Advertisement
১৮ মে ২০২৪
Bengal SSC Recruitment Case

নির্দোষের শাস্তি দুর্ভাগ্যজনক

সংবাদে প্রকাশ, যত জন চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের সবার সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে ওঠা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত তদন্ত চালু থাকবে। ইতিমধ্যে সবাই চাকরি খোয়ালেন।

সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:৫৪
Share: Save:

কলকাতা হাই কোর্টের দুই মাননীয় বিচারক প্রায় ২৬০০০ স্কুলশিক্ষক ও স্কুলকর্মীর চাকরি নাকচ করে দিলেন। তাঁদের এত দিন পাওয়া মাইনে সুদসমেত ফেরত দিতে বলা হয়েছে। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও প্রশ্ন করা প্রয়োজন, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার যে দর্শনের কথা আমাদের জানা, তার সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের সংঘাত নেই কি? সে দর্শন বলে, একশো জন অপরাধী যদি প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যায়, তা হলেও ক্ষতি নেই; কিন্তু এক জন নিরপরাধ ব্যক্তিও যাতে শাস্তি না পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। যাঁরা যোগ্য হয়েও চাকরি পাননি এবং এক গর্হিত অন্যায়ের শিকার হয়েছেন, তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্তির আশায় যে মামলাগুলো হয়েছিল, সেই সুবাদে কিছু অযোগ্য মানুষ যে চাকরি হারাবেন, সেটা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু যোগ্য হয়েও কাউকে চাকরি হারাতে হবে, মাইনের টাকা ফেরত দিতে হবে— একে কি ন্যায়বিচার বলা চলে?

সংবাদে প্রকাশ, যত জন চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের সবার সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে ওঠা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত তদন্ত চালু থাকবে। ইতিমধ্যে সবাই চাকরি খোয়ালেন। যাঁদের চাকরি গেল, তাঁদের অনেকেই হয়তো সত্যিই দুর্নীতির পথে চাকরি ‘কিনেছিলেন’। কিন্তু, যাঁদের চাকরি গেল, তাঁরা কেউ এই মুহূর্তে পুরোপুরি দোষী সাব্যস্ত হননি। কারণ, অভিযুক্ত ব্যক্তি ধরে ধরে এক-একটি ফাইল সম্ভবত তৈরি করা যায়নি, যাতে সন্দেহের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাঁদের দোষী প্রমাণ করা যায়। এখানেই খানিকটা ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। যাঁদের চাকরি গেল, তাঁদের মধ্যে কি এক জনও নেই যিনি আসলে সৎ পথে, খেটেখুটে চাকরিটি পেয়েছিলেন? প্রত্যেকের বিষয়ে সব তথ্য সম্বলিত এবং দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন প্রমাণ কি জোগাড় করা গেছে? অন্তত সিবিআই সম্পর্কে এ দিক-ও দিক যা খবর বেরিয়েছে, তার ভিত্তিতে এমন কথা হলফ করে বলা মুশকিল। তা হলে একটি সম্পূর্ণ নির্দোষ মানুষ অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত হতে পারার সম্ভাবনাকে কি উড়িয়ে দেওয়া যায়?

শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি শাসনব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে কিছু অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে নিছক সাধারণ কিছু সমস্যা সমাধানের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যদি ক, খ, গ তিন জন দুর্নীতির সাহায্যে চাকরি পেয়ে থাকেন তা হলে আলাদা আলাদা ভাবে তিন জনের তথ্যভান্ডার সাজিয়ে ফাইল তৈরি করাটাই রীতি। আর এঁদের চাকরি গেলে, যাঁরা মামলা করেছেন তাঁদের মধ্যে তিন জন সর্বোত্তম প্রার্থীকে চাকরিগুলো দিয়ে দেওয়াটাও উচিত বলে ভাবা হত। যে-হেতু চাকরি খোয়ানো ২৬০০০ জনের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ পেশ করা যায়নি, কাজেই প্রশ্নের অবকাশ থাকছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার উচ্চতর আদালতে যাচ্ছে। সেই বিচারপ্রক্রিয়া আরম্ভ হলে, যাঁরা এই মামলায় জিতে চাকরির আশা করছেন, তাঁদের সত্বর চাকরি পাওয়া আটকে যাবে না তো? কেউ বলতে পারেন, যে হাজার পাঁচেক মানুষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ আছে, তাঁদের বরখাস্ত করে সেই জায়গায় পাঁচ হাজার যোগ্য প্রার্থীকে চাকরি দেওয়া হলে, এবং বাকিদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হওয়ার পর সেই চাকরিগুলোর নিষ্পত্তি করা হলে হয়তো পরিস্থিতি তুলনায় ভাল হত। অনেক যোগ্য লোক তুলনায় তাড়াতাড়ি চাকরি পেতেন, সরকারও হয়তো এমন তেড়েফুঁড়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঠুকত না।

বহু মামলাতেই বাদী এবং বিবাদী, উভয় পক্ষেরই লোকসান হয়; লাভ হয় কোনও এক তৃতীয় পক্ষের। এই মামলাতে সেই তৃতীয় পক্ষটি কে, বলে দেওয়ার নিশ্চয়ই প্রয়োজন নেই। তাঁদের মধ্যে অনেকেই কর্মী-নিয়োগে দুর্নীতি বা যোগ্য প্রার্থীদের দীর্ঘ বঞ্চনা ইত্যাদির চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী রাজ্য সরকারের পতন নিশ্চিত করতে। ফলে, অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলো সামনে আসতে চায় না।

অধুনা বিশ্বে জনপ্রিয় অথচ একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবসম্পন্ন নেতাদের পক্ষে সাধারণ মানুষের সমর্থন বিষয়ে কয়েকটি সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল কিছু দিন আগে। দেখা যায়, বেশির ভাগ দেশেই এমন একনায়কতন্ত্রী শাসককে সমর্থন করেন প্রধানত অশিক্ষিত জনগণ। ব্যতিক্রম ভারত এবং ব্রাজ়িল, সেখানে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত মানুষেরা এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন বলে সমীক্ষায় প্রকাশ। ওই সমীক্ষায় আরও প্রকাশ যে, আজকাল এ দেশের শিক্ষিত মানুষজন মাসকুলার গভর্ন্যান্স বা পেশিবহুল শাসনব্যবস্থা বেশি পছন্দ করছেন— গণতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা তাঁদের না-পসন্দ, হাতেগরম সিদ্ধান্ত চান তাঁরা। বিচারে শাস্তিবিধানের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা বরদাস্ত করব না, তাতে যদি কিছু নির্দোষ লোকের শাস্তি হয় তো হোক— শিক্ষিত নাগরিক সমাজের একাংশের এই মানসিকতা বেশ চোখে পড়ছে।

কর্মী-নিয়োগ দুর্নীতির সব কান্ডারিকে কিন্তু জেলে যেতে হয়নি বা তদন্ত সংস্থার ‘নেকনজর’-এ পড়তে হয়নি। আবার, সন্দেহাতীত প্রমাণ থাকায় অনেক বিশিষ্ট মানুষ এখন জেল হেফাজতে। ফলে তদন্ত সংস্থা যে অদক্ষ কিংবা প্রমাণ জোগাড়ে অপারগ সেটা বলা যাবে না। কাজেই, এ ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটছে, তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE