Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
উত্তর মিলবে না, তবু এই সব নাছোড় প্রশ্ন
Violence

মাথা হেঁট হয়ে গেল

বিদেশ থেকে দেশের মুখটা কেমন দেখাচ্ছে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা চলে জোরদার, বুঝতে পারি, যে জন্য বিবিসি বা হিন্ডেনবার্গ প্রশ্ন ওঠালেই কড়া আক্রমণে ধেয়ে যেতে হয়।

An image of Question marks

—প্রতীকী চিত্র।

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৩০
Share: Save:

কয়েক দিন ধরেই মাথায় একটা চিঠি মকশো করছি। ওঁর বা ওঁদের সঙ্গে তো কথা বলার উপায় নেই, বড় বড় নেতা, জবরদস্ত সাংবাদিকরাই কথা বলে উঠতে পারেন না, জনগণমন তো কোন ছার। এ সব ভাবতে গিয়েই চিঠির কথা মাথায় এল আর কী।

এর মধ্যে শুনলাম ভাষণ। মণিপুরে যা ঘটছে, সেটাও প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুর দোষ, জানলাম। ভারতের ‘যাবতীয় সমস্যার জননী’ কংগ্রেস, বুঝলাম। ‘যাবতীয় সমস্যা’ হিসাবে দুর্নীতি, মুসলমান তোষণ, দেশভাগ, জরুরি অবস্থা, হিংসা, সন্ত্রাসবাদ, বৈষম্য, সব পাশাপাশি বসে যেতে দেখলাম। আর দেখতে পেলাম কেমন করে ‘দেশ’-এর কথা বলতে একেবারে নিচুতম মানের কটুভাষণ বোঝানো হয় এখনকার সময়ে। কত তিক্ততা, কত আক্রমণ ও অসম্মানের রমরমা। শুনলে মনে হয়, কেন শুনে ফেললাম। পড়তে গেলে লজ্জা করে, মনে হয়, থাক, অন্য খবরে আশ্রয় নিই।

ছিয়াত্তর বছর আগে আমাদের বিশাল বহুভাষী বহুধর্মী বহুসমাজী দেশ জন্ম নিয়েছিল বিস্তর স্বপ্ন আর প্রতিশ্রুতি নিয়ে। একাত্তর বছর আগে বিশ্বপৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে এই দেশ অর্বুদ-কোটি অক্ষরজ্ঞানরহিত নিরন্ন-অর্ধভুক্ত গাঁগঞ্জবাসী কৃষক-শ্রমিক-পরিযায়ী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সর্বজনীন ভোটাধিকারে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের কঠিন পরীক্ষায় পাশ করেছিল। আজ সেই দেশের উচ্চতম কক্ষটিতে যে স্তরে যে স্বরে মহাভাষণ শুনতে হল, তাতে মাথা হেঁট হয়ে গেল।

মাথা হেঁট করে বসে চিত্তবিভ্রম হচ্ছিল। মনে পড়ছিল, আমেরিকা দেশে দাবানলের অনুষঙ্গে একটা বিখ্যাত ইংরেজি বইয়ের (এবং তার অনুসারী একটি মিনি-সিরিজ়ের) নাম লিটল ফায়ার্স এভরিহোয়্যার। এখন যা দেখছি আমরা, তা তো আসলে ‘বিগ অ্যান্ড লিটল ফায়ার্স এভরিহোয়্যার’, সর্বত্র, চার দিকে। ভাবছিলাম, সেই চিঠিটা যদি লিখতাম, কোন আগুনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলতাম। বোধ হয় বলতাম, মণিপুরের ঘটনা আমাদের শিহরিত করে দিয়েছে নেতৃবর। কিসের দায়, কার দোষ, এ সমস্ত কিছু জানার আগে আমরা চাই— এমন ঘটনায় আমাদের সেই ত্রস্ত শিহরন আপনাদের কাছে পৌঁছক, আপনারা এমন কিছু বলুন, এবং করুন, যাতে এমন আর না ঘটে, কেউ এমন ঘটানোর কথা কল্পনাতেও না আনতে পারে, ঘটালে রাষ্ট্র ছুটে গিয়ে মানুষকে বাঁচাতে পারছে এটা যেন দেখা যায়। হ্যাঁ, এই ‘দেখা যাওয়া’টা খুব জরুরি। একটা সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছুটে গিয়ে অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়াবে, এবং অত্যাচারীকে শাস্তি দেবে— সকলকে তা দেখতে পেতে হবে। একমাত্র তখন আবার আমরা স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারব, এখনও অবধি যে শ্বাসটা আমাদের বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে আটকে আছে। নেহরু কী কী করেছেন, তা শোনার জন্য তো অনন্ত ভবিষ্যৎ পড়ে আছে, দেশের জাতীয় সংসদ সেই ‘তুই পাজি না মুই পাজি’ হোয়াটঅ্যাবাউটারির মঞ্চে কবেই পরিণত হয়েছে। আগে কাজটুকু হোক। খুব কি বেশি চাওয়া সেটা?

আরও বলতাম, এই যে হরিয়ানায় যা ঘটছে, তা কি ‘অমৃত উৎসব’-এর সঙ্গে বেশ মানানসই? সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, সবাইকে বাঁচানো সম্ভব না— সবাই বলতে কারা বাদ গেল তবে, কাদের বাড়িঘর মসজিদে আগুন লাগালেও ‘বাঁচানো সম্ভব’ ভেবে সরকার ছুটে এল না— হরিয়ানায় বা দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীতে— সে সব দেখেও কি বলব ‘অমৃতং গময়’? সামনে ২০২৪-এর ভোট, ‘ওদের’ আরও বেশি করে বাদ দেওয়াই কি তবে ভোটের লক্ষ্য? এই কি সেই ভাগ্যবিধাতার স্বপ্নের ভারতবর্ষ— যেখানে এক দিকে কিছু মানুষ বেছে নিয়ে তাদের উপর বুলডোজ়ার চলে, চলন্ত ট্রেনে গুলি ছোটে সেই সম্প্রদায়ের মানুষের দিকে, গুলি চালানোর সময় উত্তেজনাবিহ্বল আততায়ীর মুখে থাকে আপনাদেরই নামে জয়ধ্বনি, আর অন্য দিকে চলে স্বাধীনতার দাপুটে কুচকাওয়াজ, গৌরবের কর্ণবিদারী নির্ঘোষ? এগুলো কিন্তু কোনও দুঃস্বপ্নের বা ভয়ের সিনেমার ছবি নয়, বাস্তব ঘটনা, প্রকাশিত তথ্য, নিখাদ সংবাদ। এমন বাস্তব অবশ্য আগেও দেখেছি আমরা, অন্য শতকে, অন্য মহাদেশে। ভাবিনি, আমাদের বিস্তীর্ণ দেশের অসংখ্য মানুষের মধ্যে এত তাড়াতাড়ি তা নেমে আসবে, আর আমরা নিঃশব্দে নীরবে বসে বসে দেখব।

সবার অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা ঢোকার কথাটা তখন মুখ ফস্কে বেরিয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পারি। কিন্তু এই যে একের পর এক বৃহদাকার মহাপরাক্রান্ত তস্করদের কথা শুনি, যাদের ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, বিদেশে গেলে যাদের ফেরানো যায় না, দেশে থাকলে যারা মহানায়কের মহিমায় ভূষিত হয়— এর পরেও আমাদের দিয়ে এদেরই প্রেমাতুর রাষ্ট্রব্যবস্থার জয়গান গাওয়ানোটা বড্ড জবরদস্তি নয় কি? অথচ সে দিন কালো টাকা ধরার জন্যই নাকি রাতারাতি নেমে এসেছিল ঐতিহাসিক সংস্কারের মহাকোপ। কই, জমাট আঁধারে ভারতভূমি ছেয়ে গেল, ব্যাঙ্ক থেকে মন্ত্রক, কে‌‌‌উ তো জানাল না নোটবন্দিতে তবে কোন ফন্দি ছিল? মাঝখান থেকে যারা এতটুকুও প্রশ্ন তুলল— দেশের লোক হলে তারা হয়ে গেল অ্যান্টিন্যাশনাল বা আর্বান নকশাল, আর বিদেশের মানুষ হলে তারা ভারতবিরোধী সাম্রাজ্যবাদী, বিদেশি ষড়যন্ত্রের মূর্তিমান চক্রী।

বিদেশ থেকে দেশের মুখটা কেমন দেখাচ্ছে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা চলে জোরদার, বুঝতে পারি, যে জন্য বিবিসি বা হিন্ডেনবার্গ প্রশ্ন ওঠালেই কড়া আক্রমণে ধেয়ে যেতে হয়। সে যা-ই হোক, জিজ্ঞেস করতাম— কেন আজকাল ভারত নিয়ে এত প্রশ্ন, এত দুশ্চিন্তা? ওই যে শতসহস্র অপকর্মের পান্ডা নেহরু, তাঁর সময়ে তো বিদেশে ভারতের মুখখানা খুব জ্বলজ্বলে ছিল, এত প্রশ্নও উঠত না তাঁকে নিয়ে! পড়েছি আমরা, এখনও ইতিহাসে পড়া যেতে পারে নির্জোট আন্দোলন যুগের কথা— অবশ্য যদি সেই অংশগুলো ইতিমধ্যে বাদ না পড়ে থাকে! এখন কেন বার বার শুনতে হয়, ভারতীয় রাষ্ট্র ‘অসহিষ্ণু’? জুনের আমেরিকা সফরে গণতন্ত্রের গৌরব আওড়ে তার উত্তর যদিও সপাট এল, এবং ভরা সভায় শ্রোতারা শুনলেন, ‘আইডেন্টিটি’র ভিত্তিতে ভারতে কোনও রকম বৈষম্য হয়ই না মোটে— কিন্তু সেটা তো ‘অমৃত-ভারত’-এর দস্তুর নয়, আপনারাই নিজমুখেই বলেন। আপনাদেরই অনেকে দৃষ্টান্তযোগ্য ‘সততা’র সঙ্গে স্পষ্টাস্পষ্টি বলেন, ‘ওদের’ দেশছাড়া করা, নয়তো দেশেই ‘ওদের’ আচ্ছা রকম শায়েস্তা করে রাখাটাই হল লক্ষ্য?

লক্ষ্য বলেই তো মাস দেড়েক আগে শোনা গেল সেই মহাপ্রতীক্ষিত সংস্কারের রব। জানলাম আমরা, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হবে খুব তাড়াতাড়ি। তাই তো। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল আর অযোধ্যার রামমন্দিরের পরেই তিন নম্বর প্রতিশ্রুতিই ছিল এটা। সংবিধানের ডিরেকটিভ প্রিন্সিপলস-এও তো কত দিন আগে ঢুকে গিয়েছে এই সংস্কারের দিকে এগোনোর কথা। তারও আগে সংবিধান তৈরির সময় এ নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছে। আম্বেডকর এবং নেহরুর মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশের দশকে ‘হিন্দু কোড বিল’ পাশ হলেও সর্বজনীন বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি না আনাই সাব্যস্ত হয়েছে, মুসলমান সমাজের ‘পার্সোনাল ল’ অটুট থেকেছে। তার পর থেকে এই বিধি নিয়ে অন্যরা বেশি শোরগোল করতে চায়নি, কিন্তু হিন্দু রক্ষণশীল রাজনীতি সমানে বলেছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হতেই হবে, হবেই। গত নয় বছরেও সে বক্তব্য বার বার শোনা গিয়েছে। কিন্তু এই জুন থেকে আবার নতুন উদ্যম দেখা গেল— সেটা তো আশু একটা বড় লক্ষ্যের কথা ভেবেই, নয় কি? মুসলমানদের শিক্ষা দেওয়া দরকার, এবং হিন্দু ভারতের দেখা দরকার কে সেই শিক্ষা দিচ্ছে, এটাই তো সেই না-বলা বাণী? লক্ষ্যটা যদিও সর্বজনজ্ঞাত— তবু চেপেচুপে স্তোক দিয়ে বলতে হয়!

তাই তো বললেন, একটা পরিবারে আলাদা নিয়ম না চললে রাষ্ট্রে কেন চলবে! বললেন যদিও, জানেন তো ঠিকই, একে তো আজকাল পরিবারের মধ্যেও সদস্যদের ‘নিজেদের মতো’ করে চলতে দেওয়াটা চল দাঁড়িয়েছে, তার উপর— রাষ্ট্র তো পরিবার নয়। অন্য রাষ্ট্রের কথা থাক, আমাদের আজকের ‘অমৃত রাষ্ট্র’ তো পরিবার নয়-ই। কেন মিছিমিছি সে তুলনা টানা?
চলছে কি এ দেশ পরিবারের মতো করে? পরিবারের মেয়েরা কি বিবস্ত্র হয়ে ছোটে, বাকিরা তাদের ধাওয়া করে যৌন নির্যাতন করতে? যারা দেখে তারা কিছু বলে না? পরিবারের লোকেদের মেরে বার করে দিয়ে কি বুলডোজ়ার চালানো হয়?
পরিবারের কি কেউ অন্যের উপর গুলি চালায় অভিভাবকের নাম জপতে জপতে? পরিবারের মানুষরা কি হাজার হাজার মাইল রাস্তা পেরিয়ে হাঁটে, হাঁটতে হাঁটতে মরে, মরলে তাদের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, আর অভিভাবকরা বলেন ‘না না তেমন কিচ্ছু হয়নি’? প্রশ্ন করতাম, এই অমৃত ভারতে বাকি সব কিছু কি একদম পরিবারের মতোই চলছে যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি-টুকু হলেই সব সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন হয়ে যাবে?

ওই বিধি ভাল না খারাপ, সেটা অন্য কথা। একটা চিঠিতে কতই বা ধরে। সে সব কথা নাহয় আর এক দিন। আজ কেবল প্রশ্নই থাক কয়েকটা। বড় জ্বালাতুনে প্রশ্নগুলো— বিশেষত স্বাধীনতা উৎসবের ঘনঘটার মধ্যে দাঁড়িয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE