Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সুপাত্র চাই? দর বেশি পড়বেই

ট্যালটেলে চায়ে চুমুক দিয়ে কথাটা পাড়লেন আগন্তুক, ‘‘এ পরীক্ষা কিন্তু নামেই। টাকা ছাড়া কিস্যু হবে না। তা অন্তত লাখ চারেক ধরে রাখুন।’’

গৌরব বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০৬:১০
Share: Save:

শীতের সকাল। বাড়ির কর্তা দাওয়ায় বসে। কর্ত্রীর উঠোন নিকোনো প্রায় শেষ। বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল মোটরবাইকটি। দেখে কর্ত্রী তড়িঘড়ি উনুনে জল বসালেন। ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তোলা হল বছর কুড়ির ছেলেটিকে। সেনা বিভাগের পরীক্ষায় সদ্য সে মাঠ পাশ করেছে। সামনে ইন্টারভিউ। নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসারে ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে সেটা উতরে গেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে গোটা পরিবার।

ট্যালটেলে চায়ে চুমুক দিয়ে কথাটা পাড়লেন আগন্তুক, ‘‘এ পরীক্ষা কিন্তু নামেই। টাকা ছাড়া কিস্যু হবে না। তা অন্তত লাখ চারেক ধরে রাখুন।’’ কাশির দমকে চা খাওয়া মাথায় উঠল কর্তার। কোনও রকমে শুধু বললেন, ‘‘চার লাখ! জমি-বাড়ি বেচেও তো সে টাকা হবে না।’’ গুম মেরে গিয়েছেন কর্ত্রী। ছেলের পিঠ দেওয়ালে। আগন্তুক হাসছেন, ‘‘আপনারা রাজি হলে টাকার ব্যবস্থা কিন্তু হয়ে যাবে।’’ ‘‘কী করে?’’, সমস্বরে ছিটকে আসে প্রশ্নটা।

রয়েসয়ে খোসা ছাড়ান আগন্তুক, ‘‘অমুক গ্রামের তমুকবাবুর একমাত্র কন্যা। গায়ের রং একটু চাপা। তবে সম্পন্ন পরিবার। বিয়েতে লাখ পাঁচেক টাকা, আসবাবপত্র, সোনাদানা সবই দেবে।’’ শুনেই বাড়ির কর্তা আচমকাই হয়ে ওঠেন পাত্রের বাবা। গলাটা একটু ভারী করে তিনি বলেন, ‘‘টাকার অঙ্কটা কি আর একটু বাড়ানো যায় না?’’ হাসেন বাড়ির কর্ত্রীও, ‘‘তা বাপু, তুমি যে দালালির সঙ্গে ঘটকালিও করছ, তা তো জানতাম না।’’ আগন্তুক শুধু মুচকি হাসেন। ‘ডিল’ পাকা হলে এক গোধূলিবেলায় পাত্রের বাবা সপরিবার হাজির হন পাত্রীর বাড়িতে। সেখানে রফা হলে তার পরে বিয়ে।

সব সময় যে ঘটক কিংবা দালালদের উদ্যোগী হতে হয়, এমনও নয়। গাঁ-গঞ্জে বহু মেয়ের বাবাও বসে থাকেন ‘ইনভেস্ট’ করার জন্য। তবে হ্যাঁ, সরকারি চাকরি হতে হবে। নিদেনপক্ষে মাসান্তে মোটা রোজগার। ‘উপরি’ থাকলে দারুণ। ফলে এক এক পেশার পাত্রের বাজারদরও এক এক রকম। পাত্র শিক্ষক হলে জানতে চাওয়া হয় টিউশনির বাজার কেমন। চিকিৎসক হলে ‘প্র্যাকটিস’ করেন কি না। উকিল হলে শুধুই মাছি তাড়ান না কি শাঁসালো ক্রিমিনাল কেস-টেসও পান। আর পুলিশ হলে তো আর কিছু যাচাই করার প্রয়োজনই নেই!

কোন পাত্র কেমন পণ নেন তার কোনও খতিয়ান সরকারি দফতরে মেলে না। সে ক্ষেত্রে ভরসা স্থানীয় লোকজন, পাত্রপাত্রীর পরিবার ও বিয়ে বাজারের ফড়েরা। ‘পণ’ শব্দটিতে এক ফড়ের আবার ঘোর আপত্তি— ‘‘পণ আবার কী মশাই! এ তো প্রাপ্য। বিয়ে কি আর এমনি এমনি হয়? মেয়ে জন্মানোর পর থেকেই তার বাবাও সেই কথা মাথায় রেখেই টাকাপয়সার জোগাড় করতে শুরু করেন। এটাই তো হয়ে আসছে!’’

আগে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারে নগদ কয়েক হাজার টাকা, একটা সাইকেল, হাতঘড়ি, রেডিয়ো, সোনার গয়না, আসবাবপত্র— বিয়ে দেওয়ার সময় এই সবই ভাবা হত। আর এখন? প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক গড়ে পাঁচ থেকে সাত লক্ষ, হাই স্কুলে পড়ালে সাত থেকে দশ লক্ষ, বিএসএফ কিংবা সেনা বিভাগে চাকরি করলে তিন থেকে পাঁচ লক্ষ, পুলিশ ছয় থেকে আট লক্ষ, সিভিককে ভলান্টিয়ার বলে যতই পুলিশের থেকে আলাদা করা হোক বিয়ের বাজারে তারও দর তিন থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা (সোনার গয়না, আসবাব, দু’চাকা কিংবা চার চাকার গাড়ি কিন্তু আলাদা)। দেশের অর্থনীতির হাল নিয়ে অনেক উদ্বেগ। শেয়ার বাজারেরও উত্থানপতন আছে। কিন্তু বিয়ের বাজারদর তেজি থাকে বারো মাস। এখানে সূচক কখনও পড়ে না।

সকলেই যে নগদ পণ নেন তা নয়। নগদ তেমন জুতসই হচ্ছে না? বেশ, তা হলে রাস্তার পাশের দু’কাঠা জমি। কখনও হাতজোড় করে পাত্রীপক্ষ বলছে, ‘‘পাঁচ লাখ কোনও ভাবেই পারব না। চার লাখই সম্বল।’’ ভেবেচিন্তে পাত্রপক্ষ করুণাময় হয়ে ওঠে। চার লক্ষেই রাজি হয়। কিন্তু সঙ্গে থাকে ছোট্ট একটি আবদার, ‘‘বেশ, আপনাদের কথাই থাকল। শুধু বিয়ের খরচটা দিয়ে দেবেন।’’ সে খরচ কত? নিশ্চিত ভাবে লক্ষাধিক টাকা। কিন্তু তখন আর হাত কামড়ে লাভ নেই। পাকা কথা হয়ে গিয়েছে যে!

এই মাঘেই বিয়ে করছেন নদিয়ার এক যুবক। বায়ুসেনা বিভাগের কর্মী। নগদ পাঁচ লক্ষ টাকা। গয়না ও আসবাবপত্র তো আছেই। লাখ দেড়েক টাকার মোটরবাইক আগেই দিতে হয়েছে। সেই বাহনে চেপেই বিয়ের কার্ড বিলি করছেন পাত্রের পিতৃদেব। নিজের জমানো সব টাকা তুলে, জমি বেচে, আত্মীয় পরিজনদের কাছে সাহায্য ও ঋণ নিয়েও মেয়ের মা গর্বের সঙ্গে বলছেন, ‘‘মেয়েটার কপাল বড় ভাল। না হলে এমন পাত্র কি আর আমাদের ভাগ্যে জোটে গো! মেয়েটা ভাল থাকুক।’’ রবীন্দ্রনাথের দেনাপাওনা গল্পে নিরুপমার বাবাও তা-ই ভেবেছিলেন।

পাত্রের বাজারদরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পণের বলিও। বছর দুয়েক আগে লোকসভায় কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী মেনকা গাঁধী জানিয়েছিলেন, ২০১২-১৪, এই তিন বছরে দেশে ২৪,৭৭১ মহিলার মৃত্যু হয়েছে পণ প্রথার কারণে। ২০১৩ সালে পণের কারণে ৮০৮৩ মহিলা মারা গিয়েছেন। ২০১৪ সালে ৮৪৫৫। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র তথ্য অনুসারে, ২০১৩-২০১৫ পর্যন্ত সারা দেশে পণের জন্য অত্যাচারের মামলা রুজু হয়েছে ৩ লক্ষ ৪৮ হাজার। এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে (৬১,২৫৯টি মামলা)। তার পরে রাজস্থান (৪৪,৩১১) ও অন্ধ্রপ্রদেশ (৩৪,৮৩৫)।

শুকনো পরিসংখ্যানের পরোয়া পাত্রপাত্রীর পরিবার আর কবে করেছে! বরং কখনও কেউ বিনা পণে বিয়ে করতে চাইলে পালটা শুনতে হয়, ‘‘কিছুই নেবে না? তা হলে ছেলের নির্ঘাত কোনও সমস্যা আছে।’’ মুর্শিদাবাদে ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ের এক স্কুল শিক্ষক বলছেন, ‘‘পণ না নেওয়ার পণ করে বিয়েটাই তো হয়ে উঠছে না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

social disease Dowry System
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE