Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Classroom

সামোসা বলব শিঙাড়ার বদলে?

একটি শব্দকেই ভিন্ন স্থানের, ভিন্ন সামাজিক স্তর বা পেশার লোক ভিন্ন ভাবে উচ্চারণ করেন।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:১৯
Share: Save:

ছাত্রী ক্লাসে বলল, ‘মিস, রোল নম্বর ১৩ চিল্লাচ্ছিল।’ শিক্ষিকা বিরক্ত। ‘বলো, চিৎকার করছিল।’ বাংলা মাধ্যম স্কুলে ছাত্রীর মুখে ‘মিস’ বা ‘টিচার’ তাঁর কাছে সহনীয়। কিন্তু, শহুরে দিদিমণির কানে ‘চিল্লানো’ সহ্য হয় না। প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্রছাত্রীদের খাতায় এমন অনেক উচ্চারণকে হরফে রূপান্তরিত হতে দেখে তিনি হেসেছেন। রেগেছেন। হাল ছেড়েছেন।


ঠিক, ভাষা অনেকটা বহতা নদীর মতো। ব্যাকরণ, অভিধানের পরোয়া করে না। একটি শব্দকেই ভিন্ন স্থানের, ভিন্ন সামাজিক স্তর বা পেশার লোক ভিন্ন ভাবে উচ্চারণ করেন। ‘মান্য চলিত’-এর ইউনিফর্ম পরিয়ে সেই বৈচিত্রকে ‘মান্য’ করার ছলে ব্যাহত করা যায় না। রানির দেশেও লোকে ‘বাট’কে ‘বুট’ বলে। প্রশ্ন করলে প্রতিপ্রশ্ন আসতেই পারে, ‘আপনি মশাই বুটকে বাট বলছেন কেন?’


আজকের প্রশ্ন অন্য। ভাষার বহতা নদীকে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম জলাধারে সীমাবদ্ধ এবং বিকৃত করার চেষ্টা চলছে না তো? ‘হিন্দি’ আমাদের ‘রাষ্ট্রভাষা’— এই অপপ্রচার দীর্ঘ দিন চলেছে। ‘যোগাযোগ রক্ষাকারী ভাষা’ বিষয়টিকেই চেপে যেতে কর্তারা মরিয়া। গোবলয়ের ধ্বজাধারীরা ‘হিন্দি’কে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনী কাঁটা না থাকলে ভাষা-সাম্রাজ্যবাদের উট ভারতের বিচিত্র সব মাতৃভাষাকে বেছে হোক, না বেছে হোক, খেয়েই ফেলত। ছ’শোর মতো ভাষা ভারতে এখনও টিকেছে (মতান্তরে সাতশোর কিছু বেশি), তবে আড়াইশোর উপর ভাষা গত পঞ্চান্ন বছরে দেশ থেকে ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। আশঙ্কা, প্রত্যেক দুই সপ্তাহে দেশ একটি ভাষাকে হারাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে সেই ভাষাভাষীদের ইতিহাস, সংস্কৃতি। বাঙালি মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে মূলত বাংলায় লেখা জাতীয় সঙ্গীত যে উচ্চারণে গাইছে শুনছে, তাতে তার দেশপ্রেম জাগে না। কষ্ট হয়। সম্ভবত একই কষ্ট তামিলনাড়ু বা সিকিমের মানুষেরও হয়, যদি তাঁরা নিজেদের ভাষায় নিজের দেশের সবচেয়ে প্রিয় গানটি শুনতে বা গাইতে না পারেন।


নানা দেশের, নানা প্রদেশের, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শব্দ বা উচ্চারণকে আমাদের ভাষায় উড়িয়ে আনে সময়। যেমন ‘চেয়ার’-কে ‘কেদারা’ বলা এখন আর সম্ভব নয়। কিন্তু ভাষার স্বতঃস্ফূর্ততা না মেনে তাকে জোর করে বিকৃত করার ষড়যন্ত্রকে মেনে নেওয়া যায় না। দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমে দিনরাত যা দেখছি শুনছি, অস্বস্তি বাড়ছে। এটাই ভাষার ‘আধুনিকতা’?


বিজ্ঞাপনে খরচ বাঁচাতে বা গভীরতর কোনও কারণে হিন্দি উচ্চারণ এবং বাচনশৈলীকে অহিন্দিভাষীদের মাতৃভাষার উপর অন্যায় ভাবে চালানো হচ্ছে। বিজ্ঞাপনী চরিত্রের ঠোঁট মেলাতে ‘তোমরা আমাকে সাথ দাও’— কেমন বাংলা? এমন বিচিত্র বাংলা তরুণরা তো বটেই, মধ্যবয়স্করাও বলছেন। সরাসরি বিদেশি শব্দ প্রয়োগে নয়, আমাদের ভাষার ভিতকে গোড়া থেকে আলগা করে তাকে ভিতর থেকে হত্যা করা হচ্ছে। কলকাতায় দাঁড়িয়ে অবাঙালি দোকানদারের কাছে ‘সামোসা’ চাইছি। বলছি না, ‘আমরা যেমন সামোসা শিখেছি, আপনিও শিঙাড়া শিখে দেখুন। ভাল লাগবে।’ ‘আঞ্চলিকতাবাদ’ নয়। মাতৃভাষার সম্মানের প্রশ্ন।
ভাষার বৈচিত্রময় ভুবনে ভয়ানক ‘একতা’র বিষ ছড়াচ্ছেন দিল্লি-আগত নেতারাও। ‘ট্যাগোর’ আওড়ানোর পর বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়েই নির্বিকার হিন্দিতে বক্তৃতা! বয়ানটি বাংলায় অনুবাদের জন্য দোভাষী নেই কেন? আমরা তো হিন্দি না-ও বুঝতে পারি! বিভিন্ন সংস্থার জনসংযোগকারীদের ফোনে বলি, ‘হিন্দি বুঝতে আমাকে বাধ্য করা যায় না। বাংলায় বলার ব্যবস্থা করুন।’ আজ স্বাধীনতা যখন প্রায় পঁচাত্তুরে বৃদ্ধ, মাতৃভাষার স্বাধীনতা পেল না ভারতবাসী? ‘কেন কী’ হিন্দি আমাদের ‘রাষ্ট্রভাষা’!
প্যারাগুয়ের একটি উপন্যাসের অনুবাদ করছিলাম। বিষয় ছিল— প্যারাগুয়ের আদি ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনধারা কী ভাবে স্প্যানিশ ভাষা-সাম্রাজ্যবাদের কবলে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। গোটা লাটিন আমেরিকার এক ছবি। ভাষা হারানো মানুষের নিঃসঙ্গতার গোলকধাঁধা। সেই উপন্যাসে একটি পেশা ছিল স্বপ্ন বিক্রি। বুঝতে পারছিলাম না, এই স্বপ্নের বিক্রেতাকে বাংলা বা ইংরেজিতে কী নামে সম্বোধন করব। তাঁদের ভাষার সঙ্গে তো তাঁরাও হারিয়ে যাচ্ছেন!
এমন অনেক পেশা, নেশা, ইতিহাস, জীবন ইত্যাদিকে বহন করে চলে একটি ভাষা। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ তাকে মান্যতা দেয়, কিন্তু তার প্রাত্যহিক উদ্‌যাপনকে নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তার জন্য নিজের এবং সকলের মাতৃভাষার জন্য ভালবাসা চাই। একমাত্র সেই ভালবাসাই আইন, বেয়োনেট সব কিছুর মুখের উপর নিজের ভাষায় জবাব দিতে পারে। ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’— পাকিস্তানি সেনা পরিবৃত বাংলায় দাঁড়িয়ে এই সাহসী বাক্যে আত্মপরিচয় ঘোষণা করেছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলা ভাষা যেখানে উচ্চারিত হবে, সেখানেই বাঙালি এক টুকরো মা-ভূমির স্পর্শ পাবে। এই বোধটুকু গড়ে ওঠার জন্যই ‘সামোসা’র পাশে মাথা উঁচু রেখে ‘শিঙাড়া’র দাঁড়ানো দরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE