Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
ভোটের আগে বিরোধীদের জন্য ফাঁদ পাতার চেষ্টায় বিজেপি
Politics

ধর্ম-কাঁটায় গণতন্ত্র

বঙ্গভূমে অবশ্য এই রকম আবেগ কোনও দিনই খুব তীব্র এবং সর্বজনীন হয়নি। এখনও যা হচ্ছে, তার বেশিটাই রাজনীতির দৌলতে।

পাল্টা: সংহতি মিছিলের পুরোভাগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ২২ জানুয়ারি।

পাল্টা: সংহতি মিছিলের পুরোভাগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ২২ জানুয়ারি। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:২৫
Share: Save:

বলেছিলেন তাঁরা, “মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে।” সেই কার্য সম্পন্ন হল। ‘তিনি’ চেয়েছিলেন, এ-কালের ‘অযোধ্যা-কাণ্ড’ রচিত হবে একা তাঁরই হাতে। সেটাও করে ছাড়লেন। দেড়শো কোটির দেশে সমারোহের এই মহাপ্লাবনে কত কোটি ভেসে গেলেন, গুনে বলা শক্ত। ভাসতে ভাসতে তার কত অংশ ভোটকেন্দ্রের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন, তা বুঝতে বেশি দেরি হবে না। তবে আপাতত বলতেই হবে, বিজেপি ‘রাম’ নামে হিন্দুদের অনেকের মধ্যে একটা ধর্মীয় আবেগ চাগিয়ে দিতে পারল।

বঙ্গভূমে অবশ্য এই রকম আবেগ কোনও দিনই খুব তীব্র এবং সর্বজনীন হয়নি। এখনও যা হচ্ছে, তার বেশিটাই রাজনীতির দৌলতে। এটাও দৃশ্যমান যে, ধর্মাচারী বাঙালির ঘরে ঠাকুরের আসনে চিরাচরিত দেবদেবীদের সঙ্গে রামায়ণের রামচন্দ্র এখনও সর্বত্র বিরাজমান নন। তুলনায় ‘রামভক্ত’ হনুমানের টিআরপি বেশি! হনুমান মন্দিরের সংখ্যাধিক্য এবং কিছুকাল যাবৎ সেখানে বাঙালি ভক্তদের ভিড় তার প্রমাণ। কারণ যা-ই হোক।

তবু ‘রাম’ বঙ্গজীবনেরও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্রের কাহিনি শুনতে শুনতে বড় হয়ে ওঠার “সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।” এই যুগের বালক-বালিকারাও বাংলায় বা ইংরেজিতে সংক্ষেপিত রামায়ণের পাঠক। তাই রাম তাদেরও অজানা নন। আবার ‘রাম’ শব্দটি আমাদের দৈনন্দিনতাতেও জড়িয়ে। যেমন, আমরা রামধাক্কা দিয়ে দূর করে দিই। রামচিমটিতে গায়ের ঝাল মেটাই। প্রবল ঘৃণা বা নিন্দার প্রকাশে বলি রাম-রাম। এমনকি, নিধন যজ্ঞেও হাতে থাকে রাম-দা। আসলে যা কিছু ‘বিগ সাইজ়’ তার সঙ্গে অনেক সময় ‘রাম’ শব্দটি যুক্ত করে আমরা তার গুরুত্ব বাড়াই।

তাই তিনি বাঙালির ঠাকুরঘরে ‘দেবতা’ কি না, তার চেয়ে বড় সত্য হল, রাম সর্ব ক্ষণ ‘কাছের’। সেই রঘুপতি রামের মন্দির প্রতিষ্ঠায় নীতিগত আপত্তি থাকার কথাই নয়। কিন্তু বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের উদ্যোগে ব্যাপারটি প্রথম থেকেই ধর্মের ভিত্তিতে ভোট ভাগাভাগির হাতিয়ার হিসাবে চিহ্নিত হয়ে উঠেছে বলে ছবি অন্য রকম হতে পারল না। এখন আবার ভোটের মুখে সুকৌশলে বিরুদ্ধ শক্তিদেরও তারা ওই ‘ধর্মের ফাঁদ’-এ জড়িয়ে নিল। ফলে, বাকি সব ছেড়ে রাম-রাজনীতিই এসে পড়ছে মঞ্চের কেন্দ্রে। পক্ষে ও বিপক্ষে।

তবে কি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে এ বার গণতন্ত্রের পরীক্ষা হবে শুধুই ধর্মের দাঁড়িপাল্লায়! সবাই বুঝি, বিজেপি প্রাণপণ সেটাই চায়। কারণ, তাদের বিচারে দেশে হিন্দু-ভোটের সংখ্যাধিক্য এ ক্ষেত্রে মস্ত সুবিধার। আর এই পথ ধরে ধর্মীয় বিভাজনের বিষয়টি যত প্রাধান্য পেতে থাকবে, বিজেপি সরকারের অন্যান্য ব্যর্থতা, অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ ও অপকীর্তির দিকগুলি ততই ঢাকা পড়তে থাকবে। ‘বিপত্তারণ’ রাম!

কংগ্রেস-সহ প্রধান বিরোধী দলগুলি অযোধ্যার অনুষ্ঠান বর্জন করার অনুষঙ্গে প্রত্যাশিত ভাবেই ‘সঙ্ঘ-নিয়ন্ত্রিত’ বিজেপির ‘হিন্দুত্ববাদী’ রাজনীতিকে মূল নিশানা করে তুলছে। রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অখিলেশ যাদব, এম কে স্ট্যালিন প্রমুখ সবার এক মত। অযোধ্যা-উৎসবের দিনে কলকাতার রাজপথে মমতার ‘সংহতি মিছিল’ এবং রাজ্য জুড়ে সেই কর্মসূচি পালন বাংলায় তৃণমূলের নির্বাচনী প্রচারের সুর অনেকটা সেই ভাবেই বেঁধে দিল।

মমতা মিছিল শুরু করেছেন কালীঘাট মন্দির ঘুরে। শেষ করেছেন পার্ক সার্কাসের মসজিদে। মাঝখানে ছুঁয়ে গিয়েছেন গুরুদ্বার এবং গির্জা। বার্তা পরিষ্কার। বস্তুত এটি বরাবরই তাঁর ঘোষিত অবস্থান এবং এই ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট ‘সচেতন’। তাঁর বিরুদ্ধে ‘হিন্দু-বিরোধী’ প্রচার চালাতে গিয়ে বিজেপিও হালে পানি পায়নি। মমতা দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো বন্ধ করতে চান বলে জিগির তোলার পরে আখেরে বিজেপির নিজের মুখ পুড়েছে।

কিন্তু এটাই তো শেষ কথা নয়। গণতন্ত্রে যদি ধর্মের কাঁটা বিঁধতে থাকে, দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতায় মেরুকরণের রাজনীতি সত্যিই যদি দেশে ভোটের চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে, ‘সংহতি’র প্রকৃত অগ্নিপরীক্ষা হয় তখনই। সেই সংহতি অবশ্যই রাজনৈতিক। তাই অযোধ্যা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করার অবকাশ রয়েছে।

অনুমান করা যায়, বিজেপি নির্দিষ্ট সময়েই ভোট করতে চাইবে। বিশেষত রামলালা-কে অযোধ্যার মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করার পরে এটা আরও স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে বাজেট অধিবেশন হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারির শেষ বা মার্চের গোড়ায় ভোটের দিন ঘোষণা অসম্ভব নয়। তা হলে হাতে সময় থাকছে এক-দেড় মাস।

প্রশ্ন হল, বিরোধী শিবির কতটা ‘সংহত’ হতে পারল? আরও সঠিক ভাবে বললে, বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোট আদৌ সংহতির পথে এগোচ্ছে কি? জানুয়ারির শেষে দাঁড়িয়েও এর উত্তরে খুব আশাব্যঞ্জক কিছু বলার জায়গা নেই। তার একটি বড় কারণ হল, জোটের প্রধান শরিক কংগ্রেসের দিক থেকে আসন-আলোচনায় প্রয়োজনীয় তৎপরতার অভাব বা কালক্ষেপ। জোট কোথায় কী ভাবে হবে, না-হবে, পরের কথা, কিন্তু ন্যূনতম উদ্যোগটুকু আছে কি? শরিকেরা অনেকেই দ্রুত আসন-আলোচনার কথা বলে এসেছিল। বিশেষ ফল হয়নি।

কেন কংগ্রেস এটা করছে, জানা নেই। তবে জোট গড়ার জন্য বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক দলগুলি কংগ্রেসের দরজায় হত্যে দিয়ে অপেক্ষায় বসে থাকবে, ভাবলে আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেটা হয়তো অধিক চাওয়া হবে। এই অবস্থায় বড় শরিকেরা নিজেদের মতো ভাবতে শুরু করে দিয়েছে, এমনটাই খবর। উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, বিহারে তেজস্বী যাদব কারও সঙ্গেই তো কংগ্রেসের আসন-আলোচনার গতি এখনও পর্যন্ত মসৃণ নয়। সম্প্রতি তামিলনাড়ুতে ডিএমকে নেতা স্ট্যালিন চল্লিশটি লোকসভা আসনেই লড়ার প্রস্তুতি রাখতে বলেছেন। কোথায় কী হবে, ‘রামচন্দ্র’ জানেন!

এই রাজ্যের জোট-চিত্র আরও বিচিত্র। ভোট যত এগোচ্ছে, তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের রাজনৈতিক দূরত্বও তত যেন নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। উত্তরবঙ্গ দিয়ে রাহুলের এই পর্বের যাত্রায় তৃণমূলের যোগ না দেওয়াও বেশ অর্থবহ। আমরা জানি, তৃণমূলের সঙ্গে রফা না করার সিদ্ধান্তে রাজ্য কংগ্রেস এখনও অনড়। এটাও জানা গিয়েছে, আদৌ রফার আলোচনা হলে তৃণমূল নেত্রী কংগ্রেসকে তাদের গত বার জেতা দু’টি আসনের বেশি দিতে প্রস্তুত নন।

বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এই রকম শর্ত গ্রহণযোগ্য কি না, সেই প্রশ্ন সঙ্গত। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, কংগ্রেস ঝেড়ে কাশছে না কেন? রাজ্য কংগ্রেসকে ডেকে দলের হাই কম্যান্ড আলোচনা করার পরে প্রায় মাসখানেক হতে চলল। এখনও কি তারা মনস্থির করতে পারল না! অসমে দাঁড়িয়ে রাহুল তাঁদের সঙ্গে মমতার ‘সুসম্পর্ক’-এর কথা শোনাচ্ছেন, আর কোচবিহারে তাঁর ‘ন্যায় যাত্রা’র ফ্লেক্স ছেঁড়া নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে থানায় গিয়েছে কংগ্রেস। এই ধাঁধারই বা উত্তর কী?

গত কয়েক দিনে একাধিক দলীয় বৈঠকে মমতা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাঁরা বিয়াল্লিশটি আসনেই প্রার্থী দেওয়ার পথে। তবু যদি ধরে নেওয়া হয়, কংগ্রেস এবং তৃণমূলের মধ্যে কোনও রফাসূত্র হল, তাতেও কি ‘শেষ রক্ষা’ হবে? কারণ, বাংলায় সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের বন্ধন এখন প্রায় অটুট! জাতীয় স্তরে রাহুলের সঙ্গে সীতারাম ইয়েচুরির সম্পর্কও যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ। তর্কের খাতিরে তবু না হয় কয়েকটি আসনে কংগ্রেস ও তৃণমূলের বোঝাপড়া মানা গেল। তখন বাদবাকি আসনগুলিতে সিপিএম এবং তার সঙ্গী কংগ্রেস কী করবে, সেই অনিশ্চয়তাও কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

এক-একটি রাজ্যে এমনই এক-এক রকম পরিস্থিতি মিলিয়ে তাই সংশয় জাগে। অযোধ্যা-পরবর্তী ভোটে ধর্মীয় মেরুকরণ মাথাচাড়া দিলে ছন্নছাড়া হয়ে থাকা বিরোধী শিবিরও কিন্তু তার দায় ঝেড়ে ফেলতে পারবে না। পারস্পরিক দোষারোপ তখন হবে অজুহাতমাত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Democracy Religion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE