প্রতীকী ছবি।
ভাষাকে এখন পণ্যবিশ্বের কাছে সঁপে দেওয়া হয়েছে। পণ্যের উদ্দেশ্য বিক্রি হওয়া, পণ্য ভয়ানক গতিশীল এবং পণ্যবিশ্ব নিজের প্রয়োজনে প্রবাহ মাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। ভাষা হচ্ছে পণ্যবিশ্বের এক নিতান্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ। বাজার নিয়ন্ত্রণে পুরো দেশটা যখন, তখন সেই বাজার ধরে রাখার মাধ্যম যে ভাষা, সে ভাষাই প্রাধান্য লাভ করবে। আদমসুমারি হিসাবে এ দেশে বাংলাভাষীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা হিসাবে কমে যাচ্ছে।
সারা বিশ্বে যে ভাষাটি দাপটে বিরাজ করছে ও অন্য অনেক ভাষাকে কোণঠাসা করে এগিয়ে চলেছে, সেটি ইংরেজি। রাষ্ট্রপুঞ্জ অনেক ভাষাকে স্বীকৃতি দিলেও তার কাজকর্মের মূল ভাষা ইংরেজি। ইংরেজি হল আন্তর্জাতিক লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা, যোগাযোগের ভাষা। ফলে ইংরেজির প্রতি ঝোঁক সারা বিশ্বে সর্বত্র বেড়েছে। সম্ভবত ভাষা হিসাবে ইংরেজির কিছু টেকিনিক্যাল সুবিধাও আছে। মাত্র ছাব্বিশটি বর্ণের বাহন আর অন্য দিকে বাক্যের বৈচিত্র্য ও শব্দের বিকল্পের প্রাচুর্য তাকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নমনীয়তা দিয়েছে। ব্যাপক প্রচলনের কারণে ভাষাগত সংস্কার বা রক্ষণশীলতা তার নেই। এই ঔদার্যের সুযোগে বিভিন্ন স্থানীয় ভাষার উপর ভর করে এ ভাষার প্রভাব বলয় বেড়েই চলেছে। ইংরেজি বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের ভাষা। অতএব, ইংরেজির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সে কারণে মাতৃভাষাকে দুয়োরানি করাও ঠিক নয়। ভাষা তো কেবল কথা বলা বা মৌখিক সংযোগের বাহন নয়, নয় কেবল নাটক-গল্প রচনার মাধ্যম। কিংবা নয় এফ এম রেডিও বা টিভিতে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান উপস্থাপনের বাহন। চিন্তামূলক, দার্শনিক, মননশীল লেখা, বিজ্ঞান ও নানা তত্ত্ব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ-সহ নানান আনুষ্ঠানিক বা ইনফর্মাল (যা মুখের ভাষায় প্রকাশ পায়) রূপের পাশাপাশি প্রমিত বা ফর্মাল (লিখিত ব্যাকরণসিদ্ধ রূপ) রূপেরও প্রকাশ ঘটে ভাষার মাধ্যমে। প্রমিত ভাষাও কোনও অজ্ঞ অনড় স্থায়ী বিষয় নয়। আমরা দুশো বছরের বাংলা গদ্যের নমুনা পাঠ করলেই দেখব কী ভাবে বাংলা ভাষা জড়তা কাটিয়ে বেগবান হয়ে উঠেছে, তৎসম শব্দ ভেঙে সহজ আটপৌরে হয়ে উঠেছে। ভাষা এ ভাবে বদলাচ্ছেই, নিজের নিয়মে সৃজনশীল মননশীল ব্যবহারকারীদের চিন্তাশীল সযত্ন প্রয়াসের মাধ্যমে। এ পরিবর্তন প্রায় অধিকাংশ ব্যবহারকারীর অজ্ঞাতে মসৃণ ভাবেই ঘটে থাকে। ভাষার ক্ষেত্রে জবরদস্তি চলে না।
মূল ভাবনার বিষয় হল, আমার বাহনটি আমাদের সব রকমের ভাবনা-চিন্তাকে বহন করার ক্ষমতাসম্পন্ন জীবন্ত ভাষা থাকছে কিনা।
এখন যেটি মূল দুশ্চিন্তার বিষয়, তা হল বাংলা ভাষা কতটা সচল, কতটা গতিশীল ও জীবন্ত আজ? এ ভাষা কি একটি বর্ধিষ্ণু না কি ক্ষয়িষ্ণু ভাষা? পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি ও হিন্দির আগ্রাসনে এর দুরবস্থা। ফলে মাতৃভাষাকে ক্ষয়িষ্ণু হতে দিয়ে কেবল আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের গৌরবে বাহবা দিতে গেলে কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে মাসব্যাপী উন্মাদনা সৃষ্টি করলে কাজের কাজ কিছু হবে কি?
মাতৃভাষা ভাল ভাবে শিখে, তার চর্চা অব্যাহত রেখেও যে ইংরেজি ভালই শেখা যায়, সে বিশ্বাস অর্জন করব কী ভাবে? সেটি কি বিদ্যাসাগর থেকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ থেকে হুমায়ুন কবির জীবন ও কর্ম থেকে আমরা বুঝতে পারব না? বাংলা ভাষার ক্ষয় বন্ধ করতে হলে ভাষার মর্যাদা তো আমাদের অন্তরের মধ্যে তৈরি করতে হবে, ভাষার প্রতি ভালবাসা হতে হবে খাঁটি। বছরব্যাপী সন্তানের ইংরেজি জ্ঞানের বহর পরখ করে কাটিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলার জন্য ভাবাবেগ ছড়ালে হবে না। শুনেছি কোনও কোনও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে মাতৃভাষা বাংলায় কথা বললে পড়ুয়াদের জরিমানা গুণতে হয়। আইন করে এই ধৃষ্টতা বন্ধ করে ভাষা বিকাশের কাজটি শুরু করা উচিত।
বাংলাভাষা চড়াই উতরাই পাড়ি দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। বাংলাভাষার সামনে যে পাহাড়প্রমাণ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর করা যে খুব কঠিন, তা এ প্রযুক্তি উৎকর্ষের যুগে মনে করার কোনও কারণ নেই। বাংলা ভাষা একটি জীবন্ত ভাষা। কোনও স্বাভাবিক ভাষা বেঁচে থাকার প্রথম ও প্রধান শর্ত হল তার শব্দ ভাণ্ডারের ক্রমিক বিস্তার। চলমান জীবনের নানা ক্ষেত্র থেকে নতুন শব্দ ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে ক্রমাগত জড়ো হতে থাকে। তা হলে সে ভাষা জীবন্ত, যা প্রাণস্পন্দে স্পন্দিত। এ শব্দ আসে নানা পথে, নানা ভাবে, নানা কারণে, নানা উদ্দেশ্যে। ভাষা ব্যবহারকারীরা তাদের জীবনযাপনের নতুন নতুন প্রয়োজন মেটাতে তৈরি করে কিংবা ধার করে নতুন শব্দ। কখনও বা পুরনো শব্দগুলোকে নতুন অর্থে ও নতুন আঙ্গিকে ব্যবহার করে। এ সবই হচ্ছে ভাষার বেঁচে থাকার, অগ্রগতির, বিস্তার ও উন্নতির লক্ষণ। বাংলা ভাষারও সে অর্থে শব্দভাণ্ডার স্ফীত হচ্ছে। নতুন নতুন শব্দ আসছে বাংলা ভাষায়। আবার, অব্যবহারে জীর্ণশীর্ণ ক্লান্ত হয়ে অনেক শব্দ বিলুপ্ত বা মৃত হয়ে যাচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি তথা কম্পিউটার ও সেলফোনে বাংলাভাষার ব্যবহারকে সম্প্রসারিত করা গেলে ভাষাচর্চার আরও ব্যাপক বিকাশ ঘটতে পারে।বাংলাভাষাকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বিশ্লেষণ, গবেষণা ও ব্যবহারে প্রযুক্তির সহায়তা ক্রমশ কার্যকর হচ্ছে। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান আর চিকিৎসা-প্রকৌশল শাস্ত্রের বইতে বাংলা অক্ষরেই শক্ত ল্যাটিনজাত শব্দ ব্যবহার করতে হবে। সে জন্য পরিভাষার পেছনে ছোটার প্রয়োজন কমে যাবে। এসব ক্ষেত্রে যত বিদেশি শব্দ আসবে ততই মঙ্গল। কারণ এসব বিষয় আন্তর্জাতিক যোগসূত্রে গাঁথা। ভাষাতাত্ত্বিক বিষয় বিশ্লেষণ, বানান সমস্যা, বাক্যগঠন প্রক্রিয়া, যথাযথ শব্দপ্রয়োগ বিষয়ে কম্পিউটার প্রযুক্তি সহায়ক হয়ে উঠেছে। ভাষা চর্চার প্রচলিত ঘেরাটোপ থেকে বাংলা ভাষাকে বের করে এনে এর শরীরে নয়া প্রাণসঞ্চার সম্ভব। কারণ, বাংলা ভাষা দুর্বল কোনও ভাষা নয়। এর শক্তিমত্তা যথেষ্ট। দু’শো বছর আগে বাংলাভাষার ব্যাকরণ রচয়িতা ও বহু ভাষাবিদ উইলিয়াম কেরি অভিমত জানিয়েছিলেন বাংলা ভাষা সম্পর্কে, ‘‘এই ভাষা প্রায় গ্রেট ব্রিটেনের তুল্য এক বৃহৎ ভূভাগে প্রচলিত এবং যথোচিত অনুশীলন হইলে স্বতঃসিদ্ধ সৌন্দর্য ও সুস্পষ্টরূপে ভাব-ব্যঞ্জবায় ইহা জগতের কোনও ভাষা অপেক্ষা নিকৃষ্ট হইবে না।’’ স্বীকার করতেই হবে অমর কথার বাহনস্বরূপ যে সকল শ্রেষ্ঠ ভাষা জগতে বিদ্যমান বাংলা ভাষা তার অন্যতম। নিজ বাসভূমেই বাংলা ভাষা যেন পরবাসী না হয়, এটা নিশ্চিত করা বেশি জরুরি।
শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy