ছোটবেলার প্রজাতন্ত্র দিবস। ফাইল ছবি।
ছোটবেলায় স্বাধীনতা দিবসের শীত সংস্করণ বলে মনে হত প্রজাতন্ত্র দিবসকে। সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নের উত্তর হিসেবে দুটো আলাদা আলাদা দিনকে সাল এবং মাস সমেত নিখুঁত ভাবে মনে রাখতে হত। পঞ্চম শ্রেণি থেকে প্রায় সমস্ত বইয়ের প্রথম পাতায় দেখতে পাওয়া যেত ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা। সুতরাং, আমাদের স্কুলব্যাগে থাকত সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার স্বপ্নে নির্মিত হতে চাওয়া সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের একটি দলিলের মুখবন্ধের প্রতিলিপি। শৈশবে আমাদের অজানতেই আমাদের স্কুলব্যাগে পাশাপাশি মাথা গোঁজার জায়গা করে নিয়েছিল গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র।
খেয়াল করে দেখেছি— গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র শব্দ দু’টি পাশাপাশি অবস্থান করলেও প্রজাতন্ত্র ব্যাপারটা গণতন্ত্রের পাশে ভাবনা ও আলোচনার পরিসরে যেন দুয়োরানি। ভারতীয় রাজনীতিতে স্বাধীনতার প্রথম কুড়ি বছরের কংগ্রেস আমল, জরুরি অবস্থা, অ-কংগ্রেসি সরকার, দুর্নীতি, ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, নির্বাচনে অর্থ ও হিংসার অবাধ প্রয়োগ— এ যাবৎ নানাবিধ প্রেক্ষিতে ভারতীয় গণতন্ত্রের সাফল্যের বিপক্ষে বা পক্ষে যুক্তি সাজানো হয়েছে। গণতন্ত্রের সফল যাত্রার পথে অন্তরায় উপাদানগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক তার পুনর্বিন্যাসের চেষ্টা, সংসদীয় ব্যবস্থা না রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা অধিকতর কাম্য, সেই বিষয়েও ভাবনাচিন্তা হয়েছে।তবে, প্রজাতন্ত্রের বিষয়ে আলোচনা পাবলিক স্ফিয়ারে বা অ্যাকাডেমিক স্ফিয়ারে কোথাও সেই ভাবে চোখে পড়ে না। তার দু’টি কারণ হতে পারে। এক, গণতন্ত্রের নিরিখে প্রজাতন্ত্র ব্যাপারটাঠিক ততখানি গুরুত্বপূর্ণ নয় অথবা দুই, প্রজাতন্ত্র এমন এক পরম হিত বা পরম কল্যাণ— যা আলোচনার ঊর্ধ্বে।
কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসেও খেয়াল করে দেখেছি— প্রজাতন্ত্র বিষয়ে আলোচনা যেন শুরু হতেই শেষ হয়ে যায়। ‘প্রজাবর্গের প্রতিনিধি কর্তৃক পরিচালিত রাষ্ট্র’, ওই পর্যন্তই। তুলনায় গণতন্ত্র তো বটেই, এমনকি একনায়কতন্ত্র ও সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্রের আলোচনা বেশ কিছুটা সময় পায়। কলেজে গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র বিষয়ে তুলনামূলক একটা ধারণার জন্য রেফারেন্স হিসেবে বলা হয়েছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রজা ও তন্ত্র বইটি। বইটির ভূমিকা খুলতেই দেখি প্রথমেই আমাদের মনে সেই সযত্নে লালিত সংশয়— গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের মধ্যেকার মূল তফাত তা হলে কী, তা থেকেই আলোচনা শুরু হচ্ছে। প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রের প্রধান পদটির নিয়োগ পদ্ধতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নির্বাচিত বা মনোনীত হতে হবে, রাজতন্ত্রের মতো বংশানুক্রমিক হওয়া চলবে না— এই ধারণা যদিও আগেই জানা ছিল। কিন্তু অন্য একটি প্রশ্ন বেশ নাড়া দেয়। প্রজাতন্ত্রে প্রজা ও তন্ত্রের সম্পর্ক।
প্রজাতন্ত্র নিয়ে কথা বলতে গেলে গোড়ায় একটা বড় সমস্যা আছে। প্রজাতন্ত্র স্বীকার করলে প্রথমেই যেটা স্বীকার করতে হয় সেটা হল— প্রজা নিজেকে শাসন করার জন্য এই তন্ত্র নির্মাণ করেছে। অতএব, প্রজার চৈতন্য আছে। প্রজার চৈতন্য আছে— এই কথা স্বীকার করলে অবশ্য সঙ্কটে পড়বেন রাজনৈতিক নেতারা। কারণ, এই তন্ত্রের সঙ্গে অর্থাৎ শাসনের জন্য প্রেরিত প্রতিনিধির সঙ্গে প্রজা ঠিক উচ্চ-নীচ সম্পর্কের বন্ধনে বাঁধা নয়। এই তন্ত্র নির্মাণে প্রজার চৈতন্য কেবল নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রতিনিধি প্রেরণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত অপেক্ষার চৈতন্যমাত্র নয়।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষে প্রজা শব্দের অর্থের প্রথমেই রেখেছেন— সন্ততি, অপত্য। লোক, জন, রায়ত হয়ে এর অর্থ শেষ হচ্ছে পুত্রসম বা স্নেহপাত্রে গিয়ে। আর তন্ত্র? তার অর্থ সন্তান, অপত্য, কুল, বংশ থেকে শুরু হয়ে রাষ্ট্র, দেশ, স্বরাষ্ট্রচিন্তা, স্বরাজ্যবিষয়ক চিন্তা হয়ে সৈন্য, ধন, পরিরক্ষণ বা শাসনে গিয়ে শেষ হচ্ছে। সন্ততিকে পরিরক্ষণ করার কাজটা সহজ নয়। প্রজা যখন সন্ততি, তখন দল, মত, লিঙ্গ, ধর্ম, রাজনৈতিক বিশ্বাস, শ্রেণি পরিচয় সকলই সেখানে গৌণ। শিল্পপতি যেমন প্রজা, বেকার যুবকও প্রজা, মহলের বাসিন্দারা যেমন প্রজা, ফ্লাইওভারের নীচে রাত কাটানো মানুষেরাও প্রজা। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন থেকে বিশেষ লিঙ্গ-পরিচিতিসম্পন্ন সকলেই প্রজা। সকলের মাথার উপরেই এই হাত রাখতে হবে। কী ভাবে হাত রাখা সম্ভব? ভুখা প্রজার অন্নের সংস্থান, গৃহহীন প্রজার মাথায় ছাদ অথবা যোগ্যকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা সম্ভব।
প্রজা ও তন্ত্র-এর ভূমিকায় পার্থ চট্টোপাধ্যায় যখন লিখছেন, “যে রাষ্ট্র প্রজারা পরিচালনা করে, সে রাষ্ট্রে প্রজা কারা? প্রজাই তো সেখানে রাজা।” কলেজের প্রথম বর্ষে ভেবেছিলাম তা হলে কি এই প্রজাতন্ত্র আসলে ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে?’ এখন মনে হয়— প্রজা যে তন্ত্র নির্মাণ করেছে, সেই তন্ত্রের চালিকাশক্তি কি প্রকৃতই প্রজার হাতে থাকে? না কি এই তন্ত্রে প্রজার প্রেরিত প্রতিনিধি এক দুরূহ অন্তরালে নিজেকে ঢেকে রাখেন— যাকে সবাই দেখতে পায় না, শুধু কোনও অজ্ঞাত নির্দেশ বা কোনও অলীক সম্মোহনে রথের চাকাগুলি অবিরাম ঘুরতে থাকে, যার সামনে হুজুর মাই-বাপ বলে হাঁটু মুড়ে বসা ছাড়া প্রজার আর কোনও গতি নেই?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy