দেশ জুড়ে হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল হর্ষধ্বনিতে ঢেকে গিয়েছিল ঝিলমের স্রোতের আওয়াজ! ফাইল চিত্র।
চিনার ও দেওদারের জঙ্গল ভেদ করে হাওয়া আর দীর্ঘশ্বাস বয়ে আনে না। জানা নেই, ঝিলম, লিডার বা চেনাব নদীর কোন প্রান্তে এই শীতে সে দীর্ঘশ্বাস বরফখণ্ডে পরিণত হয়ে গিয়েছে! তা বলে কি দীর্ঘশ্বাস পড়ে না ‘স্বাভাবিক ও সুখী’ কাশ্মীরের?
অনুরাধা ভাসিনের সাম্প্রতিক বই আ ডিসম্যান্টলড স্টেট/ দি আনটোল্ড স্টোরি অব কাশ্মীর আফটার আর্টিকল ৩৭০ পড়তে পড়তে এমন নানা প্রশ্ন জাগছে। কাশ্মীরের অন্যতম পুরনো ইংরেজি দৈনিক কাশ্মীর টাইমস-এর সম্পাদক অনুরাধা। প্রায় তিন দশক ধরে উপত্যকায় কাজ করছেন দেশের অন্যতম সাহসী ও লড়াকু সাংবাদিক। বইয়ের প্রতিপাদ্য এর শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট। কাশ্মীরের রূপান্তর অনেক দিনই স্পষ্ট, কিন্তু ২০১৯-এর ৫ অগস্টে কাশ্মীর যখন হারায় পৃথক রাজ্যের গরিমা, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার অধিকার, সে এক ঐতিহাসিক দিন। দেশ জুড়ে হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল হর্ষধ্বনিতে ঢেকে গিয়েছিল ঝিলমের স্রোতের আওয়াজ! অনুরাধা বলছেন, ৫ অগস্টের এক পক্ষকাল আগে থেকে কাশ্মীর ডুবে যেতে থাকে গভীর এক ফাঁদে, যে ফাঁদ অনিশ্চয়তা আর বিশৃঙ্খলায় ভরা। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ৩৮ হাজার অতিরিক্ত সেনা ও আধাসেনা পাঠানো হয়। এর আগে মে মাসে অমরনাথ যাত্রার শুরুতে তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত ৪০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়। পরে সেই যাত্রা স্থগিত হয়ে যায় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে।
সমাজমাধ্যমে ফাঁস-হওয়া সরকারি সার্কুলার, অত্যাবশ্যক পণ্য মজুতের জন্য অস্বাভাবিক তৎপরতা, বিভিন্ন মসজিদের তালিকা, সেগুলির পরিচালন বোর্ডের সবিস্তার তথ্য চাওয়া— নানা ঘটনাক্রম উপত্যকার ভূমিপুত্রদের কপালের ভাঁজ আরও গভীর হচ্ছিল। তার পরের ঘটনা সকলেরই জানা! জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা, লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানিয়ে ফেলা, চোখের পলকে ঘটে গিয়েছে সব কিছু! জম্মু কাশ্মীরে অবশ্য বিধানসভা রয়েছে। কেন্দ্রীয় শাসক দলের সুবিধা মোতাবেক নির্বাচনও হবে, ধরে নেওয়া যায়।
যখন কেন্ত্রীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল শ্রীনগরের বিরিয়ানি খেতে খেতে সব কিছু স্বাভাবিক বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন, সে সময়ে কাশ্মীরে কী ঘটে চলেছে? সাংবাদিক হিসেবে যেন এক ধারাভাষ্য দিয়ে চলেছেন ভাসিন। যেমন, জম্মু কাশ্মীরের কুখ্যাত জনসুরক্ষা আইন। অনুরাধা দেখিয়েছেন, কী ভাবে এই দমনমূলক আইনের নির্বিচার ব্যবহার হয়েছে। এই আইন প্রয়োগ করে কাউকে ধরলে তাকে দু’বছর পর্যন্ত বিনা আয়াসেই জেলে পুরে রাখা যাবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ধারায় আনা অভিযোগ আদালতে খারিজ হয়ে যায়। তাতে অবশ্য পুলিশের বিশেষ কিছু যায় আসে না। কারণ, অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্তি পাওয়ার আগেই আবার একটি নতুন মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে পিএসএ প্রয়োগ করে তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। একে বলা হয় ‘রিভলভিং ডোর ডিটেনশন’। যে দরজা দিয়ে বেরোনো, সে দরজা দিয়েই আবার জেলে ঢোকা!
অনুরাধা মনে করান, গত শতকের সত্তরের দশকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লার আমলে পিএসএ-র প্রণয়ন হয়। উদ্দেশ্য ছিল, কাঠের চোরাচালান রোখা। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য পরে এই আইনই শেখ আবদুল্লার অস্ত্র হয়ে ওঠে। ইতিহাসের এক নির্মম পরিহাসের কথা শোনান অনুরাধা। বলেন, সে সময়ে উপত্যকার সব থেকে জনপ্রিয় নেতার আনা আইন দীর্ঘ পাঁচ দশক পরে প্রয়োগ হচ্ছে দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, যথাক্রমে তাঁরই পুত্র ফারুক আবদুল্লা ও নাতি ওমর আবদুল্লাকে আটক করে রাখার জন্য!
একের পর এক নেতাকে জেলে পোরা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ নেতানেত্রীদের গৃহবন্দি করা হচ্ছে। পাঁচতারা হোটেলও পরিণত জেলখানায়। বিভিন্ন গেস্ট হাউস বদলে গিয়েছে বন্দিশালায়। বিচ্ছিন্ন মোবাইল পরিষেবা, বিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট। ল্যান্ডলাইনও বিচ্ছিন্ন! রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড, কাঁটাতার, মেশিনগান আর রাইফেল, জলপাইরঙা ঊর্দি আর বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটের আস্ফালন!
আর সাধারণ মানুষ? দিনে-রাতে, বাড়িঘর তছনছ করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অসংখ্য যুবককে। তল্লাশি অভিযানের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মহিলাদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠছে ব্যাপক ভাবে। যাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাঁদের ক্ষেত্রে দু’টি ব্যাপার ঘটছে। প্রথমত, গ্রেফতার দেখালে বাড়ির লোকজন তুলনায় নিশ্চিন্ত হন এই ভেবে যে, অন্তত ধৃতকে আদালতে তোলা হবে, যদিও তাঁরা জানতেও পারেন না, কোথায় কোন জেলে রাখা হয়েছে ধৃতকে। সব থেকে ভয়ের হল, তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে হেফাজত থেকে কারও ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়াটা। এর মানে হয়তো তাদের ঠাঁই হয়েছে কাশ্মীরের কুখ্যাত গণ-কবরে। কারণ, গ্রেফতার না দেখালে নিরাপত্তা বাহিনী স্বীকারই করবে না যে, তাদের তুলে আনা হয়েছে, হত্যার থেকেও যা ভয়ঙ্কর!
কাশ্মীরের এই যে অস্বাভাবিক নীরবতাকে ‘স্বাভাবিকতা’ বলেই দাবি করা হচ্ছে, শেষ কোথায় তার? চিনার-দেওদারের জঙ্গল বেয়ে আর কি উপত্যকায় বইবে সত্যিকারের বসন্ত-বাতাস?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy