Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
Wild Life

World Elephant Day: ‘ভবিষ্যৎ’ উজ্জ্বল নয়, উন্নয়নের চাপে দিগ‌্ভ্রান্ত গজরাজরা

গজদন্তের মহার্ঘতা স্বাধীন ভারতে হাতির অন্যতম বিপদ

ফাইল চিত্র

সায়ন ত্রিপাঠী
সায়ন ত্রিপাঠী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২১ ১৮:১৫
Share: Save:

আলতামিরার বাইসনের মতো প্রচারের আলো পড়েনি তার উপর। কিন্তু মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকায় প্রাচীন গুহাচিত্রের সেই হাতি ঐতিহাসিক গুরুত্বের নিরিখে পিছিয়ে নেই মোটেই। প্রায় ৫০০০ হাজার বছরের পুরনো ওই গুহাচিত্র প্রমাণ দিচ্ছে, সে সময়ই হাতির পিঠে সওয়ার হওয়ার কৌশল জেনে গিয়েছে মানুষ। অজন্তার গুহাচিত্রে হাতির আবির্ভাব আরও কয়েক হাজার বছর পরে। তত দিনে ভারতে রাজ-বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে হাতি।

সভ্যতার গোড়া থেকেই এ দেশে তিন-চারটি প্রাণীর সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে একটি হল হাতি। সেই অর্থে আমাদের সঙ্গে হাতির আত্মীয়তার ঐতিহ্যও প্রাগৈতিহাসিক। রাজরাজড়া থেকে আম আদমি, হাতিকে নিয়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ভাবাবেগের নির্দশন রয়েছে যুগে যুগে। রয়েছে নানা লোককথা। কুরুক্ষেত্র থেকে পানীপতের যুদ্ধ, মৌর্য যুগ থেকে মুঘল শাসন, হাতির গুরুত্ব আর ভূমিকার বর্ণনা রয়েছে ভুরিভুরি।

বুনো হাতিদের বশে আনার ইতিহাসের সূচনাও ভারতেই। প্রসঙ্গত, ভারত-সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাওয়া হাতির প্রজাতিটিই মানুষের পোষ্য। আফ্রিকার হাতিকে কোনও দিনই বশে আনা সম্ভব হয়নি মানুষের পক্ষে। যদিও আফ্রিকার নানা প্রাচীন গুহাচিত্রে বন্য হস্তীর উপস্থিতি দেখা গিয়েছে।

ভীমবেটকার গুহাচিত্রে হাতিতে সওয়ার মানুষ।

ভীমবেটকার গুহাচিত্রে হাতিতে সওয়ার মানুষ।

অনেক ঐতিহাসিক বলেন, গ্রিক বীর আলেকজন্ডার নাকি নন্দ সম্রাটের বিশাল রণহস্তী বাহিনীর কথা জানতে পেরে মগধ আক্রমণের পরিকল্পনায় ইতি টেনেছিলেন। পরবর্তী মগধ সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জমানায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের নির্দেশিকা মেনে হাতিদের পোষ মানানো, পরিচর্যা এবং রাজকার্যে ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রায় সমসাময়িক কালে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গম রাজত্বে বুনো হাতি ধরা, বশ করা এবং দেহগত বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে আলাদা আলাদা কাজে ব্যবহারের বিধি রচিত হয়েছিল তামিল ভাষায়। দাক্ষিণাত্যের পল্লব, হোয়সালা এবং কলিঙ্গ রাজাদের তৈরি নানা স্থাপত্যে প্রায় অপরিহার্য হয়ে গিয়েছিল হাতির প্রতিকৃতি।

মুঘল সম্রাট আকবরের হস্তী-প্রীতির কথা লিখে গিয়েছে আবুল ফজল। শিকার যাত্রা এবং যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ৩০ হাজারের বেশি হাতি ছিল আকবরের। তাঁর ছেলে জাহাঙ্গিরের আমলে হাতিশালার আবাসিকের সংখ্যা বেড়ে নাকি লাখ ছুঁয়েছিল। পাশাপাশি, সুবাদার, মনসবদার, আমত্য এমন কী, জায়গিরদারেরাও সামাজিক প্রতিপত্তি দেখাতে হাতি পুষতেন। ব্রিটিশ জমানার রাজা-জমিদারদের মধ্যেও ছিল সেই চল। শিকারের পাশাপাশি জঙ্গলে কাটা গাছের গুঁড়ি টেনে আনতে ব্যবহার করা হত হাতি। এখন শিকার বন্ধ হলেও উত্তর ভারতের কিছু বনেদি পরিবারের মধ্যে সেই চল রয়েছে। পাশাপাশি, দক্ষিণ ভারতের নানা ধর্মস্থানে উৎসবের জাঁকজমক বাড়ানোর অন্যতম অংশ হাতি।

বহু বছর ধরে নির্বিচারে হাতি ধরার ফলে এক সময় প্রাকৃতিক পরিবেশে তার সংখ্যা কমে এসেছিল ভয়াবহ ভাবে। স্বাধীনতার কিছুকাল পরে বন্যপ্রাণ বিশারদ ইপিজি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, অচিরেই ভারতে বুনো হাতির সংখ্যা ১০ হাজারের নীচে চলে যাবে। পাশাপাশি, গজদন্তের জন্য চোরাশিকার এবং প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংসকেও হাতির সংখ্যা কমার জন্য দায়ী করেছিলেন তিনি।

গজদন্তের মহার্ঘতা স্বাধীন ভারতে হাতির অন্যতম বিপদ। পশ্চিমঘাটের জঙ্গলদস্যু বীরাপ্পন থেকে অসমের জঙ্গিগোষ্ঠী আলফার নেতা পরেশ বড়ুয়া, অস্ত্র আর রসদ জোগাড়ের জন্য হাতির দাঁতের চোরাচালানে পিছপা হননি কেউই। সেই সঙ্গে রয়েছে দ্রুতগতিতে বনভূমি ধ্বংসের বিপদ। মুঘল জমানায় মধ্যভারত, গুজরাত, অওধ অঞ্চলে বুনো হাতির উপস্থিতির কথা জানা গেলেও এখন ওই সব এলাকায় তারা অনুপস্থিত। বাসস্থানের চরম সঙ্কটে পড়া ভারতীয় হস্তীকুল এখন গোটা ১৫ রাজ্যের বিচ্ছিন্ন অরণ্যভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছে। জনবসতি ও কৃষিজমির সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন, খননকার্য, রেললাইন তৈরির মতো উন্নয়নের কোপে নষ্ট হচ্ছে হাতি চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ পথ অর্থাৎ করিডোরগুলি। ফলে বাস্তুচ্যুত হাতির দল খাবারের সন্ধানে হানা দিচ্ছে লোকালয়ে। বাড়ছে হাতি-মানুষ সঙ্ঘাত। প্রাণহানি ঘটছে দু’তরফেই।

দক্ষিণবঙ্গের হাতিদের বড় অংশই আদতে দলমা থেকে আসা পরিযায়ী।

দক্ষিণবঙ্গের হাতিদের বড় অংশই আদতে দলমা থেকে আসা পরিযায়ী। ফাইল ছবি

রয়েছে আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল সমস্যার সম্ভাবনাও। ছোট ছোট অরণ্যখণ্ডে আটকে পড়ে হাতিদের মধ্যে অন্তঃপ্রজননের ফলে জিনঘটিত অবক্ষয়ের আশঙ্কা প্রবল। জিনগত ভাবে দুর্বল বংশধরেরা ভবিষ্যতে আদৌ প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান বন্যপ্রাণ গবেষকদের অনেকেই।

২০১০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার হাতিকে ‘জাতীয় ঐতিহ্যবাহী প্রাণী’ ঘোষণার পরে বন্যপ্রাণপ্রেমী সংগঠনগুলির তরফে দ্রুত করিডোরগুলি পুনরুদ্ধারের দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু গত এক দশকে কাজ তেমন এগোয়নি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং উন্নয়নের চাপে সেগুলি হাতিদের পরিযাণের পুরনো পথগুলি ক্রমাগত সংকীর্ণ এমনকি, ক্ষেত্রবিশেষে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিশ্ব হস্তী দিবসের দিন নতুন করে সামনে এসেছে এই প্রশ্ন। প্রসঙ্গত, ৫ জুনের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মতো এখনও রাষ্ট্রপুঞ্জের তকমা মেলেনি ১২ অগস্টের। তবে হাতি সংরক্ষণ এবং গবেষণার কাজে যুক্ত নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ২০১২ সাল থেকে এই দিনটিকে বিশ্ব হস্তী দিবস হিসেবে পালন করে।

মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে হাতির সংখ্যা ২৫ হাজারের কিছু বেশি। তাদের উপস্থিতি চারটি ভৌগলিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। ১. উত্তর ভারত- উত্তরাখণ্ডের দেহরাদূন, নৈনিতাল এবং নেপাল লাগোয়া তরাই উত্তরপ্রদেশের কিছু অংশ। ২. দাক্ষিণাত্য: পশ্চিমঘাট ও পূর্বঘাট ঘেরা দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির পাশাপাশি ছত্তীসগঢ় এবং মহারাষ্ট্রের সামান্য কিছু এলাকা। ৩. পূর্ব ভারত- ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং দক্ষিণবঙ্গ। ৪. উত্তর-পূর্ব ভারত- কয়েকটি বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত এই এলাকায় হাতির দলগুলির একাংশ প্রতিবেশী মায়ানমার এবং বাংলাদেশে যাতায়াত করে।

এ ছাড়া আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কিছু অংশে হাতি রয়েছে। যদিও তারা পরম্পরাগত ভাবে ‘বুনো’ নয়। ব্রিটিশ আমলে জঙ্গলে কাটা গাছের গুঁড়ি টেনে আনার জন্য তাদের আনা হয়েছিল। সেই কাজ বন্ধ হওয়ার পরে ঠিকাদারেরা ফেলে রেখে যায় হাতিগুলিকে। এখন তারা সংখ্যায় বেড়ে চলেছে।

পশ্চিমবঙ্গের হাতিরা আঞ্চলিক ভাবে দু’টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এর অধিকাংশই রয়েছে উত্তরবঙ্গে। মেচি থেকে সঙ্কোশ নদী পর্যন্ত দু’শো কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৩,০০০ কিলোমিটার বনাঞ্চলে। সংখ্যায় তারা প্রায় সাড়ে পাঁচশো। রাজ্যে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আন্দোলনের পরিচিত মুখ অনিমেশ বসুর মতে, সারা ভারতের নিরিখে হাতির সংখ্যা কম হলেও এ রাজ্যে হাতি-মানুষ সঙ্ঘাতের ঘটনা অনেক বেশি। তার মধ্যে পূর্ব ডুয়ার্সে তোর্সা নদীর পূর্বে বক্সা ব্যাঘ্রপ্রকল্পের হাতিদের অবস্থা তুলনামূলক ভাল। তোর্সা এবং তিস্তার মধ্যবর্তী এলাকায় হাতিদের করিডোরগুলিতে একের পর এক গ্রাম, চা বাগান, কৃষিজমি গড়ে উঠেছে। অতীতে এই অঞ্চলের হাতিরা মেচি নদী পার হয়ে খাদ্যের সন্ধানে নেপালের জঙ্গলে যেত। কিন্তু সম্প্রতি ‘ভারতীয় হাতি’ দেখলেই অনুপ্রবেশকারী ঠাওরাচ্ছে নেপাল পুলিশ। তাদের গুলিতে গজরাজের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে দিগ্ভ্রান্ত হাতিরা চলে আসছে লোকালয়ে। মানুষের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। বিষ, বিদ্যুতের বেড়া আর ডুয়ার্স চিরে ছুটে যাওয়া রেলের চাকায় মৃত্যু হচ্ছে হাতিরও।

দক্ষিণবঙ্গের হাতিদের বড় অংশই আদতে দলমা থেকে আসা পরিযায়ী। যদিও পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার জঙ্গল লাগোয়া কৃষিজমিতে খাবার সহজলভ্য বলে এখন বছরের অধিকাংশ সময়ই তারা এ রাজ্যে থেকে যায়। পাশাপাশি রয়েছে কিছু স্থায়ী বাসিন্দাও। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি দু’শোর কিছু বেশি।

সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বাংলা তথা ভারতের হাতিদের ‘ভবিষ্যৎ’ উজ্জ্বল নয় মোটেই। আসলে জাতক, পঞ্চতন্ত্রের মতো প্রাচীন লোককথায় হাতিদের বাঁচানোর বার্তা থাকলেই আধুনিকতার ঢেউয়ে সে সব ‘কু(?)সংস্কার’ ধুয়ে গিয়েছে অনেকদিনই। আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সভাঘরে ‘ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট’, ‘ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স’, ‘এলিফ্যান্ট কনজারভেশন’-এর পোস্টার সাঁটা সেমিনারেও ফল মিলছে না। কাজ হচ্ছে না, প্রশাসনিক যন্ত্র ব্যবহার করে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন কার্যকরের চেষ্টাতেও।

ইতিহাস বলে, স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা না থাকলে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগই স্থায়ী সাফল্য পেতে পারে না। বিশ্ব হস্তী দিবসের দিনে ভারতে ‘প্রজেক্ট এলিফ্যান্ট’ কর্মসূচি সফল করার জন্য একটু অন্য ভাবে ভাবার সময় বোধহয় এসেছে। কাজটা কঠিন বইকি।

অন্য বিষয়গুলি:

Wild Life elephant digital essay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE