Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
গাজ়া সঙ্কট দেখাল বাস্তুচ্যুতি ও জাতিনিধন কোথায় পৌঁছতে পারে
Israel-Palestine Conflict

এই অবারিত গণহত্যা

রাষ্ট্রপুঞ্জ ছাড়াও রেড ক্রস, অক্সফ্যাম-সহ অন্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলি এক যৌথ বিবৃতিতে গাজ়ার পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে অভিহিত করে ‘অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতি’র আহ্বান জানিয়েছেন।

An image of Ambulance

গণকবর: অ্যাম্বুল্যান্সের সারি চলেছে ধ্বংসের পথ দিয়ে, গাজ়া, ২৪ নভেম্বর। ছবি: রয়টার্স।

অনিন্দিতা ঘোষাল
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:২৩
Share: Save:

গাজ়া এবং ইজ়রায়েলের সংঘর্ষ দেখিয়ে দিল আরও এক বার— গণহত্যা কাকে বলে। কোনও ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয়। প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারেন।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৭২০ অব্দ থেকেই ইহুদিদের মধ্যে জেরুসালেম-কেন্দ্রিক নিজেদের আবাসস্থল বা পবিত্র ভূমি প্রতিষ্ঠার বাসনা ছিল। মিশরের ফারাওদের অত্যাচারে নির্যাতিত এক ভাসমান গোষ্ঠী (আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় যাঁদের বলে হয় ডায়াস্পোরা) হিসাবে ইহুদিদের উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বাধীন ইজ়রায়েল প্রতিষ্ঠার পিছনেও প্রথম থেকে ভাবনাটা ছিল, ইউরোপ ও অন্যত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের ‘শরণার্থীদের মতো ভাসমান অবস্থা’ থেকে মুক্তি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ, মিত্রবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক প্রপেলেন্ট তৈরির জন্য ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়নবিদ ওয়েজ়ম্যানকে কৃত্রিম উপায়ে অ্যাসিটোন তৈরি করার জন্য অনুরোধ করেন। হর্স-চেস্টনাট থেকে যুদ্ধের জন্য ৩০,০০০ টন অ্যাসিটোন উৎপাদন এক জ়ায়নবাদী আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রথম ধাপ হিসাবে বাস্তবে কাজ করেছিল বলা যায়। প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ যুদ্ধ শেষে ওয়েজ়ম্যানকে ডেকে পাঠালে, তিনি পুরস্কার হিসাবে চেয়েছিলেন, ‘আ ল্যান্ড ফর মাই পিপল’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হওয়ার পর, আজকের প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনকে খ্রিস্টান, ইসলাম এবং ইহুদি ধর্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলে, একে আন্তর্জাতিক অঞ্চল হিসাবে ছেড়ে দেওয়া হয়। লিগ অব নেশনস-এর ম্যান্ডেট বা আদেশানুসারে, ব্রিটেন ছিল এই অঞ্চলের দায়িত্বে।

১৯১৭ সালে ব্রিটিশ বিদেশ সচিব লর্ড বালফুর প্যালেস্টাইনে আরবদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও ইহুদিদের ‘হোমল্যান্ড’ হিসাবে তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মতকে সমর্থন করেন। এই ঘোষণার পর, ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তথাকথিত ছিন্নমূল ইহুদিরা বিরাট সংখ্যায় জেরুসালেম সংলগ্ন অঞ্চলে আসতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকস্টের সময় সেই ধারা আরও বাড়তে থাকে। আরব ভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মিজ়রাহি ও সেফার্ডিক ইহুদিরাও তাদের পবিত্র ভূমির উপর নিজেদের অধিকার স্থাপন করতে বদ্ধপরিকর ছিল। এশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে আসে। কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রিত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে ফিরে আসায়, সেখানকার প্রকৃত বাসিন্দারা বাস্তুচ্যুত হতে থাকে। সমস্যার সমাধানে রাষ্ট্রপুঞ্জকে অবতীর্ণ হতে হয়। ১৯৪৭ সালে প্যালেস্টাইনকে দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব পাশ হয়। আরব দেশগুলি কিন্তু তখনই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল।

ভারত যে সময় দেশভাগ থেকে উদ্ভূত শরণার্থী সমস্যা সামলানোর চেষ্টা করছিল, আরব ভূখণ্ডে সেই সময়েই ১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দুই ঘটনার পিছনেই ব্রিটেন ছিল ক্রীড়নকের ভূমিকায়। ইজ়রায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট হলেন ওয়েজ়ম্যান, আমেরিকা-সহ প্রথম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে নবগঠিত ইজ়রায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে তিনি মৌলিক ভূমিকা পালন করলেন। কিন্তু, শুধু প্যালেস্টাইনি বিতাড়ন নয়, আরব উদ্বাস্তুদের প্রতি ইজ়রায়েলের মনোভাব, এবং ব্যাপক পরিমাণে প্যালেস্টাইনি শরণার্থী হওয়ার পিছনে যে রাজনীতি, প্রথম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির প্রশ্রয়েই তা বাড়তে থাকে।

এই একুশ শতকেও প্যালেস্টাইনিরা প্রতি দিন ‘অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত’ গোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে, যদি এই বাক্যাংশের আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা মনে রাখি। কিন্তু আশ্চর্য, যদিও আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে কোনও দেশ অন্য পক্ষের হাসপাতালগুলোতে আক্রমণ করতে বা চিকিৎসা প্রদানে বাধা দিতে পারে না, এ বারেও আমরা দেখলাম গাজ়ার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফার ভিতরের টানেলে জঙ্গিদের মূল
কেন্দ্র এই আশঙ্কায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কী ভাবে হাসপাতালে ঢুকে পড়ল ইজ়রায়েলের সেনাবাহিনী। বহু রোগী পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন, জীবনদায়ী ওষুধ এবং ভেন্টিলেশন কাজ না করার কারণে মারা গেল শিশুরা।

লক্ষ করার মতো বিষয়, আমেরিকান প্রশাসন, ব্রিটেন এবং অন্য পশ্চিমি দেশগুলি— যারা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলিতে মানবাধিকারের নামে অন্য সময়ে এত সরব, তারা কেউ কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে ইজ়রায়েলের এক বিন্দু সমালোচনা করেনি, উল্টে তাঁদের সমর্থন জানিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। যাঁরা সমালোচনা করেছেন, তাঁদের সন্ত্রাসের বন্ধু বা সমর্থক বলে দাগিয়ে দিয়েছে। এত দিনের মধ্যে যুদ্ধে দৈনিক চার ঘণ্টা মানবিক যুদ্ধবিরতির অনুমতি দেওয়ার জন্য চাপ এসেছে কেবল। এই ভণ্ডামি অমার্জনীয়।

প্যালেস্টাইনিদের প্রধান বাস্তুচ্যুতি ঘটেছিল ১৯৪৮ সালে। এই ঘটনাকে আরবি ভাষায় বলা হয় ‘নাকবা’, যার অর্থ ‘বিপর্যয়’। সেই সূত্র ধরে এ বারের ইজ়রায়েলের আক্রমণকে হামাস নাম দিয়েছে, দ্বিতীয় নাকবা। সম্প্রতি ইজ়রায়েলের কৃষিমন্ত্রী স্পষ্ট বলেছেন যে, প্যালেস্টাইনিদের ব্যাপক ভাবে বাস্তুচ্যুত করার জন্যই এ বারের পরিকল্পনা। তাঁরাও এর নাম দিয়েছেন, ‘গাজ়া নাকবা ২০২৩’। ইউ এন রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি (ইউএনআরডব্লিউএ)-র সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী গাজ়া উপত্যকায় তারা যে আটটি প্যালেস্টাইনি শরণার্থী শিবিরকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাতে ৬ লক্ষের বেশি প্যালেস্টাইনি শরণার্থী নিবন্ধিত রয়েছে। ইজ়রায়েলের সামরিক বাহিনী সেই আটটি শিবিরের মধ্যে পাঁচটিতে সরাসরি বোমা হামলা চালিয়েছে। আল-মাগাজ়ি শিবিরকে লক্ষ্য করে সর্বশেষ হামলায় অন্তত ৪০ জন নিহত। মধ্য গাজ়ার বুরেজ় শরণার্থী শিবিরে একটি স্কুলের কাছে বিমান হামলা হয়েছে। প্রায় অর্ধেক নিবন্ধিত শরণার্থী অন্য দেশে পালানোর চেষ্টার জন্য, প্রথমে উদ্বাস্তু থেকে অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত, সুতরাং এখন রাষ্ট্রহীন। শুধু শরণার্থী শিবির নয়, মসজিদ, গির্জা এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জের আশ্রয়শিবিরগুলোও ইজ়রায়েলি হামলা থেকে বাঁচতে পারেনি। ইউএনআরডব্লিউএ-এর কর্মী-সহ বহু ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন— পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনাও বিরল।

রাষ্ট্রপুঞ্জ ছাড়াও রেড ক্রস, অক্সফ্যাম-সহ অন্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলি এক যৌথ বিবৃতিতে গাজ়ার পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে অভিহিত করে ‘অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতি’র আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ইউনিসেফ, হু, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, সেভ দ্য চিলড্রেন এবং কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রধানরা ছিলেন। মিশর-গাজ়া সীমান্তে মানবতাবাদীদের শত শত ট্রাক ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু গাজ়ার মাটিতে ঢুকতে পারছে না। প্যালেস্টাইনিরা অবশ্য বলেছেন, সীমান্ত ক্রসিং খুলে গেলেও তাঁদের পরিবার গাজ়া ছেড়ে যেতে চান না, গাজ়া তাঁদের বাড়ি। বিমান হামলায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলেও তাঁরা সেখানেই থাকবেন। তাঁরা আবার অন্যত্র রাষ্ট্রহীন হয়ে থাকার চেয়ে বরং গাজ়ায় মরবেন।

ইজ়রায়েলে সামনে ভোট। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর গদি টলমল করছিল এই ক’দিন আগেও। তাঁর জনপ্রিয়তা নাকি তলানিতে ঠেকেছিল। তিনি এক দিকে বলছেন, যুদ্ধের পর গাজ়া দখলের বাসনা নাকি ইজ়রায়েলের নেই। আবার অন্য দিকে সমস্যার সমাধান হিসাবে পৃথিবীর রাষ্ট্রনেতারা যখন দ্বি-রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার কথা বলছেন, সেই সমাধানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে তিনি লিখেছেন, এই ভূখণ্ড শুধু ইহুদি জনগণের রাষ্ট্র।

এই সমস্যার কোনও চিরস্থায়ী সমাধান হওয়া সম্ভব কি না, তা সময় বলবে। কিন্তু, মধ্যযুগীয় ইউরোপে নিপীড়নের সময় অনেক ইহুদি মুসলমানদের দ্বারা শাসিত ভূমিতে স্থান পেয়েছিল। আবার অনেক সময় ইহুদিরা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে নিপীড়নের শিকার হয়ে শরণার্থী হিসাবে খ্রিস্টান-অধিকৃত ভূমিতে আশ্রয় পেয়েছিল। দ্বন্দ্ব আগে ছিল খ্রিস্টীয় মতাবলম্বীদের সঙ্গে জ়ায়নবাদীদের। ইজ়রায়েলের স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পর সেই দ্বন্দ্বের চরিত্র পাল্টে যায়।

কোনটা কার ‘হোমল্যান্ড’ বা নিজ বাসভূমি, কে কোথায় কেন শরণার্থী, কোন দেশের সম্পদের যথার্থ ভাগ বা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী, সেই বিতর্ককে নিয়েই এই পৃথিবী চলছে, কয়েক শতাব্দী ধরে। কিন্তু অপমান ও শাস্তিপ্রদানের ধারণাকে হাতিয়ার করে, অসংবেদনশীল মানসিকতা এবং অনড় রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তৈরি সঙ্কটের পরিণাম হিসাবে যুদ্ধ আর গণহত্যার এমন ভয়াবহতা, এই পৃথিবী ইদানীং কালে খুব একটা দেখেনি। অন্তত এই শতকে তো নয়ই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE