Advertisement
২৯ এপ্রিল ২০২৪
Society

হিংসা যখন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে

‘ভারত’-এর সেই খবর, এবং তার প্রকৃত তাৎপর্য, আলোকিত ‘ইন্ডিয়া’র রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে পৌঁছচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন এখন অপরিহার্য।

society

—প্রতীকী ছবি।

অর্ণব সাহা
শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:০৬
Share: Save:

উত্তরপ্রদেশের গ্রাম, মফস্‌সল, ছোট শহরের অজস্র কবিসভায় ঘুরে-ঘুরে তাঁর কবিতা পাঠ করেন কমল আগ্নেয়। ত্রিশের কোঠায় বয়স তাঁর। প্রবল হিন্দুত্ববাদী কবিতা রচনা ও পাঠের কারণে রাজ্য জুড়ে রীতিমতো সেলেব্রিটি। তাঁর গান্ধী-বিদ্বেষী ও গডসের প্রশস্তিবাচক কবিতা শুনে নিজের গলার মালা তাঁর গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন যতি নরসিংহানন্দ— উগ্র হিন্দুত্ববাদের আইকন, ঘৃণাভাষণে সিদ্ধ পুরোহিত। লাভ জেহাদ থেকে সংখ্যালঘুদের অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যাবৃদ্ধি, বাম ইতিহাসবিদদের বয়ানে ধামাচাপা পড়ে থাকা ‘হিন্দুর প্রকৃত ইতিহাস’ তুলে আনার ডাক, দেশদ্রোহীদের আখড়া জেএনইউ-এর মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাগ— হিন্দুত্ববাদের যাবতীয় চালু বয়ানই আছে কমল আগ্নেয়র কবিতায়। তিনি একা নন, ‘বিপন্ন হিন্দু’দের পক্ষে কথা বলে চলেছেন তাঁর মতো বেশ কয়েক জন দেশপ্রেমী কবি। এবং শ্রোতার সোৎসাহ-সমর্থন বুঝিয়ে দিচ্ছে এই কথাগুলো শোনার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত।

সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদের সপক্ষে, হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে তোলার হিড়িক জাগিয়ে তুলতে যেমন গ্রামীণ কবিসভা বসছে, তেমনই ডিজে-সহযোগে চলছে হিন্দুত্ব-পপ বা এইচ-পপ গান, ভাইরাল হওয়া মুসলিম-বিদ্বেষী র‌্যাপ গান; ইউটিউবে ছড়িয়ে দেওয়া ঘৃণার বিষ, প্রকাশ্য হিংসার ইন্ধনকে ক্রমশ আরও সহজ, অতি স্বাভাবিক করে তুলছে। বছর ত্রিশের হরিয়ানভি পপ-তারকা কবি সিংহের গলায় ‘অগর ছুয়া মন্দির তো তুঝে দিখা দেঙ্গে’ যখন নিমেষে ভাইরাল হয়, তখন বোঝা যায় যে, ঘৃণা ও হিংসার এমন এক স্বাভাবিকীকরণ ঘটেছে, যেখানে এই সব অসংগঠিত উদ্যোগ গণসম্মতি উৎপাদন করছে, সংখ্যাগুরুর কৌম আধিপত্যের বয়ান যার ভিত্তি। এই কবি, গায়ক, বক্তারা কেউই কিন্তু কেন্দ্রের প্রধান শাসক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত নন। অথচ এঁরা যে কাজ করে চলেছেন, তা রাজনৈতিক হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডাকেই পুষ্ট করছে প্রতি দিন। ‘ভারত’-এর সেই খবর, এবং তার প্রকৃত তাৎপর্য, আলোকিত ‘ইন্ডিয়া’র রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে পৌঁছচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন এখন অপরিহার্য।

কোনও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হিংসাকে বৈধতা দানের প্রথম শর্ত, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের বিপরীতে এক বা একাধিক কাল্পনিক ‘অপর’ নির্মাণ, যারা সব দিক থেকেই ‘আমাদের’ তুলনায় খারাপ, নিকৃষ্ট ও প্রায় অবমানব। নাৎসি জার্মানি থেকে পল পটের কম্বোডিয়া, বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রোহিঙ্গাদের প্রতি খড়্গহস্ত মায়ানমার, অথবা আমেরিকায় ফের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণ— সর্বত্র এই চেষ্টার উদাহরণ প্রকট। ‘অপর’-কে এক বার অবমানব প্রতিপন্ন করতে পারলে তার প্রতি যে কোনও নিষ্ঠুরতার বৈধতা অর্জন করা অনেক সহজ হয়। তাদের বিরুদ্ধে হিংসা ‘স্বাভাবিক’ হয়। হিংসার এই ক্রমাগত স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া ক্ষমতার প্রতি অন্ধ আনুগত্যের বাস্তব পরিস্থিতি তৈরিতে কী ভাবে সাহায্য করে, তার বহু উদাহরণ গবেষকরা পেশ করেছেন কার্যত দুনিয়ার সব প্রান্ত থেকেই।বহু লক্ষ মানুষকে হত্যা, কোটি মানুষের রুজিরুটি কেড়ে নেওয়া, তাঁদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা— মানুষের প্রতি মানুষের অকল্পনীয় সব অত্যাচারের সাক্ষী থেকেছে পৃথিবী। সেই অত্যাচার করতে পেরেছে মানুষ, কারণ রাজনীতি আর সমাজ মিলে সেই অভাবনীয় হিংস্রতাকে ‘স্বাভাবিক’ করে তুলেছিল। ভারতের গো-বলয়ের সদর-মফস্‌সলে জনসংস্কৃতির মোড়কে যে ঘটনা ঘটে চলেছে, তার আসল বিপদ এখানেই নিহিত।

হিংস্রতার এই উন্মুক্ত প্রদর্শন কী ভাবে একই সঙ্গে আইন-বহির্ভূত বিচারদান সম্পর্কে গণসম্মতির জোগান দেয় এবং সংখ্যালঘুকে কোণঠাসা হতে বাধ্য করে, তার প্রমাণ বিগত কয়েক বছরের উত্তরপ্রদেশে একাধিক। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নাম সেখানে হয়েছে ‘বুলডোজ়ার বাবা’। তিনি ভোট প্রচারে বেরোচ্ছেন হাফ-ডজন বুলডোজ়ার সঙ্গে নিয়ে, ইচ্ছেমতো গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন গোত্রের ‘অপরাধী’র বাড়ি— যাঁদের মধ্যে কেউ সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের শরিক, কারও নামে আবার উত্তরপ্রদেশের পুলিশের সমন রয়েছে। বুলডোজ়ার হয়ে উঠছে ন্যায়শাসনের প্রতীক। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মাও সে পথে হেঁটে এখন পরিচিত হয়েছেন ‘বুলডোজ়ার মামা’ নামে। আশ্চর্যের কথা, অথবা একান্তই আশ্চর্যের নয় যে, এঁদের ভারতীয় জনসাধারণ চিনেছে সুশাসনের প্রতিভূ হিসাবে, যাঁরা আইন-আদালতের ঊর্ধ্বে— প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘসূত্রতার তোয়াক্কা না করে যাঁরা ন্যায়বিচারপ্রদান করেন।

এই তাৎক্ষণিক শাস্তিবিধানের পদ্ধতি তখনই জনপ্রিয় হয়, যখন তার অন্যায়কে চিহ্নিত করার মতো, তাকে প্রশ্ন করার মতো পরিসর জনজীবন থেকে ক্রমশ অবলুপ্ত হয়ে যায়। যখন শাসকের একচেটিয়া হিংসাকে এমন স্বতঃস্ফূর্ত উপায়ে বৈধতা দান করা হয়, যা গোটা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার বৃহৎ অংশের মনে নৈতিকতা-অনৈতিকতার সাধারণ বোধকে মুছে ফেলে। কী ভাবে রাজনীতির ভাষণ, প্রশাসনের পেশিশক্তি আর জনসংস্কৃতির পরিসরকে ব্যবহার করে সেই সম্মতি নির্মাণ করা যায়, কী ভাবে অন্যায়কে বৈধ করে তুলতে হয়, উত্তরপ্রদেশ সে পথ দেখাচ্ছে। আরও দুশ্চিন্তার যে, গোটা দেশ সেই পথ অনুসরণে নির্দ্বিধ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Society Politics Violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE