Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Migration

দেশ ছেড়ে যেতে মরিয়া

সম্প্রতি নামজাদা মাইগ্রেশন সংস্থা ‘গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল’ একটি সমীক্ষা করে দেখেছে, পৃথিবীর ৩৬টি দেশের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দেশ ছাড়তে চাইছেন।

People.

পৃথিবীর ৩৬টি দেশের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দেশ ছাড়তে চাইছেন। প্রতীকী ছবি।

বুবুন চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:২৫
Share: Save:

এত দিন পাখি পরিযায়ী শুনতাম। এখন মানুষও পরিযায়ী। করোনার সময় আমরা দেখেছি শ্রমিকরা দলে দলে নিজেদের কর্মক্ষেত্র থেকে অন্য রাজ্যে, নিজের দেশ-গাঁয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আবার অন্য রকম পরিযায়ীও আছেন, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের মানুষ, যাঁরা ভাবেন, উন্নত দেশে গেলে হয়তো বাকি জীবনটা সুখে-শান্তিতে কাটবে। ভাবেন, এমন একটি দেশে থাকা ভাল, যেখানে আইনকানুন মানা হয়, মাথার উপর ধর্মান্ধতার খাঁড়া নেই, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ভাল হয়, যেখানে শেষ বয়সে একটি উন্নত স্বাস্থ্যপরিষেবা পাওয়া যাবে।

এই সব ভাবনা অকারণ বা অযৌক্তিক বলা যাবে না। ইংল্যান্ডে কোনও দুর্ঘটনায় যদি চার জন মানুষও মারা যান, সরকার হায়-হায় করে ওঠে, অন্তত উঠতে বাধ্য হয়। চেষ্টা করে সমস্ত রকম ভাবে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার। এ সব সম্ভব হয় কয়েকটি কারণে। উন্নত দেশের অর্থসাচ্ছল্য। দুই, কেবল সাচ্ছল্য থাকলেই হয় না, স্বচ্ছ সরকারি কোষাগারও জরুরি। এবং তিন, তুলনা। কম জনসংখ্যা। ইংল্যান্ডে গত সত্তর বছর ধরে সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পান।

আইনকানুনের কথাটা আলাদা করে বলতে হয়। কয়েক দিন আগে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক গাড়ি করে কোথাও যাচ্ছিলেন সিটবেল্ট ছাড়াই। শাস্তি হিসাবে তাঁর ফাইন তো হয়ই, এমনকি পার্লামেন্টেও ঋষি সমালোচিত হন। মনে না পড়ে উপায় থাকে না, ভারতীয় রাজনীতিতে কেউ পঞ্চায়েত প্রধানের পদ পেলে তিন পুরুষের বসে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়।

সম্প্রতি নামজাদা মাইগ্রেশন সংস্থা ‘গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল’ একটি সমীক্ষা করে দেখেছে, পৃথিবীর ৩৬টি দেশের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দেশ ছাড়তে চাইছেন। বিশেষত তরুণ সম্প্রদায়। বেশির ভাগ তরুণই মনে করেন, তাঁদের প্রতিভা এবং দক্ষতা দেখানোর মতো নিজ দেশে পরিকাঠামো নেই। আর এক শ্রেণির দরিদ্র মানুষ মনে করেন, অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করলে তাঁরা একটি সুস্থ জীবন পাবেন। তাঁরা বেশির ভাগই ‘নন-স্কিলড ওয়ার্কার’। এঁরা নৌকা করে, সাঁতরে কোনও রকমে অন্য দেশে ‘অ্যাসাইলাম সিকার’ হিসাবে উপস্থিত হন। গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রেসিডেন্ট ক্যাঞ্চো স্তোশিয়েভ বলছেন, কোনও দেশের ছোট শহরের কর্মক্ষম বাসিন্দা এবং তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দেশান্তরি হওয়ার ইচ্ছে সবচেয়ে বেশি। নিজের দেশে কর্মসংস্থান নেই, পারিশ্রমিক নেই, কর্মসংস্কৃতি নেই— শুধু এগুলোই কারণ নয়। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি সব সময় তুলনা ভালবাসে। তবে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মানুষ কিন্তু সেই অর্থে অভিবাসনে আগ্রহী নন। বরং, ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এর বাইরে ইউরোপের অন্য দেশগুলির মানুষ বেশি মাত্রায় অভিবাসনে আগ্রহী। সম্প্রতি জার্মানির অন্যতম বেতার সম্প্রচারকেন্দ্র-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্তোশিয়েভ বলেন, অভিবাসন প্রত্যাশী এখন অনেক ইউক্রেনবাসীকেই রাশিয়ায় দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেন সমেত রুশদের মধ্যে দেশপ্রেম প্রবল। তবুও এই যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থায় ইউক্রেনের ১৫ শতাংশ মানুষ উন্নত জীবন-যাপনের আশায় দেশ ছাড়তে চাইছেন। এ ছাড়াও চেক রিপাবলিক, পোল্যান্ড এবং জার্মানিতেও অনেক ইউক্রেনীয় যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক কালে আফগানিস্তান, সিরিয়া, মায়ানমার, ভেনেজ়ুয়েলা প্রভৃতি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মানুষ দেশ ছাড়ছেন।

ঠিকমতো কাজ না পাওয়ার জন্য এ-দেশের বহু সম্পন্ন ঘরের ছেলেমেয়ে পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। ভারতীয়দের অভিবাসন সম্পর্কিত তথ্য থেকে দেখা যায়, ভারতীয়দের বেশির ভাগ যাচ্ছেন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর আরব দেশগুলোতে। এ বার দেখা যাক ভারতীয় যুবছাত্রদের দিকে। ২০২১ ও ২০২২ সালের তুলনামূলক তথ্য অনুসারে, ওই এক বছরে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের বিদেশে পঠনপাঠনের জন্য যাত্রা ৬৪.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মোট জনসংখ্যার তুলনায় খুব বেশি না হলেও দেশের শিক্ষিত মানব সম্পদের নিরিখে এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যা। এই ছাত্রদের একটা বড় অংশ আর কখনও দেশে ফিরে আসবেন না। এ ছাড়াও প্রতি বছর এক বড় সংখ্যক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার দেশান্তরি হয়ে চলেছেন নিয়মিত। দেশের ভবিষ্যতের জন্য এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।

আমাদের সন্তানদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ও সাচ্ছল্যের ব্যবস্থা করে দিতে আমরা সকলেই চাই। এই কারণে বহু কাল ধরেই অর্থবান পরিবারের এত বেশি চেষ্টা তাদের ছেলেমেয়েদের (যাঁদের বিদেশে দেখা হয় স্কিলড ওয়ার্কার হিসাবে) উন্নত কোনও দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার। যেটা খেয়াল করার— এখন কিন্তু এই চেষ্টা আর সমাজের উপরের অংশে আটকে নেই, এই প্রবণতা বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় সর্বজনীন। অন্য দেশ, অন্য সংস্কৃতি, অন্য ভাষা ইত্যাদির সঙ্গে অনেক পরিবারের ছেলেমেয়েদেরই মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়। কিন্তু সেটা জেনে এবং মেনে নিয়ে, একরাশ আশঙ্কার মেঘ নিয়েই পরিবার থেকে এ চেষ্টা বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। এই বাস্তবের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এর মধ্যে অনেকখানি ভাবার বিষয় আছে, সেটা মনে রাখি কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Migration People
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE