Advertisement
২১ মে ২০২৪
জনজাতিদের রাজনৈতিক পাশার ঘুঁটি ভাবলে সামনে সমূহ বিপদ
Kurmi Protest

ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে!

ঘটনাচক্রে দেশ বর্তমানে এমন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে চলছে, যখন একাধিক রাজ্যে জনজাতি-কেন্দ্রিক সমস্যা গুরুতর আকারে মাথা চাড়া দিয়েছে।

Kurmi.

পাল্টা: কুড়মিদের আদিবাসী তালিকাভুক্তির দাবির বিরোধিতা করে জেলাশাসকের দফতর ঘেরাও আদিবাসী সংগঠনের। ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ঝাড়গ্রাম। ফাইল চিত্র।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২৩ ০৫:৫৫
Share: Save:

নতুন সংসদ ভবনের বর্ণাঢ্য উদ্বোধন হয়ে গেল। দেশ দেখল, সংবিধানরক্ষার পীঠভূমি সংসদ ভবনে হোমের লেলিহান শিখা। দেখা গেল, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের পুজো-পাঠ এবং প্রধানমন্ত্রীর সাষ্টাঙ্গ সেঙ্গোল-প্রণিপাত। অবশ্যই ধর্মাচরণের অধিকার সকলের আছে, থাকা উচিত। কিন্তু সংসদ ভবন কোনও একটি নির্দিষ্ট ধর্মের দিকে আভূমি ঝুঁকে পড়বে, সেটা কি গ্রহণীয়? ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধে লেখা আছে, ‘সভরেন, সোশ্যালিস্ট, সেকুলার, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক’ এই দেশ। সবাই জানেন, এখানে ‘সেকুলার’ বা ধর্মনিরপেক্ষ থাকার অর্থ ধর্মাচরণের বিরোধিতা নয়। বরং সকল ধর্মকে সমভাবে মান্যতা দেওয়া। কেউ বলতেই পারেন, ওখানেও তো সে দিন সর্বধর্ম প্রার্থনা হয়েছে। হ্যাঁ, ঠিক কথা। তবে দেশবাসী এটুকু নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, ‘প্রদর্শন’ এবং ‘পালন’ এক নয়। সর্বধর্মের প্রদর্শন হলেও সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে একটিমাত্র ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান।

থাক সে কথা। মেনে নেওয়া যাক, যা ‘হওয়ার’ ছিল, তা-ই হয়েছে। কিন্তু সংসদ ভবনের উদ্বোধনে সংবিধানের রক্ষাকর্তা রাষ্ট্রপতিকে ডাকা হল না কেন, সেই প্রশ্নটিও কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিরোধীদের সংসদের অনুষ্ঠান বয়কট করার মূল কারণই হয়েছে জনজাতি সমাজের প্রতিনিধি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে সংসদ ভবন উদ্বোধনে আমন্ত্রণ না-জানানো। জনজাতি, দলিত ইত্যাদি ভোটের দিকে তাকিয়ে বিরোধীদের পদক্ষেপটি কুশলী রাজনীতি। ফল কী হবে, সে সব পরের কথা। তবে এটা ঘটনা যে, বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে ভোট না দিলেও ওই দিকটি মাথায় রেখেই কংগ্রেস, মমতা-সহ বিরোধীরা প্রায় সবাই এখন দ্রৌপদীর ‘অবমাননা’র বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়েছেন। ভোট পর্যন্ত তাঁরা বিষয়টি জিইয়ে রাখতেও চাইবেন।

মোদী কেন রাষ্ট্রপতিকে এমন গরিমাময় একটি অনুষ্ঠানে ডাকলেন না? অনেকের ধারণা, এখানে আছে আর এক সূক্ষ্ম রাজনীতি। রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ করে তাঁর হাত দিয়ে ভবনের উদ্বোধন করানো হলে প্রধানমন্ত্রী মোদী সেখানে ‘দ্বিতীয় ব্যক্তি’ হয়ে যেতেন। আলো পড়ত জনজাতি-কন্যা, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর উপর। সেই পরিস্থিতি তৈরি হোক, প্রধানমন্ত্রী মোদী আসলে সেটা চাননি। ’২৪-এর ভোটের আগে এই ‘কৃতিত্ব’-এর যাবতীয় অংশীদারি তিনি নিজের জিম্মায় রাখতে চেয়েছেন।

তারই পাল্টা চালে বিরোধীদের লক্ষ্য হয়েছে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘জনজাতি-আবেগ’কে কাজে লাগানোর চেষ্টা। ভোটের অঙ্কে যে-সব রাজ্যে এই রকম আবেগ ‘কাজে’ লাগানোর ‘সুযোগ’ বেশি, পশ্চিমবঙ্গ তার একটি। এখানে ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকা কুড়মি আন্দোলনের নিরিখে তৃণমূলের কাছে এখন তার বাধ্যবাধকতাও আছে।

ঘটনাচক্রে দেশ বর্তমানে এমন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে চলছে, যখন একাধিক রাজ্যে জনজাতি-কেন্দ্রিক সমস্যা গুরুতর আকারে মাথা চাড়া দিয়েছে। মণিপুর এবং পশ্চিমবঙ্গ তারই দুই নিদারুণ উদাহরণ। আপাতত স্বস্তির বিষয় যে, এই রাজ্যের অবস্থা এখনও বিজেপি-শাসিত মণিপুরের মতো অগ্নিগর্ভ হয়নি। সেটা না-হওয়াই কাম্য। তবে নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলায় ধোঁয়া বিলক্ষণ কুণ্ডলী পাকাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও সেই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।

বস্তুত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিত পৃথক হলেও পরিস্থিতি থেকে আপাত ভাবে বোঝা যায়, দুই রাজ্যেই জনজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসরদের কিছু অংশের মধ্যে এক টানাপড়েনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। একটি দিক থেকে চাপ যদি হয় ‘সুযোগ’ নেওয়ার, অন্য দিকে তবে রুজি-রোজগার, জমির অধিকার ইত্যাদি হারানোর ভয়।

জনজাতিদের কিছু অংশের শঙ্কা হল, অন্যান্য অনগ্রসর (ওবিসি) ও তফসিলি জাতিদের (এসসি) মধ্যে যাঁরা অর্থ, শিক্ষা, প্রভাবে অপেক্ষাকৃত ‘অগ্রবর্তী’ (ক্রিমি লেয়ার), তাঁরা তফসিলি জনজাতির (এসটি) মর্যাদা পেয়ে গেলে সাবেক জনজাতিদের ‘সুযোগ’ সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। বিরোধের বীজ সেখানে।

রক্তাক্ত মণিপুরের অবস্থা আগে দেখা যাক। সেখানে মেইতেই এবং কুকি-দের সংঘাতের জেরে গোটা রাজ্য জ্বলছে। মৃত সরকারি হিসাবেই কমবেশি পঁচাত্তর। মেইতেই জনগোষ্ঠী ইম্ফলে অত্যন্ত প্রভাবশালী। তাঁদের বড় অংশ ব্রাহ্মণ। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা কম নয়। মেইতেই সমাজের প্রতিনিধিরাই প্রধানত রাজ্য শাসন করেন। ষাট জন বিধায়কের মধ্যে চল্লিশ জন মেইতেই। ফলে অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তিতে মেইতেই অনেক এগিয়ে।

অন্য দিকে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী কুকি জনজাতির একটি ছোট অংশ সরকারি চাকরিবাকরি বা অন্য জীবিকার মাধ্যমে নগর জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে নিলেও একটি বড় অংশ বাস করেন পাহাড়ে। মায়ানমার লাগোয়া সেই সব এলাকায় আফিম চাষ থেকে মাদকের কারবারের মতো কাজকর্ম তাঁদের অধিকাংশের আয়ের অন্যতম উৎস বলা চলে।

কিন্তু সেই সমস্যার সঙ্গে এখনকার ঘটনাকে মেলানো হয়তো ঠিক হবে না। মেইতেইদের ‘জনজাতি’ বলে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটি সামনে চলে আসার ফলেই এখনকার সঙ্কটের শুরু। মেইতেইদের একটি অংশ ‘জনজাতি’র স্বীকৃতি দাবি করে প্রথম আদালতে যান।

বিষয়টি এখনও বিচারাধীন। কুকি-দের আশঙ্কা, মেইতেইদের দাবি মেনে যদি তাঁদের জনজাতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তা হলে পার্বত্য অঞ্চলে জমির মালিকানা থেকে শুরু করে অন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা তাঁরা পেয়ে যাবেন। কোণঠাসা হয়ে পড়বেন কুকিরা।

ঠিক-ভুল জানি না। কেন্দ্র কী ভাবে এর মোকাবিলা করবে, সে সব বলার দায় ও দায়িত্ব প্রধানত নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের। কিন্তু বিষয়টি যদি ঝুলে থাকে, তা হলে তা হবে উত্তর-পূর্বের এই পাহাড় ঘেরা রাজ্যটিকে দ্রুত অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া। বস্তুত পরিস্থিতির ফাঁক দিয়ে ‘কুকিল্যান্ড’-এর দাবি ইতিমধ্যেই ফের মাথা চাড়া দিয়েছে। যার অভিঘাত কখন কী আকার নেয়, বলা কঠিন।

ঠিক এই সময়েই কুড়মিদের আন্দোলন ঘিরে বাংলার জঙ্গলমহলে যা ঘটছে, তা-ও কি অনাগত দুর্যোগের ঘনঘটা? আজ এর উত্তর নেই। কিন্তু এটা বলতেই হবে, অল ইজ় নট ওয়েল!

আমরা জানি, মণিপুরের মেইতেই-এর মতো বাংলার বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরে ছড়িয়ে থাকা কুড়মিরা জনজাতির স্বীকৃতি দাবি করেছেন। সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলি জুড়ে কুড়মি-আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলার অবনতিও ঘটছে। রাস্তা অবরোধ, রেল অবরোধ, নেতাদের পথ আটকানো থেকে শুরু করে আন্দোলনের মারমুখী চেহারা পৌঁছেছে মন্ত্রীর গাড়িতে ভাঙচুর পর্যন্ত।

কুড়মিদের ‘ওবিসি’ থেকে জনজাতি হওয়ার দাবি সঙ্গত কি না, সেটা রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়। রাজ্য যা মনে করবে, সেই ভাবে কেন্দ্রে সুপারিশ পাঠাতে পারে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভার দিল্লির। কিন্তু তাঁদের ‘জনজাতি’র অন্তর্ভুক্ত করা হলে তার বিপরীত প্রতিক্রিয়াও অনিবার্য। সঙ্কটের জটিল সঙ্কেত সেখানে।

আদিবাসী বা জনজাতি, অনগ্রসর শ্রেণি ইত্যাদির ভোট পশ্চিমবঙ্গ-সহ বহু রাজ্যে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে মহার্ঘ। এখানে বাম আমলে এগুলি ছিল তাদের ভোট-ব্যাঙ্ক। তৃণমূলও একই ‘সুফল’ পেয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি জঙ্গলমহল এবং উত্তরবঙ্গে আদিবাসী, জনজাতি, অনগ্রসর ইত্যাদির ভোটে বিজেপি ভাগ বসাতে পেরেছে। রাজ্যের শাসকদের পক্ষে যা চিন্তার। ফলে কুড়মি আন্দোলন নিয়ে সরকারের অবস্থা এখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’! জনজাতি রাষ্ট্রপতিকে ‘অবমাননা’র প্রতিবাদ এ জন্যই আরও অর্থবহ।

অপর দিকে চলছে ঘোলা জলে মাছ ধরার কূটকৌশল। দাবি নিয়ে কেউ ঝেড়ে কাশতে রাজি নয়। বঙ্গ-বিজেপির সভাপতি তো বলেই দিয়েছেন, রাজ্য আগে নিজেদের সুপারিশ কেন্দ্রকে পাঠাক। বাকি কথা পরে।

এ সবই এক প্রকার ‘আত্মঘাতী রাজনীতি’। কথায় বলে, ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে! কেউ হয়তো ভাবছেন, পালিয়ে বাঁচবেন। কেউ দূর থেকে আগুনের আঁচে রুটি সেঁকতে চান। শুধু বুঝছেন না, আগুন বেড়ে ওঠার আগে তা নেবানো সকলের দায়িত্ব। রাজনীতি পরে। এটাই মণিপুরের শিক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kurmi Protest West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE