Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Corporate Heroes

NRI: কর্পোরেট জগতে অনাবাসী ভারতীয়দের সাফল্য কি প্রশ্নাতীত?

যখন দেখা যায়, ‘পেপসিকো’-র ইন্দ্রা নূয়ির মতো নারী প্রতিষ্ঠা পেতে দু’শিফটে কাজ করেছেন, তখন পরিস্থিতি অনুমান করাই যায়।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২১ ১১:৩৬
Share: Save:

কোনও সফল ব্যক্তিকে শুধু সাফল্যের কারণে কেউ দোষারোপ করতে পারেন না। কিন্তু যখনই কোনও ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রযুক্তিবিদ বিদেশে কোনও সুবিশাল প্রতিষ্ঠানের পরিচালনভার হাতে পান, তখনই তাঁকে বিনা বিচারে মাথায় তুলে নাচার ব্যাপারেও ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। বিবেচনার অবকাশ রয়েছে, তিনি কোন ধরনের সংস্থার ভারপ্রাপ্ত হয়েছেন, সে বিষয়ে অথবা সেই সংস্থাটি কী ধরণের পণ্য বা পরিষেবা উৎপাদন করে, সেই বিষয়েও। সেই সঙ্গে এটিও বিচার্য যে, এ ধরনের ‘সাফল্য’ কি আদৌ ‘জাতীয় গৌরব’-এর মতো ব্যাপার?

কিন্তু যাঁরা প্রকৃতই কৃতবিদ্য, তাঁদের কৃতিত্বের স্বীকৃতি প্রদান সর্বাগ্রে প্রয়োজন। যাঁরা ভারত থেকে বেরিয়ে কোনও নতুন দেশে গিয়ে নতুন সাংস্কৃতিক পরিসরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে নিজ কৃতিত্বে দামি ডিগ্রি লাভ করেছেন এবং খুব দ্রুত ছন্দে কর্পোরেট জগতের সিঁড়ি বেয়ে চল্লিশের কোঠা পেরনোর আগেই সংস্থার উচ্চতম শিখরে অবস্থান করছেন বা আরও কম বয়সে সেই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন (টুইটার-এর পরাগ আগরওয়ালের উদাহরণ মনে রাখতে হবে), তাঁদের কৃতিত্বকে স্বীকার করতেই হয়।

ওই কৃতিত্বের পিছনে তাঁদের জিনগত বৈশিষ্ট্য বা বংশপরিচয়, ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবদান, প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষা, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বা কঠোর শ্রম করতে পারার সংস্কৃতি ইত্যাদি বিবিধ বিষয় থাকতে পারে। কিন্তু মানতেই হবে যে, এই সব মানুষ তাঁদের যাত্রাপথে বর্ণভেদ বা সংস্কৃতিগত বাধাগুলিকে অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছেন। স্বীকার করতেই হবে যে, আমেরিকান সমাজ এক মেধাতান্ত্রিক সমাজ, আর সিলিকন উপত্যকা তার মধ্যে অগ্রগণ্য। সুতরাং যখন দেখা যায় ‘পেপসিকো’-র ইন্দ্রা নূয়ির মতো নারী প্রতিষ্ঠা পেতে দু’শিফটে কাজ করেছেন, তখন পরিস্থিতি অনুমান করাই যায়।

প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা যে এই পদ্ধতিতেই আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তাতে নতুন করে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু গণমাধ্যম প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিস্ময় প্রকাশ করে এবং করেই চলে।

এই সব ক্ষেত্রে প্রেক্ষিত অবশ্যই সহায় হয়। যদি ভিন্‌দেশে কোনও ভারতীয়ের সাফল্যকে তাঁর মাতৃভূমির প্রতি আনুগত্য থেকে বিচ্যুতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়, তা হলে মনে রাখতে হবে যে, তিন জন আফ্রিকান এই মুহূর্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু), বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের শীর্ষে বসে আছেন। এমন পদে কিন্তু কোনও ভারতীয় এই মুহূর্তে নেই। আমেরিকার কর্পোরেট জগতে চৈনিকরা সম্ভবত বেশ লক্ষণীয় উপস্থিতির প্রমাণ রেখেছেন। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ‘স্টেম’ (সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যাথমেটিকস-এর আদ্যক্ষরগুলি নিয়ে গঠিত শব্দ) নিয়ে পাঠরত চিনা শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু এঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ দেশে ফিরে যেতে চান। এঁদেরই কেউ কেউ চিনের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরের অন্তরালে আমেরিকান ফেসবুক, অ্যামাজন ইত্যাদির চিনা সংস্করণ তৈরি করেছেন। কিন্তু কোনও ভারতীয়কে এমন কাজ করতে দেখা যায়নি।

কারা এই সব সংস্থা চালাচ্ছেন, তাঁরা ভারতীয়, নাকি অন্য কোনও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় বহন করছেন, বৃহত্তর পরিসরের তাতে আদৌ কি কিছু যায়-আসে?

কারা এই সব সংস্থা চালাচ্ছেন, তাঁরা ভারতীয়, নাকি অন্য কোনও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় বহন করছেন, বৃহত্তর পরিসরের তাতে আদৌ কি কিছু যায়-আসে?

এই সব সঙ্গত কারণেই যোগ্য অনাবাসী সফল ভারতীয়ের প্রতি দু’একটি প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবে উঠে আসে যে, কেন তাঁদের সংস্থাগুলি নিরন্তর বিতর্কের মধ্যে থাকে। কেন তাঁদের একচেটিয়া কারবারের প্রবণতার কারণে, কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য, অন্যের সম্পদ স্বচ্ছন্দে ব্যবহারের অনাবিল অভ্যাসের দরুণ এবং রাজনৈতিক ভাবে গোলমেলে সব বিষয়ে এক অদ্ভুত গোপনীয় অথচ স্পর্শকাতর খেলার জন্য কোটি কোটি ডলার জরিমানা হয়? এই সব কারণে তাঁদের সংস্থাগুলিকে মুক্ত সমাজব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক হিসেবেও দেখা হয়। প্রশ্ন ওঠে যখন এই সব সংস্থা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক খাদ্য সরবরাহ করে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে যখন তারা ২০০৮ সালের মতো অর্থনৈতিক সঙ্কটকে ঘনিয়ে তোলে।

কারা এই সব সংস্থা চালাচ্ছেন, তাঁরা ভারতীয়, নাকি অন্য কোনও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় বহন করছেন, বৃহত্তর পরিসরের তাতে আদৌ কি কিছু যায়-আসে?

শ্রীমতী নূয়ি ‘পেপসি’-র পণ্যসামগ্রীর তালিকায় পরিবর্তন এনেছেন। সে জন্য তিনি অবশ্যই ধন্যবাদার্হ। তবে এর পিছনের কারণটি বোধ হয়, তিনি সেই প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের অধিকারিণী, যার দ্বারা অস্বাস্থ্যকর খাবার আর গণস্বাস্থ্যের সম্পর্ক সংক্রান্ত সম্ভাব্য প্রশ্নগুলিকে অনুমান করতে পেরেছিলেন।

ক্ষমতার অপেক্ষাকৃত মৃদু রূপটি বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত হচ্ছে। এর মধ্যে কেবল কর্পোরেট-কর্তার অবতারটিই পড়ছে বিপুল সব প্রশ্নের মুখে। 

ক্ষমতার অপেক্ষাকৃত মৃদু রূপটি বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত হচ্ছে। এর মধ্যে কেবল কর্পোরেট-কর্তার অবতারটিই পড়ছে বিপুল সব প্রশ্নের মুখে। 

প্রসঙ্গত একটি মুখরোচক গল্পে আসি (‘ফরেন পলিসি’ পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কাহিনিটি)। ‘পেপসি’-র খ্যাতনামা সিইও ডন কেন্ডাল সাবেক সোভিয়েত বাজারকে কব্জা করতে নাকি ১৭টি সোভিয়েত ডুবোজাহাজ এবং বেশ কিছু জাহাজ আশির দশকে কিনেছিলেন। এই সব জলযান কিন্তু যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে বলে কেনা হয়নি। বরং এগুলিকে জাহাজের কবরখানায় ফেলে রাখার জন্যই খরিদ করা হয়েছিল (যদিও ১৯৭৩-এ চিলে-তে সিআইএ-পরিকল্পিত এক সামরিক অভ্যুত্থানের পিছনে প্ররোচনা দানের বিষয়ে কেন্ডালের সক্রিয়তার কথা জানা যায়)। কিন্তু হাস্যকর বিষয়টি শেষমেশ এমন দাঁড়ায় যে, ‘পেপসি’-র হাতে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম নৌবহর এর ফলে চলে আসে! এর পরেও ব্যবসায় কপট পন্থার বিষয়ে আর কি কোনও কথা উঠতে পারে?

মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। যদি আমরা প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী ভারতীয়দের নিয়ে উল্লাসে মাতি, তবে এই উল্লাসের অন্য দিকে কিছু প্রশ্ন তুলতেই হয় সমতা বিধানের জন্য। এবং আমরা প্রশ্নগুলি উত্থাপনের সময়ে যেন জননীতি ও শিক্ষা জগতের মতো অপেক্ষাকৃত কম বিরোধাভাসপূর্ণ ক্ষেত্রগুলির দিকেও খানিক আলোকপাত করি। শুধুমাত্র নোবেল প্রাপকদের সংখ্যাবৃদ্ধি নয়, আমাদের মনে রাখতে হবে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের মধ্যে নীলি বেন্দাপুড়ির মতো ব্যক্তি রয়েছেন। যিনি এক অগ্রগণ্য আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই সপ্তাহেই মনোনীত হয়েছেন। মনে রাখতে হবে গীতা গোপীনাথকেও, যিনি আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছেন। এবং মনে রাখতে হবে ঋষি সুনাকের কথাও, যাঁকে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবা হচ্ছে।

টেবিলের এক প্রান্তে প্রার্থী রূপে বা কোনও বিষয়ে আলোচনার জন্য উপস্থিত হওয়া ব্যক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার বিপরীতে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা অন্য কোনও দেশের প্রতিনিধি হিসেবে অন্য প্রান্তটিতে বসতে শুরু করেছেন অথবা একা হাতেই বল করে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে পর্যুদস্ত করছেন। ক্ষমতার অপেক্ষাকৃত মৃদু রূপটি বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত হচ্ছে। এর মধ্যে কেবল কর্পোরেট-কর্তার অবতারটিই পড়ছে বিপুল সব প্রশ্নের মুখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE