Advertisement
২১ মে ২০২৪
CPIM

‘দলিত কমিউনিস্ট পার্টি’ চাই

সেই সঙ্গে এটাকে একটি ঐতিহাসিক ভ্রান্তিকে স্বীকার করার সাহসও বলা যায়। বামফ্রন্ট তার শাসনকালে সম্প্রদায় বা জাতপাতের ভিত্তিতে বড় মাপের হিংসা হতে দেয়নি ঠিকই

আবির দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২১ ০৪:৫৪
Share: Save:

এবারের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। বামপন্থীরা কী করে তার মোকাবিলা করবেন, সেই প্রশ্ন বার বার উঠছে। মনে হয়, যদি একটা ‘দলিত কমিউনিস্ট পার্টি’ তৈরি করা যায়, তা হলেই সবচেয়ে ভাল হয়। বামপন্থীরা মহিলা শাখা চালালেই যেমন সদস্যেরা সব ছেড়ে লিঙ্গবৈষম্যের চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে যান না, যুব শাখা চালালেই যেমন প্রবীণ-বিরোধী হয়ে যান না, শ্রমিক ইউনিয়ন চালালেই যেমন শ্রেণিসর্বস্ব হয়ে যান না, তেমনই দলিতদের নেতৃত্বে এবং তাঁদের স্বার্থে দল তৈরি করাও সঙ্কীর্ণতার পরিচয় নয়। সাম্যময় সমাজ তৈরি করার প্রত্যয়ের পরিচয়।

সেই সঙ্গে এটাকে একটি ঐতিহাসিক ভ্রান্তিকে স্বীকার করার সাহসও বলা যায়। বামফ্রন্ট তার শাসনকালে সম্প্রদায় বা জাতপাতের ভিত্তিতে বড় মাপের হিংসা হতে দেয়নি ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশীদারি, জনপরিসরে যোগদান, এমনকি ধর্মীয় বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রেও সে সব চাপা দিয়ে রেখেছিল। দলিতদের সংসারের অভাব মোচনের পথও তৈরি করে দেয়নি। কেবল টিকে থাকতে দেওয়ার শর্তে ষোলো আনা আনুগত্য আদায়ে বিশ্বাস করত সিপিএম। সাহিত্যে, নাটকে দলিতদের আত্মপ্রকাশ, এমনকি ‘দলিত’ শব্দটিকেও গ্রাহ্যতার সীমারেখার বাইরে ঠেলে রেখেছিল তারা। পশ্চিমবঙ্গে দলিতরা গণহত্যার শিকার হয়েছেন— এ কথা বামফ্রন্ট আজও স্বীকার করে না। আইনগত তদন্তের কথা বাদই দিলাম, বামফ্রন্ট সত্য নির্ণয় এবং বিচার প্রক্রিয়ার উদ্যোগেও অসম্মত। দলিতরা অনেকেই দেশভাগের সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসার পর ক্লান্তিকর, গ্লানিকর লড়াইয়ের পথ হেঁটে, মরিচঝাঁপির মতো বিপর্যয় পার হয়ে বেঁচে রয়েছেন। কেউ কেউ ন্যূনতম স্বস্তির জায়গায় পৌঁছেছেন ঠিকই, কিন্তু নিজের দলিত পরিচয়কে তুলে ধরে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পাননি। ভারতের অন্যত্র দলিতদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের শক্তি দেখে বাঙালি দলিতদের হতাশা আরও গভীর হয়ে ওঠে।

দলিতদের ইতিহাসে কমিউনিস্টদের সঙ্গে সহযোগিতার অভিজ্ঞতা রয়েছে, যেখানে কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে বিশ্বাসভঙ্গের স্মৃতিও। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী আন্দোলনে সবর্ণ হিন্দুপ্রধান নেতৃত্বের অতিরিক্ত আত্মতৃপ্তির ফলে দলিতরা বাম মহলেই নিগৃহীত বোধ করেছেন। এই সমস্যা সবিস্তারে তুলে ধরা হয়েছে একাধিক বিশ্লেষণে— সৌগত বিশ্বাসের নাইন ডেকেডস অব মার্ক্সিজ়ম ইন দ্য ল্যান্ড অব ব্রাহ্মিনিজ়ম উল্লেখযোগ্য। বাম জমানায় দলিতদের এই তীব্র ক্ষোভ জমে ওঠার সমস্যা শনাক্ত করতে পারলে, পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়ার সূত্র সেখান থেকেই উঠে আসতে পারে। আত্মতৃপ্তি বিসর্জন দিয়ে বামপন্থী নেতারা এমন যৌথ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের উদ্যোগে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে পারেন দলিতদের, যাতে তাঁরা কেবল ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঘুঁটি না হয়ে থাকেন। যে বিপুল, বহুমাত্রিক বৈষম্য নিয়ে দলিতরা বেঁচে রয়েছেন, কেবল অনুদান বা সরকারি সুযোগ-সুবিধে দিয়ে তার নিরসন সম্ভব নয়। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনায় যে ধরনের বদল চাই, তাকেই বরাবর লক্ষ্য বলে মেনে এসেছে কমিউনিস্টরাই।

যদি সোজাসুজি একটা দলিত কমিউনিস্ট দল তৈরি করা হয়, যেখানে নেতা আর ক্যাডাররা সকলেই দলিত, যাঁদের কাজ হবে বিভিন্ন তফসিলি জাতির সবাইকে এক পতাকার নীচে আনা, তাদের আর্থিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদার জন্য লড়াই করা— সে চেষ্টার সঙ্গে বামপন্থী দলগুলোর নির্বাচনী চিন্তা রীতির নীতিগত বিরোধ থাকার কথা নয়। তাই কমিউনিস্ট দলগুলোর উচিত নিজেদের দলীয় সম্পত্তির অন্তর্গত ছাপাখানার মতো কিছু সম্পদ তুলে দেওয়া এই নবগঠিত দলিত কমিউনিস্ট পার্টির হাতেও, প্রয়োজনে অর্থসাহায্যও করা। এবং, সেই সব সহায়তা সত্ত্বেও স্বতন্ত্র পরিচালনায় হস্তক্ষেপ না করা। দেখতে হবে, টাকাকড়ি বা জিনিসপত্র দিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও নতুন পার্টি যেন কারও হাতের পুতুল না হয়ে থাকে। দলিত কমিউনিস্ট পার্টিকে সাহায্য করে যেতে হবে, যত দিন না তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। সাম্যবাদকে যদি আবার পথে নামতে হয়, তা হলে তাকে হতে হবে দলিত সাম্যবাদ।

‘বদল চাই’ কথাটা এখন প্রায় স্লোগান হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ‘বদল’ কেবল শাসক দলে বদল নয়; দলের মধ্যেও স্রেফ নির্বাচনী রণনীতি, দলনেতা, প্রার্থী তালিকা, কর্মসূচি বা ইস্তাহার পাল্টানো নয়। কারা কাদের হয়ে লড়ছে— এই মূল জায়গাটাকেই বদলাতে হবে। যে রক্তমাংসে এই সাম্যবাদ তৈরি, যে রক্তমাংস নিজের অস্তিত্বের লড়াই লড়তে থাকে, তাকে দমিয়ে না রেখে, পিছনে না ঠেলে, এগিয়ে রাখতে হবে। বামপন্থীদের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কৃতিত্ব অর্জনের গৌরবময় স্মৃতি রয়েছে। তথাকথিত ভদ্রসমাজের একটা অংশ বাম মনোভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও এ বার বামফ্রন্টকে ভোটটা দেননি। অতএব, এ বার বামফ্রন্টকেই ঠিক করতে হবে যে, তারা ঠিক কোনটা চায়— বাম বেশ ধারণ করে গোটা বঙ্গসমাজের উপর ছড়ি ঘোরাতে; না কি পশ্চিমবঙ্গে এমন সাম্যবাদ, যার উপর উচ্চবর্ণ-মধ্যবিত্তের একচেটিয়া আধিপত্য থাকবে না? বঙ্গীয় সাম্যবাদের সামনে ইতিহাস এখন এই দুটো রাস্তা খোলা রেখেছে। এখনই ঠিক করে নিতে হবে যে, এর পর নতুন ইতিহাস লেখা হবে, না কি বিষাদগীতি গাওয়া হবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CPIM Dalits
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE