জলদান বড় পুণ্যির কর্ম” বললেন এক সরকারি আধিকারিক। জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগ (পিএইচই) গ্রামের ঘরে ঘরে পাইপ-বাহিত পানীয় জল পৌঁছে দিচ্ছে। তার কর্তারা যদি সে কাজে চাকরি-রক্ষার চাইতেও বড় তাৎপর্য খুঁজে পান, রাজ্যবাসীর তাতে আশ্বস্ত হওয়ারই কথা। কিন্তু গ্রামে দাঁড়ালে কী দেখা যায়?
বীরভূমের ‘প্রান্তিক’ স্টেশন থেকে যেতে হয় শাওড়াপুর গ্রামে। আর একটু এগোলেই তারাশঙ্করের উপন্যাসের হাঁসুলিবাঁক। গ্রামে কল পৌঁছে গিয়েছে, তবে জল নেই। আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড-মুক্ত পানীয় জল মিলবে ঘরে ঘরে, সেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হয়েছে কেন্দ্রের ‘জলজীবন মিশন,’ এ রাজ্যে যার পরিচয় ‘জলস্বপ্ন’। মাটির তলার জলে আয়রন ও আর্সেনিক মুক্ত করার পরিকাঠামো থাকলেও, ফ্লোরাইড মুক্ত করার পরিকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি। যেখানে জলে ফ্লোরাইড আছে, সেখানে নল বেয়ে বিপদ আসছে বাড়িতে।
ভূগর্ভের জলে দূষণ থাকলে ভূপৃষ্ঠের জল, অর্থাৎ নদী বা ড্যামের জল পরিস্রুত করে পৌঁছে দেওয়ার কথা হয়েছে এই প্রকল্পে। সেই ছবিও আশ্বস্ত করে না। শাওড়াপুর গ্রামের পাশ দিয়ে কোপাই নদী বয়ে গিয়েছে। নদীর বুকে চেক ড্যাম দিয়ে জল ধরার ব্যবস্থা আছে। নদী থেকে চাষের জল যায়, সারা বছর নদীতে জল থাকে না। নদীতে সারা বছর যাতে জল থাকে, তার পথ খোঁজা প্রয়োজন। নদী অববাহিকার বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়েই তা সম্ভব।
গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে জল পৌঁছে দেওয়ার জন্য পঞ্চায়েতের এগিয়ে আসার কথা ছিল। জলজীবন মিশনের কাজটা ‘পাইলট প্রজেক্ট’ হিসেবে রাজ্যের বেশ কয়েকটা পঞ্চায়েত শুরুও করে। প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল সেই কাজ। এনআরইজিএ প্রকল্পের ‘নির্মাণ সহায়ক’ ছাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে স্থায়ী পদে প্রযুক্তিতে দক্ষ কর্মী নেই। কাজেই পিএইচই দফতরকেই পুরোপুরি দেখাশোনার ভার নিতে হল। সেখানেও পরিকাঠামো দুর্বল, কর্মীর অভাব। কাজেই টেন্ডার ডেকে কাজের বরাত তুলে দিতে হচ্ছে কন্ট্রাক্টরদের হাতে, পরিবার-পিছু তাদের প্রাপ্য তিন হাজার টাকা। বরাত-পাওয়া কন্ট্রাক্টর কাজ শেষ করে মাস ছয়েকের ‘সিকিয়োরিটি পিরিয়ড’ পর্যন্ত দেখাশোনা করছে। তার পর পাইপ লাইনে সমস্যা দেখা দিলে পিএইচই দফতরকেই নামতে হচ্ছে। তখন আবার কর্মীর অভাবে খুঁড়িয়ে চলে কাজ।
পশ্চিমবঙ্গের ২৩ লক্ষ গৃহস্থালিতে এখনও অবধি পাইপ-সংযোগ পৌঁছেছে। কিন্তু বহু বাড়িতে কল গেলেও জল আসেনি। বাঁকুড়া-বীরভূম-মুর্শিদাবাদ-পুরুলিয়াতে এই পরিস্থিতি বার বার চোখে পড়ে। কেন? গ্রামের মানুষদের দাবি, পিএইচই কাজে ফাঁকি দিচ্ছে। পঞ্চায়েত কাজ করছে না। কিন্তু গলদ আসলে অন্যত্র। আগামী তিরিশ বছরের বর্ধিত জনসংখ্যা ও তাদের জলের চাহিদার কথা মাথায় রেখে জল সরবরাহের জন্য ওভারহেড ট্যাঙ্ক তৈরি করার কথা। ট্যাঙ্ক তৈরি করতে দেরির কারণ, জমি জট। এ ছাড়াও সম্পূর্ণ পরিকাঠামো তৈরি করতে অন্তত এক-দেড় বছর সময় লাগে। কাজেই কল যদি বা আসে, জল আসে না। অবশ্য পাইপ সংযোগের লক্ষ্য থেকেও এ রাজ্য দূরে। এ বছর ৩১ মার্চের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল, নতুন লক্ষ্য ধার্য হয়েছে ২০২৪। জেলাগুলির মধ্যে এগিয়ে নদিয়া, সেখানে ৬০-৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
বামফ্রন্ট আমলে ১১৭টি স্কিমের মাধ্যমে পাইপ লাইন দিয়ে জল পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। সেই স্কিমগুলোতে মানুষের আকর্ষণ ছিল না, কারণ স্কিমের মাধ্যমে জল পেতে হলে কিছু অর্থ খরচ করতে হত গ্রাহককে। আর জমি দান করতে হত সরকারকে। বর্তমান প্রকল্পে মানুষের আগ্রহ বেশি, কারণ এখন যিনি জমি দিচ্ছেন, তিনি সরকারের কাছ থেকে জমির উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন। তাঁর পরিবারের এক জন কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে চাকরিতে নিযুক্ত হচ্ছেন, দৈনিক মজুরি ৪০৪ টাকা। গ্রাহক জল পাচ্ছেন বিনামূল্যে। তাই কল না আসায়, বা কল এলেও জল না আসায়, ক্ষোভ বাড়ছে।
পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও প্রকল্পের চিত্র আশাপ্রদ নয়। যেমন, উত্তরাখণ্ড। সেখানে বাড়ি বাড়ি নল গেলেও, এবং প্রকল্প শেষ হয়ে উদ্বোধন হয়ে গেলেও, জল পৌঁছয়নি। বিধানসভা নির্বাচনে জল দেখিয়ে ভোট পাওয়ার কৌশল নিয়েছিল সরকার, তাই তাড়াহুড়ো করে কল বসলেও কাজের কাজ হয়নি। কাজের গুণগত মান নিয়েও স্থানীয়রা খুশি নন। বহু গ্রামে ভিতর পর্যন্ত কল পৌঁছয়নি। বরাদ্দ টাকা নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। ঝাড়খণ্ডের সীমান্ত-লাগোয়া অঞ্চলগুলোতে জল নেই। কল দিয়ে জল আসার প্রশ্নই ওঠে না। বহু রাজ্যে মাটির তলার জলের ব্যবহার এতটা বেড়েছে যে, সেখানে ক্রমবর্ধমান জলের চাহিদা মেটানোর পর্যাপ্ত জলের ভান্ডার মজুত নেই, এমনই বলছেন পরিবেশকর্মীরা। ‘অটল ভূজল যোজনা’-র মাধ্যমে মাটির তলার জলের ভান্ডার সমৃদ্ধ করার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু মধ্য ভারত ও উত্তর ভারতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্রিয় ভাগীদারি অস্বীকার করে পুরো দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনকে দেখতে দেওয়া হল। স্থানীয় মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা, অংশীদারি ব্যবহার না করায় প্রকল্প তার লক্ষ্যপূরণ করতে পারল না।
ঘরে পানীয় জল পৌঁছনোর প্রকল্প তখনই সার্থক হবে, যখন পাইপ সংযোগের পাশাপাশি পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা করতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, সঞ্চিত করে জলের পুনর্ব্যবহার, জলবিভাজিকার উন্নয়ন ও নিবিড় বনসৃজনের পথ নেবে দেশ। দেশের প্রত্যেকটি গ্রামকে জলে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy