃষ্টান্তের সঙ্গে মেলে না। আজকের পৃথিবীতে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে যাদের আমরা চিনি, লাস ভেগাসের হামলাকারী আভিধানিক অর্থে তাদের কেউ নয়। কিন্তু নিউ ইয়র্কের হামলা যে ভাবে মানবতাকে রক্তাক্ত করল, লাস ভেগাসের হামলা কি তার চেয়ে কোনও অংশ কম রক্তাপ্লুত ছিল? ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজন আর সঙ্কীর্ণতার যে পথে হেঁটে মানুষ খুন করে আইএস বা আল কায়দা বা তালিবান, বিচ্ছিন্ন কোনও বন্দুকবাজের বর্বর হামলাও সেই একই পরমাণ ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজন আর সঙ্কীর্ণতা থেকেই জন্ম নেয়। সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র এই সরল সত্যটা উপলব্ধি করতে পারে না, এমনটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেই আতঙ্কটা আরও চেপে বসছে। যখন শিকড় থেকে উপড়ে ফেলা প্রয়োজন সঙ্কটটাকে, তখন সঙ্কটটার আসল কারণ অনুসন্ধানই সবচেয়ে জরুরি। কারণটা জেনেও যদি চোখ ঠেরে থাকা রাষ্ট্র, প্রচ্ছন্ন ভাবে যদি এখনও বিভাজন রেখা টানা হয় ‘ভাল সন্ত্রাস’ আর ‘খারাপ সন্ত্রাস’-এর মাঝে, তা হলে সঙ্কটটা গভীরতরই হবে দিন দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy