তিরুপতির ভেঙ্কটচলপতি মন্দিরে চলছে চন্দ্রযানের একটি মিনিয়েচার মডেলের পুজো। —ফাইল চিত্র।
চন্দ্রযান-৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে সফল ভাবে সফ্ট ল্যান্ডিং করতে পারলে এই অতিজটিল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সফল দেশ হিসাবে আমেরিকা, রাশিয়া, এবং চিনের পরে চতুর্থ নামটি হবে ভারত। সফ্ট ল্যান্ডিং-এর পরে চন্দ্রযান চাঁদ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এবং উপাত্ত সংগ্রহ করবে, যা মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিশা খুলে দেবে। মহাকাশবিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণায় ইতিমধ্যেই ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কাজ বিশ্বের দরবারে সমাদৃত। চন্দ্রযান-৩ সার্বিক ভাবে সফল হলে ভারতীয় মহাকাশবিজ্ঞানীদের টুপিতে আর একটি নতুন পালক যোগ হবে অবশ্যই।
কিন্তু আমাদের দেশে বিজ্ঞানচর্চা কি সাধারণ ভাবে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার প্রক্রিয়াকে নিশ্চিত করে? সে প্রশ্নের উত্তর ইসরো-র আট বিজ্ঞানী, যাঁদের মধ্যে ইসরো-র সায়েন্টিফিক সেক্রেটারি শান্তনু ভাতয়াড়েকর, এবং চেয়ারম্যান এস সোমনাথও আছেন, দিয়েই রেখেছেন— চন্দ্রযান-৩’এর উৎক্ষেপণের আগের দিন তাঁরা তিরুপতির ভেঙ্কটচলপতি মন্দিরে পুজো দিতে যান চন্দ্রযানের একটি মিনিয়েচার মডেল নিয়ে। তিরুপতির শ্রীচেঙ্গালাম্মা মন্দিরে প্রার্থনা সেরে বেরিয়ে ইসরো-র চেয়ারম্যান বললেন, উৎক্ষেপণ সফল হবে।
দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার উচ্চপদে অধিষ্ঠিত বিজ্ঞানকর্মীদের পক্ষে এই আচরণ কি যুক্তিযুক্ত? এতে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ নেই, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অবৈজ্ঞানিক চিন্তার আধিপত্য রয়েছে। এবং, এই ঘটনা নতুন নয়। সতীশ ধওয়ন স্পেস সেন্টারের নতুন মিডিয়া সেন্টার তৈরি হয়েছে বাস্তুশাস্ত্র মেনে। মঙ্গলায়ন মিশনের দিনক্ষণ স্থির করেছিলেন কেরলের জ্যোতিষীরা। প্রায় সমস্ত কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের আগে প্রভু ভেঙ্কটেশ্বরের পুজো দেওয়া হয়ে থাকে নিয়ম করে— ইসরো-র বিজ্ঞানীরা দল বেঁধে পুজো দিতে যান। এই পুজো দেওয়া কোনও ইসরো কর্মচারীর ব্যক্তিগত ক্রিয়াকর্মের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় সংস্থার উদ্যোগে হলে তার অভিঘাত আরও মারাত্মক।
যুক্তিবাদের চর্চাকে কোনও দিনই তেমন উৎসাহ জোগায়নি উপমহাদেশের গুরুবাদী সমাজ। বিজ্ঞানমনস্কতা যুক্তিবাদের নিয়ন্ত্রিত চর্চা বই কিছু নয়। বিজ্ঞানচর্চার আলোচনায় আমরা বিজ্ঞান সাধনাকে শুধুমাত্র এক ধরনের পেশা ভেবে নেওয়ার ভুলটা নিয়মিত করে থাকি— বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্তিবাদের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামাই না তেমন। বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্ব পায় না। পাঠক্রমে আমরা বিজ্ঞানীদের জীবনী পড়াই— বিজ্ঞানমনস্কতার চর্চা করেছেন যাঁরা, সে রকম মানুষদের জীবনী পৌঁছয় না শিশু-কিশোরদের হাতে। মহেন্দ্রলাল সরকার, অক্ষয়কুমার দত্ত, স্বর্ণকুমারী দেবী, নরেন্দ্রবালা দেবী প্রমুখের নাম কার্যত অপরিচিত থেকে যায়। যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানচেতনার যে দীপটি আমাদেরঅগ্রজরা জ্বালিয়েছিলেন, তার আলোয় চেতনা আলোকিত করতে পারিনি আমরা তাই। সেই অকালে নিবে যাওয়া দীপশিখা শাসককে সাহায্য করেছে সমাজের অজ্ঞতাকে মূলধন করে রাষ্ট্রের হাত শক্তিশালী করতে।
ভারতের মহাকাশ গবেষণার কাজ হয় জনগণের করের টাকায়। আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে যাই যে, এই উপমহাদেশে করদাতা কি শুধুই বর্ণহিন্দুরা? অন্য ধর্মাবলম্বী নাগরিকরা, অথবা বর্ণহিন্দু সমাজ এখনও যাঁদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার স্বীকার করতে চায় না, সেই দলিতরা কি করদাতা নন? তা হলে ‘ভারতবাসীর উন্নতিকল্পে’ করা বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের গোড়ায় শুধুমাত্র বর্ণহিন্দুর আরাধ্যের কাছে ধর্না দেন কেন প্রতিষ্ঠানের কর্তারা?
এ পাপ অবশ্য দীর্ঘ দিনের। এবং আশ্চর্যের বিষয় হল, ভারতের উচ্চশিক্ষিত নাগরিকদের, বুদ্ধিজীবীদের, শিক্ষাজীবীদের, এবং সর্বোপরি বিজ্ঞানীদের সিংহভাগের কোনও হেলদোল নেই এতে। অথবা এটাই স্বাভাবিক, কারণ ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই সম্ভবত বুদ্ধি বিক্রয়ের বিনিময়ে ক্ষমতার অলিন্দে পদচারণা করার সুযোগ খুঁজে নিতে চান। এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তক এডওয়ার্ড সাইদ বলেছিলেন, মানবসমাজে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী তাঁরাই, যাঁদের প্রধান কাজ হবে ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে সত্য কথা বলা— তাঁদের বশ করা রাষ্ট্রের পক্ষে সহজ হবে না; যে সব মানুষের কথা অথবা যে সব প্রশ্ন রাষ্ট্র ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চায়, নিরন্তর সেই মানুষদের, সেই প্রশ্নগুলোর প্রতিনিধিত্ব করাই হবে তাঁদের অস্তিত্বের প্রধানতম উদ্দেশ্য। সাইদ ভারতের বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের দেখেননি।
একটি সভাপতির পদ, কমিটি বা কমিশনের প্রধান হওয়ার হাতছানি, গবেষণার সরকারি গ্র্যান্ট, বিদেশযাত্রার সুযোগ, প্রোমোশনের লোভ— এ সব কাটিয়ে উঠে বেশির ভাগ বিজ্ঞানীর সাহস হয় না রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করার। হয় তাঁরা ‘অরাজনৈতিক’ হয়ে থাকার ভঙ্গিটি বজায় রাখেন, অথবা কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ ভবিষ্যৎ যাতে বিঘ্নিত না হয়, তা আগে নিশ্চিত করে ছদ্ম প্রগতিশীল ভূমিকা নেন রাষ্ট্রকে না চটিয়ে, সীমিত ভাবে ‘প্রতিবাদী’ হয়ে। নোম চমস্কি বলেছিলেন, মানুষকে বশে রাখার বিচক্ষণ পন্থাটি হল, গ্রহণযোগ্য মতামতের কঠোর সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া, কিন্তু সেই সীমার ভিতরে ‘তীব্র বিতর্ক’ চালু রাখতে দেওয়া— এমনকি, সেই সীমার মধ্যে কঠোর সমালোচনায় উৎসাহ দেওয়া, বিরোধী মতামতের জায়গা করে দেওয়া। ভারতীয় বিদ্বৎসমাজকে দেখলে বোঝা যায়, গণ্ডির মধ্যে মতপ্রকাশের পুতুলখেলা ঠিক কতখানি বীভৎস।
যে উপমহাদেশে লক্ষ শিশুর মৃত্যু হয় অপুষ্টিতে, মাত্র এক থালা ভাতের বিনিময়ে বিকিয়ে যায় নারীশরীর, অথচ শিবরাত্রির দিন হাজার হাজার লিটার দুধ প্রাণহীন পাথরের টুকরোয় ঢালা হতেই থাকে; যে দেশে গুরু, এবং তাঁদের চেলাদের কথাই দেশ ও মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা রাজনীতিবিদদের কাছে অমৃতসমান— সেই দুর্ভাগা দেশে বিজ্ঞানকে পেশামাত্র হিসাবে দেখার বদলে বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy