এক শত বৎসরেরও বেশি সময় ধরিয়া ‘ভারতমাতা’ এই দেশটিকে বিপদে আপদে বাঁচাইয়া আসিতেছেন। যখনই দেশকে একসূত্রে বাঁধিবার প্রয়োজন পড়িয়াছে, ভারতমাতার স্মরণ ও শরণ লওয়া হইয়াছে। আবারও শোনা গেল সেই আবাহন। ত্রিপুরায় সেখানকার জনজাতীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় করাইবার জন্য ভারতমাতাকে লইয়া আসিল সে রাজ্যের ভারতীয় জনতা পার্টি। উদ্দেশ্যটি পরিষ্কার। দেশের মূল ভূখণ্ডের সহিত উত্তর-পূর্বের রাজ্যটির সংযোগসাধন জরুরি। এই রাজ্য যে মহান ভারতেরই একটি অংশ, তাহা রাজ্যবাসীকে মনে করাইয়া দেওয়া জরুরি। রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সুনীল দেওধর তাই ভারতমাতাকে ত্রিপুরী জনজাতীয় পোশাকে সাজাইয়া ত্রিপুরাবাসীর কাছে তাঁহাকে ঘরের মানুষ হিসাবে উপস্থাপিত করিতে ব্যস্ত। ভারতমাতাকে লইয়া টানাপড়েন বহু কালের। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি রমণীর সাজে তাঁহাকে সাজাইয়া বঙ্গমাতাকে ভারতমাতা হিসাবে যখন চিত্রিত করিয়াছিলেন, তখনই বোঝা গিয়াছিল, অংশের সহিত সমগ্রের সম্পর্কটি অতীব জটিল, অঞ্চলের সহিত দেশকে জুড়িতে জোড়াতালি ছাড়া গতি নাই। দুশ্চিন্তা ইহাই যে, আজ আবার ভারতমাতার প্রয়োজন পড়িল কেন? বঙ্কিমচন্দ্র-অবনীন্দ্রনাথরা তো বাহিরের ক্ষমতার সহিত যুঝিতেছিলেন। দেওধররা কিসের সঙ্গে যুঝিতেছেন?
আসল কথাটি এইখানেই। মূল সমস্যা ‘ভারতমাতা’র মধ্যেই। কোনও একক অবয়বের মধ্যে দেশের আত্মাকে বাঁধিতে চাহিবার অতি-আগ্রহের কারণটিই হইল— ভারত নামটি শুনিতে মহান হইতে পারে, কিন্তু ভারত বলিতে আদতে কী বোঝায়, তাহা বিশাল সংখ্যক ভারতবাসীর কাছেই স্পষ্ট নয়। সুদূর প্রান্তে যে প্রদেশগুলি, বা ঘোর কেন্দ্রেও যে জনজাতি-অধ্যুষিত দারিদ্র-নিষিক্ত অঞ্চলগুলি, সেখানকার বাসিন্দাদের কাছে তো নয়ই। এত বড় দেশে এক-একটি অঞ্চলের ভৌগোলিক ঐতিহাসিক সামাজিক সাংস্কৃতিক বাস্তব এতখানি আলাদা যে নিজের বাস্তবের সহিত অন্য বাস্তবগুলিকে জোর করিয়া মিলাইতে হইবে কেন, সেই লক্ষ্যটিই এই ‘নাগরিক’দের নিকট ঝাপসা। শতবর্ষ আগেও ‘ভারত’ এই ‘আত্মিক’ অশান্তিতে ভুগিয়াছে, এখনও ভুগিতেছে। তাই ভারতমাতা আজও জনজাতীয় পোশাকে অবতীর্ণ।
বেচারা দেওধর বাহিনী যেহেতু আবার সেই এক দেশ এক জাতি এক ভাব ইত্যাদি কাসুন্দি ফিরাইবার প্রচেষ্টায় মাতিয়াছেন, তাঁহাদের সামনে নূতন করিয়া আবার পুরাতন চ্যালেঞ্জসমূহ ভাসিয়া উঠিতেছে। বিপিনচন্দ্র পালকে যে স্বদেশি যুগে বলিতে হইতেছিল, এই দেশের ইতিহাস আসলে ভারতমাতৃকার ইতিহাস, মাতৃপ্রতিম দেশ কাহাকে বলে সে কেবল ভারতবাসীরাই জানে— তখন নিশ্চয় তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেন নাই যে তখনই তাঁহাদের অলক্ষ্যে দেশমাতার ডাক ছাপাইয়া দেশ আপনিই শতধা হইতে সহস্রধা হইবার জোগাড় করিতেছে! এক ও একক বাঁধনে দেশকে বাঁধিতে গিয়া তাঁহারা সফল হন নাই। ‘ইতিহাস ইতিহাস’ বলিয়া গলা ফাটাইলেও দেওধররা ইতিহাস হইতে শিক্ষা লইতে জানেন না। তাই সত্যকারের আঞ্চলিক সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতির দিকে না তাকাইয়া তাঁহারা দিবাস্বপ্ন দেখিতেছেন, নিছক আঞ্চলিক পোশাক পরাইলেই মাতৃবন্দনায় শিকা ছিঁড়িবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy