Advertisement
১৯ মে ২০২৪
ব্যক্তিবিশেষের জোরে নয়, সভ্যতা অগ্রসর হয় সমূহের প্রচেষ্টায়
Society

সর্বশক্তিমানের বিপদ

বাসনাটি স্পষ্টত লোকদ্রোহী। রাজতন্ত্রকে পরাভূত করে মানুষ এতখানি অগ্রসর হয়েছে, তা যতই খণ্ডিত বা অপূর্ণ হোক না কেন।

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২৪ ০৮:২৬
Share: Save:

ও দিদি, মোদীকে বলো না, আমাদের একটু ভাল করে খেতে দিতে। রোজ আলু-সয়াবিন দিয়ে খাওয়া যায়?” ছাত্রী-গবেষক দিদিটি যে মোদী কেন, কাউকেই কিছু বলতে পারে না, সে কথা স্কুলের বাচ্চারা কী করে জানবে? তারা দেখেছে, এক জন দিদি স্কুলে এসেছে, মিড-ডে মিল নিয়ে নানা কথা জিজ্ঞাসা করছে। মাস্টারমশাইদের সঙ্গেও কথা বলছে। তার মানে এই দিদি কিছু করতে পারে, এই তাদের বিশ্বাস। আর যদি মোদীকে বলা যায়, তা হলে পাতে আলু-সয়াবিনের জায়গায় আধখানা ডিম পড়তে পারে, একটু তরকারি জুটতে পারে। তারা জেনেছে— কেউ যদি কিছু করতে পারে সে হল মোদী। কেননা, ইস্কুলে পাড়ায় খেলার মাঠে বাড়ির উঠোনে সর্বত্র তারা শুনছে ‘মোদী কি গ্যারান্টি’। শুনতে শুনতেই তারা শিখে গিয়েছে, মোদী সর্বশক্তিমান— বাকি কারও কিচ্ছু করবার নেই, কেবল মোদীকে জানানো ছাড়া।

প্রশ্ন করতেই পারেন, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া গ্যারান্টির মধ্যে ভুল কী আছে? প্রধানমন্ত্রী যদি কোনও সমস্যার সমাধান করে দেন, সেটা তো জনহিতেরই ব্যাপার? স্পষ্ট করে বলার যে, সমস্যা সমাধানের এই প্রক্রিয়াটাই যে আসল সমস্যা, সেটাই আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেশের সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। তিনি যত ভাল ভাবে সেই নেতৃত্ব দেবেন, সমস্যার সমাধান এবং তার প্রক্রিয়া দুটোই ততখানি জনহিতকর হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, তাঁর নেতৃত্বে সরকারি দফতর এমন ভাবে চলবে যাতে বাচ্চাদের সাধারণ-মান্য ভাল খাবারের জন্য আকুতি করতে না হয়— যে কোনও সভ্য ব্যবস্থাতে বাচ্চারা সেই খাবারটুকু না-চাইতেই পায়।

কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী, এবং যাঁরা তাঁকে শুধু ঈশ্বরের প্রতিভূ বলে মনে করেন না, তাঁর উপরে ঈশ্বরত্ব আরোপ করতে বদ্ধপরিকর, তাঁরা তো এই প্রক্রিয়াটিতেই বিশ্বাস করেন না। প্রচারসামগ্রীর বিপুল রসদ জোগাড় করে— কিছু কিনে, কিছু জোর করে আদায় করে— যে বিশ্বাসটা দেশবাসীর মধ্যে প্রোথিত করে দেওয়া হচ্ছে, তা হল: প্রধানমন্ত্রী সর্বশক্তিমান। সভ্যতার পক্ষে এর চেয়ে বিপজ্জনক কোনও ধারণা নেই। দেশবাসী বহু শ্রমে, বহু যন্ত্রণা সয়ে, বহু আত্মীয়ের বিয়োগবেদনা সহ্য করে যে জানগণিকতার ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল, সেটাকেই চূর্ণ করার সঙ্কল্প হল ‘মোদী কি গ্যারান্টি’।

কেউ বলবেন, এ কী সৃষ্টিছাড়া কথা! প্রধানমন্ত্রী তো দেশবাসীর ভোটে নির্বাচিত, সুতরাং তিনি যা করবেন, তা তো জনগণের ইচ্ছা বলেই গণ্য হবে। একটু মাথা খাটালেই অবশ্য তাঁরা বুঝতেন, যে ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, সেই ব্যবস্থায় আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন করি না— আমরা নির্বাচিত করি সাংসদদের, যাঁদের আবার নির্বাচিত করার কথা প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু, মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি, এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা ঘোষিত এবং স্ব-ঘোষিত হয়ে যায়, সাংসদরা হয়ে যান পারিষদমাত্র। নির্বাচনের আগেই সেই স্ব-ঘোষিত প্রধানমন্ত্রী ডজন ডজন অহঙ্কৃত ঘোষণা করে যান: কাদের জেলে ভরবেন, কাদের টাকা নিয়ে কাদের দেবেন, কার জন্য বাড়ি বানিয়ে দেবেন, কাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ বা গ্যাসের সংযোগ দেবেন ইত্যাদি। জনহিতের মোড়কে এর চেয়ে বড় অহিত আর কী হতে পারে?

যদি ধরেও নেওয়া হয়, তাঁর এখনকার ঘোষণাগুলো পূর্বেকার মতো অসত্য-নির্মিত নয়, জুমলা বা কথার কথা নয়, এবং প্রকৃতই তিনি জনহিতের ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করবেন, তা হলেও কি এগুলোকে জনহিত বলে মেনে নেওয়া যায়? জনহিত মানে, সভ্যতার ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, শুধু ব্যক্তিমানুষের কিছু কল্যাণ নয়। জনহিত হচ্ছে দেশবাসীর, সমগ্র মনুষ্যসমাজের অগ্রগতি— জানগণিকতার জয়গান। মানুষ এটাকেই গণতন্ত্র বলে জেনে এসেছে, এবং এ কারণেই তার কাছে গণতন্ত্র এত প্রিয়, এবং ঠিক এ কারণেই যাবতীয় প্রচার, ঘোষণা, ঈশ্বরত্ব আরোপের পরেও দেশবাসীর বড় একটি অংশ এখনও একক ব্যক্তির মহিমায় নয়, আস্থা রাখার চেষ্টা করে চলেছে সামূহিক লোকপ্রজ্ঞার উপরে। বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন, মুক্তচিন্তাকে কারারুদ্ধ করা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু ও বশংবদ করে তোলা ইত্যাদির পরেও দেশবাসীর মধ্যে জানগণিকতার আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট। এই আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বংস না করে দেশকে সহস্র-বর্ষ পূর্বের রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদগ্র বাসনা চরিতার্থ হওয়ার নয়। তাই নতুন মোড়কে তাকে জনসমক্ষে হাজির করা— সেটা এক প্রকার নব্য-রাজতন্ত্র, একক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা। সেটা করতে একক ব্যক্তির সর্বশক্তিমানতা এখন প্রধান হাতিয়ার।

বাসনাটি স্পষ্টত লোকদ্রোহী। রাজতন্ত্রকে পরাভূত করে মানুষ এতখানি অগ্রসর হয়েছে, তা যতই খণ্ডিত বা অপূর্ণ হোক না কেন। সেই প্রত্যাখ্যাত, পশ্চাৎমুখী রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের চেষ্টা লোকদ্রোহ ছাড়া আর কী? ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ থেকে ‘মোদী কি গ্যারান্টি’ পর্যন্ত অসত্যের বিপুল সমাহার বস্তুত এক ঘোর দুর্দিনের আবাহন। দুর্দিন কেবল বিরোধী রাজনৈতিক দল বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নয়, আরবান নকশাল বা তথাকথিত দেশদ্রোহী কলমজীবীদের নয়, এই দুর্দিন ভারত ও তার ইতিহাসের। যে মানুষটি আজ ‘মুসলিম তোষণ’-এর অভিযোগে নিজের বিচারবুদ্ধিকে বিভ্রান্ত হতে দিচ্ছেন, যে মানুষটি আজ ‘গর্বিত হিন্দু’ বলে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন, যে মানুষটি আজ দেশপ্রেমের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে প্রতিবেশী দেশ ও তার অধিবাসীদের সর্বনাশ কামনা করছেন, মোদী নামের আড়ালে রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা তাঁদের দরজাতেও মূর্তিমান দুর্দিন হয়ে কড়া নাড়বে।

সাম্প্রতিক স্মরণিকাগুলির দিকে তাকালেই এ কথাগুলো প্রত্যয়ের রূপে হাজির হতে বাধ্য। বিমুদ্রাকরণ থেকে নিয়ে কোভিড মোকাবিলার নামে— ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ-পরিচিতি নির্বিশেষে— যে ভয়ানক অহিত মানুষের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হল, সেগুলো মানুষকে পদে পদে বশ্য করে তোলা ছাড়া আর কী বা বলা যায়? “আমি সর্বশক্তিমান, আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি”, এই অত্যাচারী রূপটি মানুষের মনে প্রতিষ্ঠিত করে তুলে “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু”-র মতিভ্রম চাপিয়ে দেওয়া হল। যে অত্যাচার সইয়ে নিতে পারে, সে এক দিন ‘অচ্ছে দিন’ও নিয়ে আসতে পারে!

স্বীকার করতেই হবে, আমাদের গণতন্ত্রের অপূর্ণতা ও দুর্বলতার রন্ধ্রপথ দিয়েই এই নব্য রাজতন্ত্রের গ্যারান্টির ঘোষণা। আমাদের গণতন্ত্র নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে যত গুরুত্ব দিয়েছে, জানগণিকতা, অর্থাৎ, জনগণের সক্ষমতা নির্মাণে সেই গুরুত্ব দেয়নি। যে সামূহিক সক্ষমতা অর্জন গণতন্ত্রের মূলকথা, সেই অর্জনে সমস্ত ব্যক্তির সক্ষমতা অর্জনের সমান সুযোগ হচ্ছে প্রাথমিক শর্ত। সেই শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে। সক্ষমতার প্রথম ধাপ শিক্ষা, কোটি কোটি মানুষ তা থেকে বঞ্চিত। একই কথা স্বাস্থ্য বিষয়ে, কর্মসংস্থান বিষয়ে, নারী-পুরুষের সুযোগসাম্যের বিষয়ে। মোদীর গ্যারান্টিতে সেই বঞ্চনা ক্রমবর্ধমান। যে সব সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষ গণতন্ত্রের সজাগ প্রহরী হয়ে দাঁড়ায়, সেই সক্ষমতাগুলোর অভাবকেই হাতিয়ার করে নির্মিত হল মোদী-রাজতন্ত্রের পূর্বকল্প।

কেবল শিক্ষার কথাই ধরা যাক। যে শিশু আজ শিখে নিচ্ছে মোদীর গ্যারান্টির কথা, তার তো অনেক কিছু শেখার ছিল— কী করে পড়তে হয়, কী করে লিখতে হয়, মনের কথা শব্দে ও লিপিতে ব্যক্ত করতে হয়, গণনার নিয়মগুলো আয়ত্ত করতে হয়। আর এ সবই তাদের শেখার কথা সামূহিক ভাবে— অনেকে মিলে। স্কুলব্যবস্থার একটা অন্যতম উদ্দেশ্যই হচ্ছে অনেকে মিলে শেখা, এবং সেই শেখার ভিতর দিয়ে অনেকে মিলে অনেক কিছু করা। আধুনিক মানুষের জীবনে স্কুলই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রবেশিকা। স্কুলশিক্ষার পরিসর ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাচ্চাদের যে মহত্তম অনুধাবন ঘটার কথা, তা হল, ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ ধারণাটাই মানব সভ্যতার শত্রু। মানুষ আজ যেখানে পৌঁছেছে, তা সমূহের শক্তিতে, কোনও একক মহাশক্তিধরের ক্ষমতা, দুরাকাঙ্ক্ষা বা তাণ্ডবের কারণে নয়। শিক্ষার এই মৌলিক প্রাসঙ্গিকতা অপহৃত হয়েছে, যার দণ্ড দিতে হচ্ছে গোটা দেশকে।

এখনও আকাশ অংশতই মেঘাচ্ছন্ন। এখনও আকাশ অংশত মেঘমুক্ত। এখনও জানগণিকতার শিক্ষাকে সম্বল করে আমরা, এ দেশের সাধারণ নাগরিকরা, ভারতকে রক্ষা করে মানবসভ্যতায় আলোকসংযোগ করে যেতে পারি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE